কালো টাকা অর্থনীতিতে একটি বহুল আলোচিত-সমালোচিত এমনকি বিতর্কিত বিষয়। সেই কালো টাকার ভালো-মন্দের কাহিনী নিয়েই এ লেখা। তবে তার আগে টাকা বিষয়ক কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক। যতদূর জানা যায় সংস্কৃত টঙ্ক শব্দ থেকে এসেছে ‘টাকা’ শব্দটি। যার অর্থ রৌপ্যমুদ্রা। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার বিনিময় মাধ্যম হিসেবে রাষ্ট্রীয় মুদ্রার নাম নির্ধারণ করে ‘টাকা’। টাকার বাংলা সাংকেতিক চিহ্ন ‘$’। ইংরেজিতে আন্তর্জাতিকভাবে এই টাকার সাংকেতিক পরিচয় ‘বিডিটি’। এবার জেনে রাখুন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কাগুজের নোটটি হচ্ছে বাংলাদেশের দুই টাকার নোট। রাশিয়ার বিনোদন বিষয়ক অনলাইন ভোটের মাধ্যমে বিশ্বের সুন্দরতম নোট হিসেবে নির্বাচিত হয় বাংলাদেশের দুই টাকার কাগুজে নোট।
এবার কালো টাকা প্রসঙ্গ। রূপে-রঙে কালো বা সাদা টাকার অস্তিত্ব নেই। সাদা ও কালো শব্দ দুটি অলীক। এমন টাকার অস্তিত্ব না থাকলেও আছে কালো টাকার ‘কালো কাহিনী’। সম্ভবত একারণেই আছে সাদা টাকার কথাও। তাহলে কালো টাকা কি? কালো টাকার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা না থাকলেও আমরা সহজ অর্থে বুঝি অনৈতিক উপায়ে বা দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ ‘কালো টাকা’ নামে পরিচিত। অবৈধভাবে অর্জিত টাকা যেমন- দুর্নীতি, ঘুষ, কালোবাজারী, চোরাকারবারী, মাদক বা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্জিত আয় কালো টাকা নামে অভিহিত। কালো টাকা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে একটি অপ্রদর্শিত-অপ্রকাশ্য রূপ।
কি কি উপায়ে টাকা কালো হয়? সম্পত্তি দখল, খেলাপি ঋণ, সরকারি কোষাগারের অর্থ লুট, সরকারি কাজে ব্যয় দেখিয়ে অর্থ লোপাট, ঘুষ, দুর্নীতি, কর অবকাশের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, চোরাচালান-চোরাকারবার, সরকারি ক্রয়, বিভিন্ন দপ্তরের সংস্কার, নাম ও পোশাক পরিবর্তনের নামে লোপাট, আন্তর্জাতিক টেন্ডার চুক্তি, মুদ্রা পাচার বা হুন্ডি ব্যবসা প্রভৃতি নানান নামধারি উপায়ে উপার্জিত অর্থ গোপন লেনদেন বা গোপনে ব্যবহারের মাধ্যমে কালো টাকায় পরিণত হয়।
বাজেট এলেই আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয় কালো টাকা। অথচ কালো টাকার বলয়ে আবর্তিত আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। মন্ত্রী, সাংসদ থেকে শুরু করে সকল স্তরের জনপ্রতিনিধি, আমলা, ব্যবসায়ীদের মাঝে কালো টাকার সাদা বেশধারী মানুষের সংখ্যা অনেক। এই বলয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে কালো টাকা। সমাজ এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রভাবিত করছে এই কালো টাকা। কথা হলো এই কালো টাকার উৎস কি নির্মূল বা বন্ধ করা সম্ভব? উত্তর হবে না? রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন না হলে কালো টাকার উৎসগুলো বন্ধ হবেনা। সুতরাং কালো টাকা থাকবেই। আমরা দেখেছি এক এগারোর কেয়ারটেকার সরকারের আমলে কালো টাকার মালিকদের তালিকা ছাপা হয়েছে। এই তালিকায় নাম এসেছে সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে অফিসের পিয়ন এমনকি দালাল পর্যন্ত। বালিশের ভেতর টাকা, চালের ড্রামে টাকা, বস্তায় টাকা, বস্তায় টাকা, গাড়ীতে টাকা, বাড়ীতে টাকা এমনকি হাড়িতে টাকা- টাকার এমন সস্তা দৃশ্য তখনই দেখাগেল। ওসমান গণি থেকে শুরু করে অফিস পিওনের বাগানবাড়ি, হরিণ বিহার, অট্টালিকা, গাড়ী বিলাস কত কাহিনী জানা গেল। কি হয়েছে তাদের? তাদের সম্পদ কি বাজেয়াপ্ত হয়েছে? টাকা কি সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে? হয়ে থাকলে কত টাকা জমা হয়েছে? কত কালো টাকা ভালো করার নামে দুর্নীতি আশ্রয়ে আবারো কালো টাকার কাহিনী তৈরি হয়েছে?
আমরা জানি, কর ফাঁকি, সুদ, ঘুষ আর দুর্নীতির সংস্কৃতি বিশ্বের সব রাষ্ট্রেই কমবেশি বিদ্যমান। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুসারে ভারতের ১৯৮৩ ও ’৮৪ সালে ব্ল্যাক রুপি পরিমাণ ছিল তাদের দেশজ মোট উৎপাদনের ১৯ ও ২১ ভাগ। সেখানে কালো টাকার মালিকরা ২৪ দশমিক ৫ লাখ কোটি কালো রুপি বিদেশে পাচার করেছে। বলা হয়েছে এই ব্ল্যাক রুপির অর্ধেক পরিমাণও যদি স্বাভাবিক অর্থনীতিতে যুক্ত হতো, তাহলে ভারত সরকার বছরে ২ হাজার বিলিয়ন রুপি অতিরিক্ত রাজস্ব পেত। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে প্রথম বারের মতো ৭০ কোটি কালো টাকা সাদা হয়।
এরপর প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে দুই দফায় ১৯৮৮-৮৯ সালে ২০০ কোটি এবং ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে ২৫০ কোটি কালো টাকা সাদা করা হয়। পরবর্তী বিএনপি সরকার ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং প্রশংসিত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার এসে প্রায় প্রতি বছরই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। ফলে সে সরকারের আমলে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার মতো কালো টাকা সাদা হয়। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকার বিনিয়োগ শর্তে ২০০১-০২ অর্থ বছরে ৪০০ কোটি, ২০০২-০৩ অর্থবছরে ১০০০ কোটি এবং ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৪৬০৩ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। ২০০৭-০৮ সালে এক এগারোর কেয়াটেকার সরকার দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঙ্কের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়- যার পরিমাণ ৯৬৭৭ কোটি টাকা। এক হিসাবে দেখা গেছে স্বাধীনতার পর গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশ সরকার মাত্র ১৮ হাজার কোটি কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা কর আকারে আদায় করেছে। যার পরিমাণ এই ৪২ বছরে বেড়েছে বৈকি।
এই যদি হয় কালো টাকা সাদা করার কাহিনী তাহলে প্রশ্ন- কালো টাকার পরিমাণ আসলে কত? অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ দেখা গেছে, দেশে অঘোষিত বা কালো টাকার পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের ৮০ শতাংশ। যার পরিমাণ ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। আরেক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর ৭০ হাজার কোটি টাকার কালো টাকা অর্জিত হয়। যার থেকে ২০ হাজার কোটি কালো টাকা কোনো না কোনো উপায়ে সাদা নামে বৈধ হয়। অনেকের ধারণা সরল হিসাবে সর্বনিম্ন হার ধরলেও দেশে মোট কালো টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।
এখন বিচার করে দেখার সময় এসেছে কালো টাকা সাদা করলে লাভ, নাকি কালো টাকার উৎস বন্ধ করলে ভালো। তবে একথা সত্য যে কালো টাকার উৎস নির্মূল করা সম্ভব নয়। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে খারাপ দিকগুলো কি? অনেকের মতে, এতে দুর্নীতি উৎসাহিত হয়, নীতিবান ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারায়, দুষ্টচক্র ও কালো অর্থনীতির প্রভাব বাড়ে, অর্থসংক্রান্ত দুর্নীতি সম্প্রসারিত হয়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে- কালো টাকা সাদা করার সুযোগে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ হলে- উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়, অপরাধপ্রবণতা ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। অপরপক্ষে কালো টাকার মালিক যদি বৈধ খাতে বিনিয়োগ সুবিধা না পায় তাহলে- কালো টাকা কালো জগতে ঘুরপাক খায়। ফলে কালো অর্থনীতির বিস্তার ঘটবে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইন-শৃংখলার অবনতি, মূল্যস্ফীতি, সামাজিক অস্থিরতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়। কালো টাকার মালিক কালো জগতে অর্থ ব্যয় না করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের ব্যাংকে স্বল্প সুদে নিরাপদে রাখার জন্য পাচার করবে। এরফলে দেশের টাকা বিদেশ চলে যাবে। কালো টাকাকে হালাল ব্যবহারের সুযোগ করে দিবে বিদেশীরা। যেমন- মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম প্রকল্প’।
আমাদের দেশে কালো টাকার নিন্দিত মালিকেরা মালয়েশিয়ায় বাড়ি-গাড়ি করে নন্দিত ধনাঢ্য ব্যক্তির মর্যাদায় আসীন হতে পারছেন। তাহলে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ না দেয়াটা ক্ষতিকর নয় কি? বাংলাদেশী পুঁজিপতিরা লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি এসব দেশের নাগরিক হয়েছেন। অসংখ্য বাংলাদেশী ব্যবসায়ী-শিল্পপতির বিনিয়োগ আছে বিদেশে। অতএব কালো টাকা আটকাবেন কি করে। আমাদের দেশ আটকাবে তো অন্য দেশ তাদের আশ্রয় দেবে! তাহলে দেখা যাচ্ছে, কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেয়াটাই উত্তম। তবে রাজস্ব আদায় জোড়দার হতে হবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, কালো টাকার উৎস বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়াই হবে সর্বোত্তম উপায়। তবে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে দেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পকগুলোকে বেছ নেয়া যেতে পারে। আমাদের পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎ খাত, জেলা ও থানা পর্যায়ে শ্রমঘন শিল্প এসব খাতকে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে। আবাসন খাতের জন্য এ সুযোগ বড়লোকদের আরো বড় করার সুযোগ বলে অনেকের অভিমত। কারণ কালো টাকা সাদা করার জন্য তারা এখন বৈধভাবে অসংখ্য ফ্ল্যাট বা এপার্টমেন্টের মালিক হয়ে যাবেন। ফলে ফ্ল্যাট বা এপার্টমেন্টের দাম আকাশে উঠবে। মধ্যবিত্তরা আর ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখতে পারবেনা। তাই সুযোগ প্রদানের বিষয়ে বিস্তর ভাবনা চিন্তার আবশ্যকতা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে ২৩ হাজার ২১২ জন কোটিপতি আছেন। তারা সবাই কি ট্যাক্স দেয়? জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুসারে, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ লাখ টাকা ব্যক্তি আয়কর দেয়ার মতো ১ হাজার ব্যক্তিও দেশে নেই। তাহলে বুঝা গেল টাকাওয়ালাদেরকে ধরতে পারছেনা সরকার। সুতরাং শুধুমাত্র কালো টাকা সাদা করা নয়, সকল টাকাওয়ালাদের ট্যাক্স ফাঁকি বন্ধ করা উচিত। আদায় ট্যাক্স আদায়ে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই সুফল পাওয়া যাবে।
লেখক ও প্রাবন্ধিক,
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন