সাপ্তাহিকী
|
লায়লা খন্দকার
|
|
‘দুনিয়া ডট কম’-এর যুগে শিশু অধিকার
29 Jun, 2013
ঢাকার বনানী এলাকায় একটা রেস্টুরেন্ট আমার বেশ প্রিয়। খাবার সুস্বাদু, কিন্তু তার চেয়েও বড় আকর্ষণ বাইরে সবুজঘেরা বসার জায়গা। এখনকার সময়ে বেশ বিরল ব্যাপার। কিছুদিন আগে সেখানে স্কুলের বন্ধু সামিরার সঙ্গে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দেখি ছোট এক কাঠবেড়ালী আমগাছে দৌড়ে বেড়াচ্ছে! এই দৃশ্যে মুগ্ধ আর বিস্মিত না হয়ে উপায় আছে? খাবার দিতে এসে ওয়েটার বলল, ‘আপা মোবাইলে ছবি তুইলা রাখেন। পরে সবাইরে দেখাইতে পারবেন।’ আমাদের মোবাইলে ক্যামেরা নেই, থাকলেও ছবি তোলার কথা ভাবতাম না। কিন্তু ওয়েটারের মন্তব্যে মনে হলো, এখন অনেকে নিজেরা কি করছে তার চেয়েও অন্যরা তাদের সম্পর্কে কি জানছে সে বিষয়ে বেশি আগ্রহী? আর তাই কি কোথাও বেড়াতে গিয়ে সে স্থানটির সৌন্দর্য উপভোগের চাইতে অসংখ্য ছবি তোলাতেই তাদের উৎসাহ? সামিরা বলল, ‘আর বলিস না, এমনিতেই নিঃশ্বাস নেয়ার মতো স্থান খুব কম। যেটুকু আছে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক-এর জন্য নিরিবিলিতে তা দেখার সুযোগ বেশিরভাগ জায়গাতেই নেই। আর ইদানীং তো বিয়েবাড়িতে গিয়েও মনে হয় ছবি তোলাটাই মূল উদ্দেশ্য। মাঝেমধ্যে ক্যামেরা হাতে অনেকে এমনভাবে স্টেজ ঘিরে থাকে যে বর-কনেকে দেখার উপায় নেই। ভাবি, অনুষ্ঠানে যাওয়ার দরকার কি ছিল, পরে ছবি দেখলেই হতো! অবশ্য কোনো কোনো অতিথির আচরণে মনে হয় যাদের বিয়ে হচ্ছে তাদের নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ নেই। তারা ব্যস্ত নিজেদের ছবি তোলায় যা পরে ফেসবুকে আপলোড করবে।’
এই আত্মকেন্দ্রিকতা আর দেখানোপনা কি বেশ চিন্তার বিষয় নয়? কোনো সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি ধারণ করতে চাওয়া এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে তা ভাগ করে নেয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই কিছু করার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে না। অবশ্য অনেকে তো ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ভেবে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত। তাই তারা নিজেদের জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জন না, ‘লোক’দের দেখানোর জন্য সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকলে অবাক হই না। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ছবি তোলা খুব সহজ হয়ে গিয়েছে, তবে জীবনের সব ক্ষেত্রের মতো এখানেও পরিমিতিবোধের দরকার; সেটা আমরা এখনো শিখিনি। সমস্যাটা বোধহয় সেখানেই। আমরা (বড়রা) যদি সঠিক আচরণ না জানি তাহলে শিশুদের শেখাব কি করে?
২
ঢাকার একটা শপিং কমপ্লেক্সের লিফটের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। কয়েকজন কিশোর-কিশোরী আগের থেকে সেখানে ছিল। তাদের কথার মাঝে ‘ফেসবুক’, ‘স্কাইপ’ ইত্যাদি শব্দগুলো শোনা যাচ্ছিল। লিফট আসছে না। কি ব্যাপার? বুঝতে পারলাম যে, লিফট চলার সাধারণ নিয়ম নিয়ে তাদের ভ্রান্ত ধারণা আছে এবং তাই ঠিক বাটনটিতে চাপ দেয়নি। মন্তব্য নি®প্রয়োজন। সেই মুহূর্তে আমি কিছুটা বুঝলাম কেন আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে অনেকের মাঝে এক ধরনের অপরিপক্বতা আছে। যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ে যারা প্রাথমিক শিক্ষাটুকু পায়নি তাদের হাতে অত্যাধুনিক সব গ্যাজেট চলে এসেছে। তাই তারা বাহ্যিকভাবে ‘স্মার্ট’ হলেও কিভাবে প্রযুক্তির অগ্রগতিকে নিজেদের কল্যাণে কাজে লাগাতে, এবং সে প্রক্রিয়ায় অন্যদের ক্ষতির কারণ না হতে হয় তা শেখেনি। প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারের জন্য কিছু দক্ষতা ও মানবিক মূল্যবোধ দরকার। মা-বাবার দায়িত্ব সন্তানদের সে বিষয়ে শিক্ষা দেয়া। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই কি এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হয়ে ওঠাটা ভীষণ জরুরি নয়?
এ বিষয়ে কথা উঠলেই শুনতে হয়, ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা এত সহজে সব যন্ত্রপাতি সম্পর্কে শিখে যায় যে মা-বাবাদের কিছু করার থাকে না।’ কেউ হয়তো বলে, ‘বাচ্চাদের বই কিনে দিলেও পড়ে না,সারাক্ষণ কম্পিউটার আর ভিডিও গেমস নিয়ে ব্যস্ত।’ এই যুক্তিগুলো বেশ অদ্ভুত। মা-বাবা যদি সঠিক নির্দেশনা দিতে না পারেন তার দায়ভার নিশ্চয়ই সন্তানদের নয়? শিশুদের খাওয়া, পড়াশুনা, খেলাধুলা, বিনোদন ইত্যাদি নিয়ে মূল সিদ্ধান্তগুলো মা-বাবাই নেন। কোন বিষয়ে অল্পবয়সীরা কতটুকু সময় দেবে বা কোনটা করা তাদের জন্য ভালো বা ক্ষতিকর তা ঠিক করার দায়িত্ব তাদের। প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। শুধু প্রয়োজন সন্তানদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের পছন্দ-অপছন্দ ও বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে জানা এবং বয়স ও মানসিক পরিপক্বতা অনুযায়ী তাদের তথ্য ও বিনোদন নিশ্চিত করা। কিছুদিন আগে শুনলাম যে, এক সহকর্মীর তিন বছরের সন্তান বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে আইপ্যাডে চার্জ না থাকলে ‘বোরড ফিল’ করে! এত অল্প বয়সে তাকে যন্ত্রটি কে কিনে দিয়েছে? এরপর যদি মা-বাবা বলে ‘বাচ্চারা সারাদিন কম্পিউটার নিয়ে পরে থাকে’ তাহলে সেটা কি গ্রহণযোগ্য? সন্তানদের নানা সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত করার কোনো প্রচেষ্টা না করে আর বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি কিনে দিয়ে ‘এ যুগের ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে চায় না’ ইত্যাদি অভিযোগ মা-বাবাকে মানায় কি? সেটা কি সন্তানের জন্য নিজ দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়া নয়? আমরা কয়জন শিশুকে বই পড়ে শোনাই বা তাদের নিয়ে পার্ক, মিউজিয়াম বা নানা দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যাই? আত্মসমালোচনার সময় মনে হয় এসেছে।
৩
‘হাবলু গাবলু পেয়ে গেল ডাব্লু ডাব্লু আইডিয়া
ইমেইলে যুক্ত হোল হনলুলু হলদিয়া
দুনিয়া ডট কম দুনিয়া ডট কম দুনিয়া ডট কম...।’
বর্তমান যুগে ইন্টারনেট সব ক্ষেত্রেই এক নতুন মাত্রা আনছে। ইদানীং ফেসবুকের একটা বিষয়ে আমি ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ। কেউ কেউ শিশুদের এমন ছবি পোস্ট করে যা তাদের মর্যাদার জন্য হানিকর ও অশ্রদ্ধাজনক। এর সঙ্গে তাদের মুখে এমন সংলাপ জুড়ে দেয়া হয় যা আসলে বড়দের কথা! এটা করে কিছু মানুষ যে কি মজা পাচ্ছে কে জানে? আমার কাছে তো এটাকে বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ বলে মনে হয় এবং কোন সন্দেহ নেই যে এটা শিশু অধিকারের লঙ্ঘন। শিশু বা অন্য কেউ যদি আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করত তাহলে আমরা কি প্রতিক্রিয়া দেখাতাম? আমরা কি মেনে নিতাম? ছোটরা এখনো প্রতিবাদের ক্ষমতা অর্জন করেনি বলেই কি আমরা তাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতে পারি? শিশুরা পরিবার, স্কুল, প্রতিষ্ঠানসহ সবস্থানেই নানা রকমের নির্যাতনের শিকার হয়। ইন্টারনেট শিশুদের জন্য অনেক নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া যেন শিশু নির্যাতনের আরেক ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে অনেকে বুঝতেই পারছে না যে শিশুদের ছবি এভাবে পোস্ট করার মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। তাহলে তারা এগুলো ফেসবুকে দিত না। ব্যাপারটা শিশুদের প্রতি আমাদের সংবেদনশীলতার অভাবের একটা উদাহরণ।
৪
‘শিশু আরেক শিশুকে মারলে আমরা তাকে আগ্রাসি আচরণ বলি। শিশু যদি বয়স্ক কাউকে মারে তাকে বলা হয় বৈরিতা। বয়স্ক ব্যক্তি বড় কাউকে মারলে আমরা তাকে বলি হামলা। আর বড় কেউ শিশুর গায়ে হাত তুললে তার নাম হয় নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা দেয়া।’
-হেইম জি জিওনট (শিক্ষক ও শিশু মনোবিজ্ঞানী)
বড়দের সঙ্গে যে আচরণ করার কথা আমরা চিন্তাও করতে পারি না, শিশুদের সঙ্গে তা কি অবলীলায় করছি, এবং সেটা যে অগ্রহণযোগ্য এবং শিশুর জন্য ক্ষতিকর সে বিষয়ে নির্বিকার থাকছি। আমাদের স্ববিরোধিতার অবসান হবে কবে?
৫
জাতিসংঘ প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট অন ভায়োলেন্স এগেইন্সট চিলড্রেন’ (২০০৬) এর মূল বক্তব্য হলো, ‘শিশুদের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতাই গ্রহণযোগ্য নয়, এবং শিশুদের বিরুদ্ধে সব সহিংসতাই প্রতিরোধযোগ্য।’
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা (বড়রা) এই সহিংসতার অবসান চাই কিনা? পরিবার ও বিদ্যালয়সহ সর্বস্তরে শিশুরা যে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তা প্রতিরোধে আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরটা নেতিবাচক হবে। একদিকে আমরা ‘শিক্ষা দেয়ার’ নামে শিশুদের মারধর করছি, অন্যদিকে তাদের জন্য অবমাননাকর ছবি ফেসবুকে আপলোড করছি।
আর কতদিন লাগবে আমাদের আচরণগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে? আমরা কবে শিশুদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শিখব?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন