(১)
আমরা বাংলাদেশের মুসলিমেরা যেন ধ্বংস হয়ে যাবার জন্য দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছি। চারিদিকে যে ভয়ংকর নৈরাজ্য চলছে আমাদের তাতে এ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? কোন জিনিষটি আমাদের ঠিক আছে বা ঠিকমতো কাজ করছে? রাষ্ট্র,সমাজ, শিক্ষা, বিচারব্যাবস্থা, ধর্ম সবখানেই চলছে নিজেদের সৃষ্টি করা দুর্যোগ ও ভাংগনের উন্মত্ত তাণ্ডব। আমাদের হাতে কেন কোণ কিছুই ঠিক থাকেনা, সবকিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ও একটা কুৎসিত রুপ ধারন করে? নিশ্চয়ই আমাদের স্বভাবে ও চরিত্রে কোণ গভীর ও মারাত্মক সমস্যা আছে। তা না হলে অবস্থা আমাদের এতো শোচনীয় হয় কিভাবে?
আমাদের হাতে রাষ্ট্রব্যবস্থা একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। এর কোণ একটি অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠান তার স্বাভাবিক অবস্থায় নেই ও ঠিকমতো কাজ করছেনা। সবকিছুরই আমরা অপব্যবহার করছি এবং সবকিছুকেই আমরা বিকৃত করে ফেলেছি। ফলে রাষ্ট্র একটা ভয়ঙ্কর দানবের রুপ নিয়েছে আমাদের হাতে। রাষ্ট্রের হাত থেকে নিরাপদ থাকাই এখন মানুষের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র দিনরাত অকারন উত্তেজনা ও বিতর্ক সৃষ্টি করে, বিভেদ, সঙ্ঘাত ও সহিংসতার রাস্তা উন্মুক্ত করে দেয়। সমাজে উগ্রতা, হানাহানি ও হিংস্রতা সৃষ্টি করে। হেন অন্যায়, অপকর্ম ও অত্যাচার নেই যা রাষ্ট্র আজ করছেনা। রাষ্ট্র ধোঁক দেয়, প্রতারনা করে, কথায় কথায় জলজ্যন্ত মিথ্যা বলে, ইচ্ছামতো মানুষ খুন করে, গুম করে, যাকে তাকে যেমন খুশী মামলা দিয়ে নাস্তানাবুদ করে, মানুষকে অপমান ও অপদস্থ করে, অবিচার করে, বিচার বিলম্বিত করে, সুবিচারকে বাধাগ্রস্ত করে, মানুষের ন্যায্য পাওনা মিটিয়ে দিতে অস্বীকার করে, কখনো তা দিলেও সেটাকে দয়ার দান মনে করে। সন্ত্রাস এবং বিশৃঙ্খলার উপর রাষ্ট্র একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। এক কথায় মানুষের জীবনে নিরাপত্তা, সুস্থিতি, শান্তি ও কল্যান নিশ্চিত করার বদলে তাদের জীবনে বিড়ম্বনা, গ্লানি ও যন্ত্রণা বাড়িয়ে তাদের নাস্তানাবুদ, হীনমন্ন্য ও আশাহত করে ফেলাই যেন রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২
আমাদের এই রাষ্ট্র মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নিতে বাধ্য করে। অন্যায়,অপকীর্তি ও অনাচারকে সুকীর্তি ও সদাচার বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ভালোকে মন্দ ও মন্দকে ভালো বানিয়ে দিতে চায়। মুল্যবান জিনিষকে তুচ্ছ ও ঘৃণ্য বানায়, ঘৃণ্য ও মুল্যহীন জিনিষকে মুল্যবান বানিয়ে দেয়, ভালো মানুষকে খারাপ করে ছাড়তে চায়। মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করে তাকে পরম মর্যাদার আসনে বসানোকে এবং অসত্য ও নির্লজ্জতাকে গৌরবমণ্ডিত করে তোলাকে রাষ্ট্র এর একটি পরম পবিত্র কর্তব্য গণ্য করে নিয়েছ।
রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে একান্ত একটি দলীয় প্রতিষ্ঠান। সরকারের নিজের দলের সেবা করাটাই হয়ে গেছে রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজ। দল ও দলের মানুষদের হীন স্বার্থ সাধনের জন্য রাষ্ট্রের স্থিতি ও আপামর জনসাধারণের কল্যান এবং ভবিষ্যতকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। দল ও দলের মানুষদের সমস্ত অন্যায় ও অপকর্মের সুরক্ষা দান করার জন্য রাষ্ট্রটির সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সাজিয়ে সদা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। দলের বাইরে আর যারা দেশে বাস করে তাদের নিতান্ত দয়া করে দেশে থাকতে দেওয়া হয়েছে মাত্র। তার বেশী কিছু নয়। এদেশে থাকতে চাইলে একান্ত বশংবদ অনুগত প্রজা হয়ে সমস্ত অন্যায়,অত্যাচার,অবিচার ও অপমান খুশীমনে মেনে নিয়েই থাকতে হবে। সরকারি দলের বাইরে দেশের অগণিত মানুষের জন্য এই অতি সুস্বাদু স্বাধীনতার স্বাদেরই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দলীয় এই রাষ্ট্রের কিছু বাহিনী আছে – স্বনামে ও বেনামে। ঔদ্ধত্য,উগ্রতা, কুটিলতা ও হিংস্রতা তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নাম তাদের – পুলিশ, র্যা ব, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিকলীগ। এদের প্রধান কাজ হচ্ছে যতো রকম ভিন্নমতালম্বি বা প্রতিদ্বন্দ্বী যে যেখানে আছে তাদের খুচিয়ে, খুচিয়ে বের করে নিয়ে আসা এবং তারপর আইনি, বেআইনি যেভাবে, যতোভাবে পারা যায় তাদের শায়েস্তা করা। সবচেয়ে ভাল হয় যদি তাদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়। রাস্তাঘাটের যেকোণ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে তার নামে জঘন্য কোণ বানোয়াট মামলা দিয়ে দেওয়া হয়, মানুষকে ধরে এনে পুলিশ থানার মধ্যে তাকে গুলি করে মেরে ফেলে বা চিরজীবনের মতো পঙ্গু করে দেয়, রাস্তার মধ্যে মানুষের গায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে গুলি করে মেরেও ফেলে। কথায় কথায় মানুষকে রিম্যান্ডে নিয়ে হেন অসম্মান ও নির্যাতন নেই যা করা হয়না। এতোসব অন্যায় ও অত্যাচারের পাশাপাশি এসব বাহিনীর সদস্যদের একেবারে মুক্তভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে অবাধে তাদের আখের গুছিয়ে নেবার জন্য। আখের গুছাবার অসংখ পথের মধ্যে একটি হচ্ছে যেকোণ ঘটনায় হাজার হাজার অজ্ঞাত মানুষের নামে মামলা দিয়ে যতো বেশি মানুষের কাছ থেকে সম্ভব অর্থ আদায় করা যায় তার ব্যবস্থা করা।
রাষ্ট্রের আরো যেসব প্রতিষ্ঠানের মানুষের সেবা দেবার কথা সেখানে স্বাভাবিকভাবে কোণ কাজটা হয়? ঘুষ, ক্ষমতার দাপট বা প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছু একটা লাগবেই। সরকারি দপ্তরের দারোয়ান থেকে চেয়ারে বসা মানুষদের প্রধান কাজ হচ্ছে সাধারন মানুষদের যতোভাবে পারা যায় অসম্মান, হয়রান ও শোষণ করা - মানুষের প্রয়োজন ও অসুবিধার সুযোগ নিয়ে তাদের বুকের উপর চেপে বসা ও তাদেরকে জিম্মি করে রেখে ক্ষমতার দাপট দেখান ও নিজেদের পকেট ভারী করা। সরকারি দপ্তরে গিয়ে সম্মানজনক আচরন লাভ করা এবং নিজের প্রাপ্য বিনা ঝামেলা ও খেসারতে যথাসময়ে ঠিকমত বুঝে পাওয়ার চিন্তাই সুস্থ মস্তিস্কে করা যায় না। কোণ কাজ নিয়ে সরকারি দপ্তরে যাওয়া সুন্দরবনে বাঘের কাছে যাওয়ার চেয়ে ভয়ের জিনিষ হয়ে গেছে আমাদের এই রাষ্ট্রে। কারন বাঘ আর যাই হউক কাউকে অপদস্থ করতে শেখেনি। আর চেষ্টা করলে এবং ভাগ্য ভাল হলে হয়তো বাচাও যায় বাঘের হাত থেকে। কিন্তু সরকারি দপ্তরে এদের বিছানো জাল থেকে আত্মরক্ষার উপায় কি কিছু আছে? ( তবে এখানে আসল কথা যেটা তা হচ্ছে সরকারি দপ্তরের লক্ষ লক্ষ এই ফিরাউনেরা কারা? এরা তো আমরাই। এই সমাজেরই মানুষ এবং আমাদেরই কেউ না কেউ।)
রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা দিনরাত অর্জন,অর্জন করে আকাশ বাতাস মথিত করে তোলে। লিমন, আব্দুল কাদের, ইলিয়াস, বিশ্বজিৎদের পাশে কোণ অর্জন কি আর অর্জন থাকে? এদেশের যেকেউ যেকোণ সময় এদের যেকেউ হয়ে যেতে পারে। মাত্র একদিনেই দেশের ষাট-সত্তুরজন মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মারাও একটা বড়ো অর্জন বৈকি। সাভারের রানা প্লাজার হৃদয় বিদারক ঘটনাটাও কি সরকারের অতি গৌরবময় একটা অর্জন নয়? রানা কে? রানা তো তাদেরই সযত্নে উৎপাদিত ফসল। উদ্ধার হওয়া ও না হওয়া লাশগুলি, আহত ও পঙ্গু মানুষগুলি, পরিবার ও পরিজন হারা নিঃস্ব শোকার্ত ও শিশু সন্তানসহ দিশেহারা দরিদ্র মানুষগুলি তো সরকারি দলেরই রাজিনীতির খোরাক।
সংসদ হয়ে গেছে মিথ্যা, অশালীনতা ও কদর্যতার সুরক্ষিত আসর। সেখানে যেসব জঘন্য কথাবার্তা হয় এবং যে ভঙ্গিতে হয় তার বিবরন দেবার মতো ভাষা খুজে পাওয়া যায়না। এতো কুৎসিত মনের ও নিম্ন মানের মানুষ যখন ১৫ কোটি মানুষের ভালমন্দের দায়িত্ব গ্রহন করে তখন সে জনগোষ্ঠীর কপালে যে দুঃখ নেমে আসতে বাধ্য তা নিয়ে আর কোণ সন্দেহ থাকতে পারেনা। এই সংস্কৃতির রাস্তা বেয়ে সামনে এগিয়ে গিয়েই তো সৃষ্টি হতে পেরেছে রাজীব ও তার সমজাতীয় ব্লগারদের।
তবে শুধু আওয়ামী লীগকে দোষ দেওয়া ঠিক হবেনা। উল্লেখ করার মতো অন্য যারা আছে তারাও মোটেই কলুষমুক্ত নয়। তাদের স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরনে ভক্তি ও সমীহ করার মতো তেমন কিছু পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদেরকেও দেখা যায় মিথ্যা, অনাচার, অন্যায় ও অপকর্মের আশ্রয় নিতে। ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ ও বাহাদুরি করার আগ্রহ তাদের মধ্যেও প্রকট। বিনয়, যোগ্যতা ও দায়িত্বশীলতার সাথে যথাসম্ভব সবার কল্যানে ক্ষমতা চর্চা করার মনোবৃত্তির অভাব তাদেরও আছে। তাদের উপরও তাই তেমন ভরসা করার কোণ যুক্তিসঙ্গত কারন নেই। এদের হাত দিয়ে যে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচ্ছন্ন রুপ লাভ করবে, রাষ্ট্রে ও সমাজে সুবিচার, সদাচার ও শান্তি ফিরে আসবে এমন আশা করার কোণ ভিত্তি নেই।
(২)
সমাজের অবস্থাও এক কথায় ভয়ংকর । এমন কোন অন্যায়, অপরাধ, দুষ্কৃতী ও অনাচার নেই যা আজ আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়নি। অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা একান্তই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মানুষের গায়ে এসিড মেরে তার শরীর ঝলসিয়ে বিকৃত করে দেওয়া একটা সাধারন ব্যপার। ধর্ষণ একটা মহামারীর রুপ নিয়েছে। এককভাবে, দলবেঁধে যতোভাবে সম্ভব করা হচ্ছে এই অতি উপভোগ্য কর্মটি। ধর্ষণের পর আবার বিচিত্র সব নিষ্ঠুরতম কায়দায় মেরে ফেলা হচ্ছে ধর্ষিতাকে। দু’বছরের শিশু থেকে ষাটোর্ধ প্রৌড়া কেউ বাদ যাচ্ছেনা। একপ্রান্তে ধর্ষিতার বয়স যেমন নিচে নামছে এবং অন্যপ্রান্তে ধর্ষণকারীর বয়সও তেমনি উপরে উঠছে। এসব কীর্তিবানদের বাচাবার জন্য জন্য সমাজের মান্যবর ও দাপটওয়ালাদের ফন্দি ফিকিরেরও অভাব দেখা যায়না। ৪
নারীর আরেক দুর্গতির নাম হচ্ছে যৌতুক। যৌতুক পাবার জন্য নৃশংস অত্যাচার করতে পারে, অন্যদের দিয়ে নিজের স্ত্রীকে ধর্ষণ করাতে পারে বা এমনকি বিচিত্র কায়দায় খুনও করে ফেলতে পারে। শহরে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় ঘরে ঘরেই কি এই অবস্থা নয় এদেশে? পুরুষ মানুষ কতো বেহায়া, অপদার্থ ও জঘন্য হোলে যৌতূক দাবী করতে পারে ও তা না পেলে এসব অবিশ্বাস্য অপকীর্তি করতে পারে তা পরিমাপ করার সাধ্য কার আছে? আমাদের মমতাময়ী নারীরা তারাও কি কম যান যৌতূকের জন্য পুত্রবধুকে অত্যচার ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার ক্ষেত্রে? বরং প্রায়ই তো দেখা যায় তারাই অন্যদের চেয়ে ঢের অগ্রগামী। বাড়ির কাজের মেয়েদের উপর, বিশেষ করে সে যদি বাচ্চা হয়, অত্যাচার করার ক্ষেত্রেও আমাদের মমতাময়ী নারীদের একটা বড়ো অংশই একেবারে অতুলনীয়।
আমাদের এই সমাজে সবলের কাছে দুর্বল একেবারে অসহায়। যার একটু ক্ষমতা আছে তার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার তুলনায় ক্ষমতাহীনের উপর দাপট দেখানো ও অত্যাচার করা। ক্ষমতা অর্থের হতে পারে, প্রভাব-প্রতিপত্তির হতে পারে, পদ-পদবীর হতে পারে, পেশির হতে পারে বা সাংগঠনিক শক্তির হতে পারে। ক্ষমতা যতো সামান্যই হোক না কেন তার সুযোগ নিয়ে নিজের অন্যায় সুবিধা করে নিতে ও অপব্যবহার করে অপরের অসুবিধা ঘটাতে বা ক্ষতি করতে মোটেই দ্বিধা হয়না আমাদের। মুহূর্তেই ক্ষমতা গরম করে ফেলে আমাদের মাথা এবং চারিদিকে তার উত্তাপ ছড়াতে থাকে। সুবিচারের কোন সংজ্ঞাই নেই আমাদের। সুবিচার আবার কি? নিজের সুবিধাঁটাই তো একমাত্র সুবিচার। সামান্য স্বার্থই আমাদের পরম নির্লজ্জ ও নিষ্ঠুর করে তোলে। আমাদের এই সমাজে ক্ষমতাবানের হাতে অত্যাচারের রুপ যে কত বিচিত্র হতে পারে, আর কতো নিষ্ঠুর হতে পারে তার অজস্র উদাহরন মেলে প্রতিদিনের খবরের কাগজের পৃষ্ঠায়। খবরের কাগজেই বা আর কটা খবর আসে? বাস্তবে যা ঘটে তার খুব সামান্যই।
৫
ক্ষমতাবান যে অন্যায় ও অত্যাচার করবে, সুযোগ থাকলে তা কাজে লাগিয়ে নিজের খেয়াল, খুশী ও স্বার্থ চরিতার্থ করবে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে আমাদের সমাজ মানসিকতায়। কেউ কেউ যে তাতে কষ্ট পায় বা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং এভাবেই যে আমাদের সামগ্রিক জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে সে আর এমন কি ব্যপার! নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কোণ তহবিল হাতে পেলে কিছু যে মেরে খাবে এটাই তো স্বাভাবিক। একেবারে সব না খেয়ে ফেললেই হোল। এসব নিয়ে আবার কথা বলার বা হৈচৈ করার কি আছে? এই হচ্ছে আমাদের মনোভাব।
ডাক্তার যে শপথ নিয়েছে সেবা করার সেও জঘন্য দলবাজি করে, নিজেরা মারামারি, এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত করে, রুগীকে সময় মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়না, রুগীর সাথে দুর্ব্যবহার করে বা এমনকি তাকে মেরেও বসে, মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত মৃত্যুপথযাত্রী বা নিহত মানুষের গায়ে কোন আঘাতের চিহ্নও দেখতে পায়না। চিকিসার আগেই ডাক্তার জেনে নিতে চায় চিকিৎসাপ্রার্থীর দলীয় পরিচয়। শিক্ষক রাজনৈতিক দলের নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি করে, কাজে ফাকি দেয়, যে জিনিষ সে নিজে বোঝেনা সেই জিনিষের সে পণ্ডিত সাজে, পক্ষপাতিত্ব করে, কাউকে বেশি নম্বর দেয়, কাউকে কম দেয়, তার কাছে কোচিং করতে ছলে, বলে, কৌশলে বাধ্য করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ফি থেকে বেশী দিতে ছাত্রদের বাধ্য করে। ব্যবসায়ীরা মজুতদারি ও মুনাফাখুরি করে, কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়, ভেজাল দেয়, ফাঁক পেলে নিম্নমানের জিনিষ মিশিয়ে দেয়,খাদ্যদ্রব্যে বিষ মেশায়। ওঁত পেতে থাকে রমযান মাসের অপেক্ষায়। জিনিষপত্রের দাম বাড়ানোর এটাই তাদের কাছে সবচেয়ে উপযুক্ত সুযোগ। অন্তরের জঘন্যতম রূপটি তুলে ধরার জন্য ইসলামের এই মহান মাসটাই তাদের বিবেচনায় সর্বোত্তম সময়। ব্যবসায়ীদের এই চরিত্র সমাজের কাছে একান্ত স্বাভাবিক বলে গণ্য হয়ে গেছে। কয়েক কোটি লোক হয় ৬ সরাসরি জড়িত চোরাচালানির সাথে অথবা তার সুবিধাভোগী আমাদের এই সমাজে।
মিথ্যা ও ওয়াদা ভঙ্গ যেন স্বাভাবিক নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের মতই হয়ে গেছে। মিথ্যা অভিযোগকারী ও মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীর কোন অভাবই নেই আমাদের। দৈনন্দিন জীবনের সাধারন লেনদেন থেকে গ্রাম্য সালিস বা কোর্টের মামলামোকদ্দমা সবখানেই তার অজস্র প্রমান মেলে। নীতিবোধ বা আত্মসম্মানবোধ তো একটা উটকো ঝামেলা জীবনে আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান থেকে যতদূর চোখ যায় সর্বত্রই এই জিনিষটির ভয়ানক আকাল। নীতিবোধসম্পন্ন ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপন করার কোন শিক্ষা বা চর্চা নেই আমাদের কোথাও, না পরিবারে, না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্গতির কথা বলে কি শেষ করা যাবে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একেবারে কম নেই আমাদের। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত না থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলায়ের যেন কোণ শেষ নেই। বিচিত্র নামে নতুন নতুন আরো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল হয়েই চলেছে। তবে সবচেয়ে বেশি যা আছে তা হোল ‘কোচিং সেন্টার’। ছোটবড় যেকোণ শহরে যে দিকে তাকানো যাক দেখা যাবে কোচিং সেন্টার। আর আছে বেশুমার ‘প্রাইভেট টিউটর’। কোচিং সেন্টারের আর প্রাইভেট টিউটরদের ছড়াছড়ি থেকে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর উল্লাস দেখে মনে হতে পারে বাংলাদেশে লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। দেশের মানুষ লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু বোঝেনা, লেখাপড়ার জন্য তারা পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু লেখাপড়ার ভেতরের খবর কি? পৃথিবীর প্রথম পাচ হাজার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটিও নেই বাংলাদেশে। শিক্ষিত লোকদের মধ্যে কোণ বিষয়ে পাচ মিনিট গুছিয়ে কথা বলার বা দু পৃষ্ঠা গুছিয়ে লেখার মানুষ পাওয়াই তো ভার। একেবারে সামান্য দু’একজন বাদে বিশ্ব বিদ্যালের প্রবীণ অধ্যাপক থেকে উচ্চতম আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবীরাও এর ব্যতিক্রম নন। তা হোলে অবস্থাটা কি দাঁড়াল আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার?
ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতা, অনাচার, মারামারি ও খুনখারাবিতে সমাজ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যেই ছাত্রদের হাতে দেখতে পাওয়া যায় বাঁশ, রড, রামদা ও পিস্তল। কি প্রবল তেজের সাথে ও উন্মত্ত আনন্দে এসবের সদ্ব্যবহার করে তারা! খুব কম মানুষই আছে এখন সমাজে যারা এসবকে অস্বাভাবিক মনে করে বা এসব দেখে ক্ষুব্ধ হয়। সংঘবদ্ধ শক্তিতে ছাত্ররা যেটাই করবে তা সে যতো জঘন্যই হোক না কেন সেটাই আমাদের সাধারন জনমানসে জায়েজ হয়ে গেছে। ছোট ছেলেপিলেরা তো একটু আধটু দুষ্টুমি করতেই পারে। তা আর এমন কি ব্যপার! তাদের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরন করার কোণ প্রশ্নই উঠতে পারেনা। ভাবটা এমনই আমাদের। একই সাথে আবার এই সব ছোট ছেলেপিলেরা সবাই বড়ো বড়ো বিষয়ে মতামত দেবার ও ভোট দিয়ে দেশ ও সমাজের ভাগ্য নির্ধারণ করার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত আমাদের কাছে।
৭
দু’ একটা ব্যতিক্রম বাদে নিচু থেকে উচু পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের একটাই কাজ এখন। তা হচ্ছে তাবৎ অন্যায় ও অপকর্মের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করা। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা হচ্ছে সবচেয়ে জঘন্য। একেবারে নিকৃষ্ট শ্রেণীর দলবাজ ও ভয়ানক বেশরম কোনো মানুষ ছাড়া কারো পক্ষে ভাইসচ্যন্সেলর বা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়া ও সে পদে টিকে থাকা এখন আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ভাইসচ্যন্সেলর পদের জন্য আগ্রহী কোনো শিক্ষককে অন্তত দশ পনেরো বছর আগে থেকেই সমস্ত নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে একেবারে নির্লজ্জ হয়ে কোমর বেধে মাঠে নামতে হয় এ পদ অর্জনের জন্য। এ পদে বসার জন্য তাকে যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে অন্যায় ও অপকর্মের কাছে নিজেকে বন্দী করে ফেলতে এবং নিজের চরিত্রকে কলুষিত করতে হয় তাতে এ পদে বসার পর ভাল কিছু করার তার আর কোনো অভ্যাস বা সুযোগ থাকেনা। পদে বসে তখন কেবল তাকে অতীতের দায় মিটিয়ে যেতে এবং নতুন, নতুন আরো অনেক দায় সৃষ্টি করে যেতে হয়।
অদ্ভুত এক মানবগোষ্ঠী আমরা। অস্থির, বিশৃঙ্খল ও এলোমেলো স্বভাব আমাদের। হৈ হট্টগোল ও হাঙ্গামা আমাদের খুব প্রিয়। চিৎকার ও চেঁচামেচি আমাদের স্বাভাবিক আচরন বলে গন্য। ঝগড়া আর শান্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার মধ্যেও পার্থক্য অনেক সময় বোঝা যায়না। অকারনে শোরগোল করি। তাতে কার কি অসুবিধা হোল তার আমরা ধার ধারিনা। কথায় কথায় আমরা তর্ক বাধাই, হাতাহাতি ও মারামারি করি। ঝগড়া বাধলে আমাদের আর মুখের বাঁধন থাকেনা। খুব সহজেই মারাত্মক কর্কশ ও ভয়ানক সব অশ্লীল কথা মুখে চলে আসে আমাদের। চিন্তা ভাবনা করে গুছিয়ে গাছিয়ে দায়িত্বের সাথে কথা বলতে আমরা জানিনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়ো বড়ো অধ্যাপকদের অনেকেই পর্যন্ত জানেনা। আন্দাজ অনুমানে কথা বলি। মনে হয় যেন সব নিজের চোখে দেখা ও কানে দেখা। এভাবে কথা বলায় যদি কারো কোণ ক্ষতি হয়ে যায় তো যাক। কেউ কাউকে বিশ্বাস করিনা। দিনরাত কেবল অন্যদের সন্দেহ করতে ও তাদের দোষ খুজতে থাকি। ঈর্ষা আমাদের কুরেকুরে খায়। কারো ভাল হলে কষ্ট পাই। আমাদের দয়ামায়া ও বিবেকের পরিধি সামান্য গুটিকয়েক নিজের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভাল কাজে আগ্রহ আমাদের আসে ও যায়, কিন্তু হিংসা, বিদ্বেষ ও বিবাদ আমাদের মন থেকে যেতেই চায়না। নৈতিক সাহসের নিদারুন ঘাটতি আমাদের। নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে কেবলমাত্র ন্যায়কে ন্যায় ভেবে এর পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়াবার মানুষ খুজে পাওয়া কঠিন আমাদের মধ্যে। আমরা কাঁদি খুব সহজে, কিন্তু ভয়ংকর নিষ্ঠুর হতেও আমাদের সময় লাগেনা। ভুল বা অন্যায় করে আমরা লজ্জা পাইনা। ধরা পড়লে দাত বের করে হাসতেও পারি। দায়িত্বশীল ও মর্যাদাসম্পন্ন আচরণ কাকে বলে তা আমাদের বড়ো হোক, ছোট হোক খুব কম মানুষেরই জানা আছে।
তবে সবচেয়ে বেদনার ও উদ্বেগের কথা হচ্ছে অদ্ভুত ও নির্মম এই সত্যটি। কোনো অন্যায়, অসংগত, অশালীন ও গর্হিত আচরণই আর নেই যা আজ আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়নি। মাথায় যার কোন ছিট আছে সেই কেবল এসব নিয়ে ভাবে বা বিচলিত হয়। এই হয়ে পড়েছে সামগ্রিকভাবে আমাদের চিন্তা ও বিবেকের গঠন।
ভাল মানুষ যে দু’চার জন নেই তা নয়। তবে তাদের সংখ্যা এতো ক্ষুদ্র যে তাদের দেখতে চাইলে বহু খোঁজাখুঁজি করতে হয়। ত’ছাড়া তারা এতো ম্রিয়মান ও কোণঠাসা যে তাদের অবস্থা বিলুপ্তপ্রায় কোণ প্রজাতির মতো। সমাজের কর্মকাণ্ডে ও মানুষের সামগ্রিক জীবনে কোণ প্রভাবই নেই তাদের।
(৩)
ইসলামের দুর্গতিও কি কম ঘটেছে আমাদের হাতে? ক’জন মুসলিমের মধ্যে হালাল-হারামের বাছবিচার আছে? ঘুস খেতে কোণ আসুবিধা নেই। লজ্জার তো কোণ প্রশ্নই উঠে না। সুদের বাষ্পের মধ্যে তো আমরা ডুবেই আছি। সুদের ও ঘুষের অর্থে হজ্জ করে আসতেই বা কি কোণ দ্বিধা বা লজ্জা আছে? ক’জন পুরুষ আছে যারা সম্পত্তিতে মেয়েদের পাওনা ঠিকমত বুঝে দেয়? ক’জন মানুষ তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করে, কাজে কোনরকম ফাকি দেয়না? উৎপাদন থেকে বিক্রি পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্যে বিষ এবং অন্যান্য জিনিষে ভেজাল দেওয়ার কাজে নিশ্চয়ই মুসলিম সমাজের কয়েক কোটি মানুষ জড়িত। অত্যাচার করতে ও অকারনে আরেকজনের ক্ষতি করতে ক’জন মুসলিমের বুক কাপে? আরেক জনের জান, মাল ও ইজ্জত ক’জন মুসলিমের হাতে নিরাপদ? ক’জন শিক্ষিত মানুষ পাওয়া যাবে যাদের শিক্ষাসনদে বা দলিলদস্তাবেজে জন্মের তারিখ ঠিক আছে? ক’জন মানুষ আছে যার কাছে আমানত এবং অন্যের মান-ইজ্জত নিরাপদ? এদেশের মুসলিমদের হাতে কি মসজিদ নিরাপদ? তাহলে মসজিদ এতো তালাবন্ধ থাকে কেন বা মসজিদে জুতা নিয়ে এতো পেরেশান হতে হয় কেন?
মসজিদে গিয়েও আমরা মাথা ঠিক রাখতে পারিনা। ছোট ছোট ছেলেপিলেদের যেভাবে ধমকানো হয় কারনে, অকারনে তাতে এদের অনেকেরই চিরকালের মতো মাসজিদে যাবার আগ্রহ হারিয়ে যায়। কারো মোবাইল ফোন বেজে উঠলে তো আর কথাই নেই। যে যতভাবে পারে তাকে সকলের সামনে অপদস্থ করবেই। মাথা যেন আমাদের সবসময়ই গরম থাকে, ঠাণ্ডাই হতে চায়না একেবারে। ভাষা যেন আমাদের নম্র ও কোমল হতে চায়না। মসজিদ কমিটির সভায় হৈচৈ, ঝগড়াঝাঁটি, ১০
হাতাহাতি বা এমনকি মারামারি কোণ আশ্চর্য হবার মতো ব্যাপার নয়। মসজিদে ঢুকিই গরম মাথা নিয়ে, দুর্বিনীতভাবে, বেরিয়ে আসি আরো দুর্বিনীতভাবে এবং মাথা আরো গরম করে।
এদেশে এতো মসজিদ, এতো আজান, ঈদ নিয়ে এতো উন্মাদনা, কিন্তু মানুষের আচার-আচরণে ইসলামের প্রভাব এতো ক্ষীণ যে তা দেখতে চাইলে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগবে। আমাদের ওয়াদা, লেনদেন ও কাজকর্মের দিকে তাকালে তার মধ্যে ইসলামের কোণ চিন্ন খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। একটু শিক্ষিত,সম্পদশালী ও বড় পদওয়ালা মানুষ হলে নামাজের কাতারে ঠিক যেভাবে একের সাথে অপরের সাথে মিলে দাড়াবার কথা সেভাবে দাড়াতে চায়না। সালামের যে কি দুর্গতি ঘটেছে আমাদের হাতে! সালাম দেবার আদব খুব কম লোকেরই আছে। সালামের জবাব দেবার আদব আছে তারও চেয়ে আরো অনেক অনেক কম লোকের। তাছাড়া আমরা ঠিক করে নিয়েছি সালাম দেবে নিচু অবস্থানের মানুষেরা উচু উচু অবস্থানের মানুষদের। মানুষের মধ্যে সৌহার্দ, সমমর্মীতা ও শান্তি রচনা ও সংরক্ষন করার জন্য ইসলামের দেওয়া পরশমণির মতো সালামের এই মহামুল্যবান রত্নটি আমাদের হাতে একেবারেই নোংরা ও কদর্য রুপ লাভ করেছে। রমযান হয়ে গেছে আপরিমিত ভোগ আর অপচয়ের মাস। ঈদ হয়েছে শয়তানকে খুশি করার এবং আল্লাহতা’আলার নাফরমানীর সবচেয়ে বড়ো উপলক্ষ। একসাথে শান্তিতে মিলেমিশে থাকার জন্য ইসলাম যেসব ‘আদব’ শিক্ষা দেয় তার কতোটুকু খুজে পাওয়া যায় এদেশের মুসলিমদের জীবনে? সেসব আদবের সামান্য একটা ভগ্নাংশও যদি থাকত আমাদের মধ্যে তা’হলে এতো বিশৃঙ্খলা, অনাচার, অত্যাচার, ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও অশান্তি হোত না আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে। ইসলামের মধ্যে নিহিত কল্যান আমরা খুব কমই গ্রহন করতে পেরেছি। ধরে রাখতে পেরেছি আরো কম। বাস্তব সত্য হচ্ছে ইসলাম আমাদের পথ দেখায় না। আমরাই ইসলামকে পথ দেখাই। সুবিধামতো একে ব্যবহার করি। তারপর আবার আস্তাকুড়ে ছুড়ে দেই চরম অবজ্ঞা ও ঘৃণায়। মহা বিড়ম্বিত ইয়াতিম ভিখারির মতো ইসলাম আমদের পিছেপিছে কাঁতর মিনতি করতে করতে ছুটতে থাকে।
আমাদের ইসলামি চেতনা অধঃপতনের কোন স্তরে গিয়ে ঠেকেছে তা বোঝা যায় আমরা যখন মানুষকে নাম ধরে ডাকি। মানুষকে আমরা ‘রব’, ‘রহমান’ ও এই ধরনের আরো নামে নিশ্চিন্তে ডাকি। একবারও ভাবি না কাজটা কি জঘন্য হচ্ছে! এসব যে আল্লাহতা’আলার নাম এবং মানুষকে যে এভাবে ডাকা যায়না এই বোধ এদেশের মুসলিমরা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। মানুষকে ‘নবী’ ‘রসুল’ বা ‘আল-আমীন’ নামে ডাকতেও আমাদের বাধেনা। যাকে তাকে আমরা ‘শহীদ’ আখ্যা দেই। নিজের ধর্মকে যে এভাবে কতো তুচ্ছ বানিয়ে ফেলা হয় এ আক্কেল আমাদের হারিয়ে গেছে।
ইসলামকে যে আমরা কি দুর্দশাগ্রস্থ ইয়াতিম বানিয়ে দিয়েছি তা সবচেয়ে ভাল প্রমান আমাদের মাদ্রাসাগুলি। সেখানে পড়ে কারা? সমাজের সবচেয়ে দুর্বল গোষ্ঠীর সন্তানেরা বা একেবারে নিস্ব এতিমেরা নয় কি? মসজিদের ইমাম সাহেবদের অবস্থাও বড়ো করুণ। টিকে থাকতে হলে মসজিদ পরিচালকদের খোশামুদি করাই লাগবে এবং বেতনের সাথে মাঝেমধ্যে ধমকও খেতে হবে। মুয়াজ্জিন সাহেবদের মর্যাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে অচ্ছুৎ শ্রেণীর মতো। রসুলুল্লাহ (সঃ ) ভবিষ্যৎবাণীকে আমরা যথার্থভাবে বাস্তব রুপ দান করেছি। আলিমদের বিয়ে করার জন্য খুব কম মানুষই মেয়ে দিতে চায়। মুখে দাড়ি থাকলেই মেয়ে পাওয়া কঠিন হয়ে দারায়।
মাদ্রাসা যেখান থেকে মুসলিম ইসলামের যথার্থ জ্ঞান হাসিল করা হবে, যেখানে যেখানে ইমান ও আমলের সঠিক চর্চা হবে সেই মাদ্রাসাগুলিকে আমরা এতো দুর্বল ও জরাজীর্ণ বানিয়ে ছেড়েছি যে সেখান আত্মবিশ্বাসী, সৃজনশীল ও উদ্যোগী মানুষ বেরিয়ে এসে যোগ্যতার সাথে অন্যদের নেতৃত্ব দেবে এমন আশাই করা যায়না। অথচ একটি মুসলিম সমাজে আলিমদেরই নেতৃত্ব দেবার কথা রয়েছে ইসলামে। আসলে ইসলাম নিয়ে আমরা বড়ো বিপাকে পড়ে গেছি। না পারছি গিলতে, না পারছি উগরে ফেলে দিতে। আমাদের এই বিপত্তির কথা স্বীকারও করতে চাইনা আমরা। এ এক ভয়ানক দুর্দশাগ্রস্ত মানসিকতা।
মূর্তিপূজা আমরা করিনা। কিন্তু অন্তরের মধ্যে যে অসংখ মূর্তি আমরা খাড়া করে রেখেছি সেসবের কি হবে? আমরা মানুষ পূজা করি। মানুষের বন্দনা, তোয়াজ ও তোষামোদ আমরা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাই যার পর আল্লাহতা’আর আর কোণ গুরুত্ত্ব ও মর্যাদা অবশিষ্ট থাকেনা। পদ, পদবী, অর্থ, বিত্ত, প্রভাব, প্রতিপত্তির পুজা করি। এসবের কাছে মাথা নত করে রাখি। আর এ জন্যই তো এসব যাদের নেই তাদের আমরা তুচ্ছতাছছিল্য করি। মনের মধ্যের এই মূর্তিগুলির কি হবে? বাইরের যেসব মূর্তি দেখা যায় সেসবের চেয়ে মনের মধ্যের এই মূর্তিগুলি তো আরো বিপজ্জনক। অন্তরের এই মূর্তিগুলি ভেংগে ফেলা মোটেই সহজ নয়।
(৪)
সব কিছু বিচার করলে একটা কথাই কেবল খাটে বাংলাদেশের মুসলিমদের সমন্ধে। একটা ভয়ংকর অধঃপতিত মুসলিম সমাজ আমাদের। একেবারে পচে গেছি আমরা। কিছুই বাকি নেই পচতে আমাদের। খুব গভীর সে পচন। আমাদের এতো যে সমস্যা তার প্রায় সবকিছুর মুলেই এই পচন। রাষ্ট্র যে আমাদের এতো খারাপ তা আমাদের সর্বাঙ্গীণ পচনেরই ফল। রাজনীতি যে এতো কলুষিত তা আমদের সামগ্রিক জীবনের কলুষতারই প্রতিফলন। আমাদের সামগ্রিক জীবনের জঘন্যতম রূপটিই প্রবল আকারে ছাপিয়ে উঠে আমাদের রাজনীতিতে। এতো যে অনাচার ও অকল্যাণ আমাদের চারিদিকে তার জন্য দায়ী সকলে মিলে আমরাই। আমাদের প্রধান সমস্যা আর কিছু নয়, সমস্যা আমরাই। আমরাই সর্বাঙ্গে মারাত্মকভাবে পচে গেছি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
তবে মুল পচনটা আমাদের স্বত্মার একেবারে গভীরতম কেন্দ্রবিদুতে। পচন আমাদের আত্মায়। বাইরের যতো বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, অনাচার, অবিচার, কদর্যতা, হানাহানি ও সংঘাত সব সেই মূল পচন থেকেই জন্ম নিয়েছে। সেখানকার পচন যতো গভীর হয়েছে আমাদের চিন্তা, বিচার, বিবেচনা ও বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের পচন ততো বিস্তৃত হয়েছে ও কুৎসিত রুপ ধারন করেছে। আমাদের মানসিক ও বাহ্যিক জীবনের সবকিছুতেই সেই মুল পচনেরই লক্ষণ আজ প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের আত্মার এই পচনের চিকিৎসা না হলে কোণ কিছুই ভাল হবেনা। দিন দিন আমাদের অবস্থা শুধু খারাবই হতে থাকবে। পচতে পচতে আমরা কেবল দুর্গন্ধই ছড়াব না, আমরা শেষ হয়ে যাব। বড়ো করুনভাবেই শেষ হয়ে যাব। বেশি বাকি তার হয়তো আর নেই।
রাজনীতিবিদরা এ পচন ঠেকাতে পারবেনা। কারন তারা নিজেরাই তো পচনে, পচনে জর্জরিত। নিজেদের চিকিৎসার প্রোয়জনীয়তা নিয়েও তাদের কোণ দুশ্চিন্তা নেই। থাকবে কিভাবে? তারা তো তাদের পচনের কথা স্বীকারই করেনা। অনেকের তা বোঝার মতো বোধও নেই। নিজেদের পচনের কথা স্বীকার করলে তো তাদের রাজনীতির দোকান বন্ধ হয়ে যাবে তক্ষু্নি। তারা উদগ্রীব কিভাবে তাদের নিজেদের পচন অন্যদের মধ্যেও অতি দ্রুত তারা ছড়িয়ে দেবে সে জন্য। অন্যেরা পচে গেলে তাদেরই লাভ। তখন তাদের ব্যবহার করতে সুবিধা। পচনের মধ্যেই রয়েছে রজনীতিবিদদের মুল্যবান পুজি। প্রতিদ্বন্দ্বিতামুলক রাজনীতিতে ব্যক্তির লক্ষ্য হয় অন্যকে পিছনে ঠেলে ফেলে নিজেকে সামনে নিয়ে আসা, আর দলের লক্ষ্য হয় অন্যদের সরিয়ে নিজের দলকে চালকের আসনে বসানো। রাজনীতির এই অমোঘ চরিত্র ভাল মানুষকেও ভাল থাকতে দেয়না। রাজনীতি কম হোক, বেশি হোক পচাবেই।
আমাদের আত্মার যে পচন তার কোন রাজনৈতিক চিকিৎসা নেই। আছে কেবল আধ্যাত্মিক চিকিৎসা। আধ্যাত্মিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও আছে। বহু প্রাচীন ও পরীক্ষিৎ সে ব্যবস্থা। রাজনীতিবিদরা এই চিকিৎসার সন্ধান জানেনা। তাদের কোণ চালাকি বা কলাকৌশল এখানে কোণ কাজে লাগেনা। রাজনীতির উপর আমাদের অপরিসীম ভরসা ও নির্ভরতা আমাদের অন্তরের মহা পচনের আরো একটি বড়ো লক্ষণ।
আমাদের আত্মা সুস্থ ও সবল না হওয়া পর্যন্ত কিছুই যে আমাদের ঠিক হবেনা সে কথাটাই আল্লাহতা’আলা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন কুরআ’ন মাজীদে এই ভাবে - “নিশ্চয়ই আল্লাহ কোণ জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তন করেননা যতক্ষণ না তারা নিজেদের অন্তরের অবস্থার পরিবর্তন করে।” ( আল-রদ, ১৩ঃ ১১ ) ও “ আল্লাহ কখনো কোণ জনগোষ্ঠীর উপর থেকে তার রহমত তুলে নেন না যতক্ষণ না তারা তারা তাদের অন্তরের অবস্থার পরিবর্তন করে ফেলে। ( ৮ঃ ৫৩ )। অন্তরই হোল আসল জায়গা যেটাকে ঠিক রাখতে পারলে সবই ঠিক থাকবে। সেখানে ঠিক না থাকলে জীবনের কোথাও কিছু ঠিক থাকার উপায় নেই। এদেশের মুসলিমদের সামনে এখন তাই এটাই আসল প্রশ্ন – আমরা কি অন্ধ, বধির ও চিন্তাভাবনাহীন হয়ে থেকে অশান্তি ও অস্থিরতার মধ্যে পচতে পচতে ধ্বংস হয়ে যাব, না কি আত্মার যথার্থ সেই চিকিৎসা গ্রহন করে নিজেদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে বাচাব?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন