সাপ্তাহিকী
|
সাইফ বরকতুল্লাহ
|
|
বাংলাদেশে মিডিয়ার রাজনীতি (৩য় পর্ব)
23 Jun, 2013
এক.
২০০৭ সাল। সময়টা তখন ফখরুদ্দিন এর তত্ত্বাবধায়ক আমল। আমি সেই সময় আজিজ মার্কেটস্থ সাপ্তাহিক আগামীর সাথে পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন আরজু আহমেদ, প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন মোস্তফা কামাল (সেই সময় প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন, বর্তমানে দৈনিক কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক তিনি )।
দুই.
পত্রিকাটি অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। বিশেষ করে প্রত্যেক সপ্তাহে দেশের চলমান রাজনৈতিক বিষয়ের উপর বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনের জন্য সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। নিয়মিত লিখতেন বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, ডেইলি স্টারের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান, এপি বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান ফরিদ আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, নোবেল বিজয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনুস, অসিম সাহা, রণজিৎ বিশ্বাস, রম্য লেখক আতাউর রহমান, মুহম্মদ নুরুল হুদা, সমুদ্র গুপ্ত এবং আরো অনেক জনপ্রিয় লেখক। ২০০৭ সালের ০৫-১১ জুলাই সংখ্যাটি তখন বের হলো। পরের সপ্তাহে মিটিং এর সময় হঠাৎ কামাল ভাই জানালেন আগামীর সাথে আর বের করা সম্ভব হচ্ছেনা। কারণ জানতে চাইলে উনি শুধু এতটুকু বলে আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, সাইফ, সরকারের প্রচন্ড চাপে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আমরা একঝাক তরুণ সেদিন প্রচন্ড বিষণ্ণ মন নিয়ে চলে এসেছিলাম বাসায়।
তিন.
২৭ এপ্রিল ২০১০, শামীম মাহবুব যখন চ্যানেল ওয়ান বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছিল, তখন আমি একই বেদনা অনুভব করেছিলাম। আমার স্মৃতিতে তখন স্মরণ হচ্ছিল, যায়যায়দিন বন্ধের পর শফিক রেহমানের বিমর্ষ চেহারা। শামসুদ্দিন হায়দার ডালিমের কান্না জড়ানো কণ্ঠে যখন একুশে টেলিভিশনের বন্ধের ঘোষণাটি এলো, তখন কষ্টের যন্ত্রণায় দাহ হয়েছিল প্রতিটি মানুষ, আপামর দর্শক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিএসবি বন্ধ হলো। সাথে সাথে একদল উচ্ছ্বল তারুণ্যের কর্ম উদ্দীপনা মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। একুশে টেলিভিশন বন্ধ করা হয়েছিল টেন্ডার প্রক্রিয়া অস্বচ্ছতার অভিযোগে। সিএসবি বন্ধ হয়েছিল লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করা হয়েছিল অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মালিকানার হাত বদলের অভিযোগে।
চার.
আমরা সবাই জানি, মিডিয়া বন্ধের যে কারণ দেখানো হয় সেটা হলো উপরের কথা। ভেতরের কথা হলো অন্য। যা অনভিপ্রেত, দুর্ভাগ্যজনক। গণতন্ত্রের জন্য বহুমতের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ জরুরি। আমাদের রাজনৈতিক মত-পার্থক্য থাকতেই পারে। আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে আরেকজনের বিশ্বাস নাও মিলতে পারে। কিন্তু মিডিয়া বন্ধ করে হাজার হাজার সংবাদকর্মীকে পথে বসিয়ে লাভ কী? তাছাড়া এর মাধ্যমে মিডিয়ার স্বকীয়তা এবং স্বাধীন বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
পাঁচ.
দেশে এখন মিডিয়ার জোয়ার বইছে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়া, সোস্যাল মিডিয়া- সর্বত্র মিডিয়া ও মিডিয়া-কর্মীদের সরব উপস্থিতি। গেল ১১ই মে, ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ স্মরণ বলেছেন, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে মিডিয়ার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে। এই দেশে এখন প্রচুর টেলিভিশন চ্যানেল, জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ও দেশের জন্য অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। এদেশের মিডিয়া কর্মীদের উন্নয়নে আমরা কাজ করতে চাই। চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউসে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময়কালে এসব কথা বলেন তিনি। [ সূত্র : ১১.০৫.২০১৩, দেশের খবর ২৪.কম/ সিলেটের আলাপ ]।
বাংলাদেশে মিডিয়ার জৌলুস, চাকচিক্য, ব্যপকতা আর রমরমা ভাব দিন দিন বাড়ছেই। মিডিয়াকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। বলা হয়, দেশের মিডিয়া যত শক্তিশালী হয়, সেদেশের গণতন্ত্রের ভিত তত মজবুত হয়। কিন্তু বর্তমানে দেশের মিডিয়াগুলো রাষ্ট্র, সমাজ, জাতিকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে, কিংবা দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে- তা এখন ভাববার সময় এসেছে।
ছয়.
মিডিয়া আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক চর্চাগুলোর ভিতর মধ্যস্ততায় লিপ্ত আছে। ব্যক্তিক ও সামষ্টিক পরিচয় নিমার্ণ করছে। আমাদের জীবনযাত্রার গতি নির্ধারণ করে দিচ্ছে মিডিয়া। গত দুই দশকে বাংলাদেশে মিডিয়া এবং এর মালিকানার ধরণ পুরোপুরি বদলে গেছে। রেডিও, টিভি বা সংবাদপত্রের মালিক হচ্ছে কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা গ্রুপ অব কোম্পানি। কোন মহৎ উদ্দেশ্যে মহান এ পেশায় অবদান রাখা বা সমাজের উন্নয়ন, সমাজের মানুষ গুলোর উন্নয়নের চিন্তায় নয় বরং মুনাফা অর্জন, রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ কিংবা কোম্পানির অন্য ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল। গণমাধ্যম নিজেই পরিণত হচ্ছে গ্রুপ অব কোম্পানিতে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও ব্লগার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন