সাপ্তাহিকী
|
শেখ আখতার উল ইসলাম
|
|
লক্ষ্য ও আদর্শহীন বাজেট
23 Jun, 2013
বাংলাদেশ যার জন্ম হয়েছিল এক সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম- আর এক সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। যে আন্দোলন সংগ্রামের মূল লক্ষ্যই ছিল শোষন-বঞ্চনা হীন এক সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। যে স্বপ্নের সোনারবাংলা প্রতিষ্ঠার অন্যতম মহান স্থপতি বঙ্গতাজ মরহুম তাজ উদ্দিন আহমদ ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরদ্বয়ের বাজেট উপস্থাপনায় বলেছিলেন- “ আমি গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি সেই সব অগণিত শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা উড্ডীন হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ধুলিকণার সাথে জড়িয়ে আছে তাদের পূণ্য স্মৃতি। অন্যায়, শোষণ ও দাসত্বের বিরুদ্ধে তাদের অবিরাম সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে আমরা যেন সব সময় সচেষ্ট থাকি।” তিনি বলেছিলেন-“ সমাজতান্ত্রিক শোষনহীন সমাজব্যবস্থার অন্যতম দিক হল সম্পদের সুষম বন্টন ও বর্ধন। অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের স্তরে স্বভাবতই সম্পদ বর্ধনের উপর গুরুত্ব অরোপিত হয়। সম্পদ বর্ধনের সাথে সুষম বন্টনের সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। সরকারী কার্যক্রমে এর প্রতিফলন ঘঠেছে, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্টান সমূহের রাষ্ট্রয়াত্তকরণ, উচ্চ বেতনভুক কর্মচারীদের বেতন হ্রাস এবং বিভিন্ন কর - অব্যাহতি ও কর সমন্বয়মূলক কার্যক্রমে। বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সারা দেশের সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মচারীদের বেতনের হার সুসামঞ্জস্য করার উদ্দেশ্যে সরকার একটি বেতন কমিশন গঠন করতে যাচ্ছেন। আগে এখানে মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার দেশের অধিকাংশ শিল্প, ব্যাংক ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিল এখন সেখানে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসাধারনের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” তিনি সমাজকে কলুষমুক্ত করার সার্বিক অভিযানে চোরাকারবার, মজুতদারী, মুনাফাখোরীর বিরুদ্ধে ও দুর্নীতি নিরোধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ও আশ্বাস দিয়েছিলেন। তার পর ইতিহাসের গতি পাল্টে যায়। ইতিহাসের নির্মম পরিহাসে প্রথমে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু থেকে তার পরে নিষ্ঠুর-নির্মমভাবে এ পৃথিবী থেকে তাকে বিদায় নিতে হয়। ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘুরে যায়। শোষণহীন অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থা থমকে দাড়ায়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উপর থেকে জনগণের মালিকানা ছিনতাই হয়ে যায়। হারিয়ে যায় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্জিত জনগণের মালিকানা। হারিয়ে যায় সোনার বাংলার স্বপ্ন। পথ হারায় শোষিতের বাজেট- শুরু হয় ক্রীতদাসের অর্থনীতি।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থমন্ত্রী জনাব এ, এম, এ, মুহিত যখন ২০১৩-২০১৪ সনের সোয়া দুই লাখ কোটি টাকার বাজেট মহান জাতীয সংসদে উপস্থাপন করছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে একটি বেসরকারী টেলিভিশনে একজন রিক্সাচালক প্রতিবেদকের কাছে আসন্ন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে মাত্র ৫০০ টাকায় ভোট বিক্রির কাহিনী তুলে ধরছিল। কাকতালীয় ভাবে দু‘টি ঘটনা ঘরে বসে দূরদর্শনে দেখার পর নিজের অজান্তেই মনের পর্দায় ভেসে উঠে হতভাগ্য জাতির পিতার অমোঘ সেই ঘোষণা-“ বিশ্ব আজ শোষক আর শোষিত এই দুই ভাগে বিভক্ত, আমি শোষিতের দলে।” বজ্র কন্ঠের সে ঘোষণা ও চিরতরে হারিয়ে যায় তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণার সাথে সাথে। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে চলতি উচ্চাভিলাষী বাজেট যখন মহান সংসদে উপস্থাপিত হয় তখন তারই সুযোগ্যা কন্যা আজকের এ মহান সংসদের নেত্রী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী । ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস বাংলাদেশের জন্ম পর্বে ঘোষিত শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সে প্রত্যয় চলতি বাজেটের কোথাও একটি বারের জন্য ও উকি দিয়ে যায়নি। স্বাধীনতার দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বৎসর পরে ও অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের কোন নিশ্চয়তা বর্তমান বাজেটেও নেই। নেই সাধারণ শোষিত-বঞ্চিত মানুষের আশার কোন প্রতিফলন। অতিতের ন্যায় চলতি বাজেট ও গতানুগতিক, অনুৎপাদনশীল, পরনির্ভরশীল, উচ্চাভিলাসী।
২
বাজেট একটি দেশের জনগণের জন্য সরকারের পরিকল্পনা ও আয়-ব্যয়ের বাৎসরিক হিসাব। বাংলাদেশে বিয়াল্লিশ বৎসরে একচল্লিশটি (স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ বৎসরের বাজেট একত্রে ঘোষিত হয়।) বাজেট ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষের কাঙ্খিত উন্নয়ন এখনও সাধিত হয়নি। কৃষি আর শ্রম নির্ভর অর্থনীতির ফলে বৃহৎ জনগোষ্ঠি এখনও দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে। পক্ষান্তরে সস্তা শ্রম কিনে নিয়ে মধ্যসত্বভোগী -ফোড়িয়া শ্রেণী বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে। ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। মুষ্টিমেয় মানুষের সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতার যুপকাষ্টে বলি হয়ে বৃহৎ সংখ্যক মানুষ আজ এ যুগের কৃতদাসে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা লক্ষ্য ও আদর্শহীনতাকে এর প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ অর্থনীতিবিদ সমিতি কর্তৃক ১৯৭৮ সনের ১৯ শে নভেম্বর আয়োজিত এক সেমিনারে বাঙ্গালী জাতি সত্ত্বার অভ্যূদ্বয়ের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল এম, এ, জি, ওসমানী -এই শতাব্দীর শেষে আমরা কোথায় যেতে ইচ্ছুক এবং কিভাবে? অর্থাৎ এই শতাব্দীর মধ্যে আমরা কী ধরনের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় উত্তরণ প্রক্রিয়ার রূপ কি হবে? শীর্ষক প্রবন্ধে দ্ব্যার্থহীন ভাবে লক্ষ্য রূপে ঘোষণা করেছিলেন- “ নির্যাতন, ও শোষণমুক্ত এবং সাম্যভিত্তিক অত্মনির্ভরশীল সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক প্রগতি ও মর্যাদা রক্ষা করা।” বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা আমাদের অর্থনীতির এই আদর্শহীনতা ও লক্ষ্যহীনতাকেই মূলত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যর্থতার কারণ রূপে চিহিৃত করেছেন- শতকরা আশিভাগ কিংবা তদোর্ধ অধিবাসীর জীবিকার প্রধান উপায় চাষাবাস। কৃষিকে শিল্প থেকে পৃথকীকরণ। দেশজ কাঁচামাল ভিত্তিক শিল্পের গতি পশ্চাৎমুখি হতে হতে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সেই সঙ্গে কৃষি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও মধ্যসত্বভোগী দালাল, ফোড়িয়া গোষ্ঠির উদ্ভব এবং দৌরাত্ব। আমদানী নির্ভর ব্যবসাজীবির উদ্ভব এবং আবাসন ব্যবসায় ব্যাংক লুন্ঠন ও কালোটাকার প্রভাব। দেশজ তুলা জাত বস্ত্র শিল্পের কবরের উপর আমদানী নির্ভর পোশাক শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে মধ্যসত্বভোগি লুঠেরা গোষ্ঠির অত্মপ্রকাশ। ব্যাংক লুন্ঠন আর দরিদ্র, অসহায়, শ্রমজীবি মানুষের শ্রম লুন্ঠন করে সামরিক, বেসামরিক আমলা, নৈতিক অবক্ষয় গ্রস্থ সুবিধাভোগি শ্রেণীর উদ্ভব। পরনির্ভরশীল- বৈদেশিক সাহায্য পুষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। উন্নয়নের নামে খয়রাতি সহায্য প্রকল্পে ঋন গ্রহণ ও কতিপয় সুবিধাভোগী মধ্যসত্বভোগীর লুন্ঠন। গ্রাম ও শহরের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ধনী ও দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। অশিক্ষা, কু’শিক্ষা আর দারিদ্র পীড়িত জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি। বৈষম্য মূলক শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠা পরস্পর বিপরীত দুইটি ধারা। সর্বোপরি সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, কালোটাকা ও পেশী শক্তির দাপটে দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের সামনে আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আজ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আবার ও ক্ষমতাসীন। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলে গেছেন- “অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া, স্বাধীনতা মূল্যহীন।” সুতরাং মহান স্বাধীনতার স্বপ্ন শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজ বাস্তবায়নে একটি সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎস্বর্গ করে যাওয়া বীর শহীদের স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, বিয়াল্লিশ বৎসর পূর্বে আমাদের মহান স্বাধীনতার স্থপতিরা যে লক্ষ্য ও আদর্শ স্থির করে দিয়ে গেছেন সেখান থেকে সরে আসা হবে আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। কালের বিবর্তনে ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘুরিয়ে দিতে যারা চেয়েছিলেন তারা আজ পরাজিত- কোনঠাসা। অত এব সময়ের সাহসী সৈনিকদের আজ এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ দেহে গজিয়ে উঠা মধ্যসত্বভোগী, আমলা, মৎসুদ্ধি আর লুঠেরা ধনিক-বণিক শ্রেণীর হাত থেকে আমাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হবে। ক্রীতদাসের অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে উন্নয়নের অর্থনীতি চালু করতে হবে।
লেখকঃ আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ, স্থায়ী পরিষদ সদস্য, গণফোরাম
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন