আমের বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ আর মন কেড়ে নেওয়া স্বাদ ও গন্ধে মুগ্ধ হয়ে পণ্ডিতজনরা আমের নামের সঙ্গে বহু অলঙ্কার পরিয়েছেন। এক আম নিয়ে শত কাব্যিক নাম এসেছে আমভক্ত পণ্ডিত, কবি ও কাব্যরসিকদের মাধমে। আমকে বলা হচ্ছে চূত। জন্মের পর থেকেই এই ফলটিকে রীতিমতো প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থেকে শেষমেশ একটি সুন্দর রসাল ফলের আকৃতিতে আসতে হয়। প্রচণ্ড খরা, শিলাবৃষ্টি, ঘন কুয়াশা, গা হিমকরা শীত ইত্যাদি সহ্য করে প্রথমে মুকুল/মঞ্জরি, এরপর আস্তে আস্তে প্রস্টম্ফুটিত হয়ে বিকাশ লাভ করার পর গুটিতে রূপান্তর। এই সময়ের মধ্যে প্রাকৃতিক কারণেই অসংখ্য ছোট ছোট গুটি আম ঝরে পড়ে। এ কারণেই এর নাম চূত। আম পাকা অবস্থায় রসে ভরপুর থাকে। গাছ থেকে পাকা আম মাটিতে পড়ে ফেটে রস চূত বা ক্ষরিত হয় বলে ফলটির এইরূপ নাম।
আমের আরেক নাম সহকার। আমের মুকুল বিকশিত হয়ে বহুদূর অবধি এর সৌরভ ছড়িয়ে দেয়। আমের মুকুলের পাগল করা মধুর সুগন্ধ উপলব্ধি করে বহুদূর থেকে কোকিল, ভ্রমর, মৌমাছি ছুটে আসে, এরা সবাই আমের পরাগায়নে সহায়তা করে। আমের মুকুলের সৌরভের কারণেই প্রকৃতিগতভাবে ঘটনাগুলো সুচারুরূপে ঘটতে থাকে। এ ক্ষেত্রে মুকুলের ঘ্রাণ সহকার বা সহায়ক হিসেবে কাজ করে। আমের মুকুল বা মঞ্জরি বিকশিত হয়ে বসন্তের আগমন বার্তা জানিয়ে দেয়, তাই এর নাম বসন্তদূত ও মাধবট্রম।
আম রাজভোগ্য। রাজা লক্ষ্মণ সেন ছিলেন আমভক্ত। সম্রাট আকবরের খাদ্য তালিকায় আমের অবস্থান ছিল শীর্ষে। যুগ যুগ ধরে এ দেশের নৃপতিরা আমকে তাদের প্রিয় ফল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন, তাই এটি নৃপপ্রিয়। পুরাণে আমের মঞ্জরিকে বলা হয় প্রেমের দেবতা মদনের পুষ্পশর। মদনের পঞ্চশরের এক শর হচ্ছে আমের পুষ্পমঞ্জরি। এই বাণের আঘাতে তিনি প্রতিপক্ষকে কাবু করেন, প্রেয়সীর হৃদয়ে জাগিয়ে তোলেন প্রেমাবেগ, তিনি হয়ে ওঠেন কামাতুরা। আম কামোত্তেজক_ তাই এর নাম কামাঙ্গ, কামশর, কামবলভ, সুমদন। আম মধুসমৃদ্ধ, তাই এর নাম মধুলী, মধ্বারস, সীধুরস। আমের রস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া বাঙালির চিরাচরিত রীতি। আমের সুগন্ধযুক্ত মিষ্টি রসকে দুধের সঙ্গে মিশালে এটি হয়ে যায় সোমধারা। সোমধারা শুক্র স্রোতকে শুদ্ধ করে একে আরও বলবান করে। আমের রস মাদকতার সৃষ্টি করে, সে কারণে এর নাম মাদাঢ্য। আমগাছ কোকিলের আবাসস্থল, তাই এটি কোকিলাবাস বা কোকিলোৎসব। পাকা আম সুমধুর রসে টইটম্বুর, তাই এর নাম রসাল। তবে রসাল বলতে আমগাছও বোঝায়। আমগাছকে মন্মথালয় বলা হয়ে থাকে। এর কারণ হলো_ প্রেম ও কামের দেবতা মদন বা মন্মথের আলয় অর্থাৎ আবাসস্থল। আমের মুকুলকে বলা হয় কামায়ুধ।
আমের যেমন হাজার হাজার জাত রয়েছে, তেমনি রয়েছে এর বাহারি নাম। পৃথিবীতে আমের যত ভ্যারাইটিস নাম আছে, অন্য কোনো ফলে এমনটি নেই। অনেক ক্ষেত্রে যে স্থান থেকে বা অঞ্চল থেকে নির্দিষ্ট একটি আমের প্রথম উদ্ভব ঘটেছে, সেই স্থানটির নাম রক্ষা করে আমের নামকরণ হয়েছে। যেমন বোম্বাই, বৃন্দাবনি, মালিহাবাদ, দুসেহরী (লক্ষ্মৌ), রাতাউল (উত্তর প্রদেশ), মির্জাপুরী, জাফনা (শ্রীলংকা), রাজাপুরী (গুজরাট), মালদহ ফজলি, বাঘা ফজলি ইত্যাদি। ব্যক্তির নামে অসংখ্য আমের নাম রয়েছে। বিশেষ ব্যক্তির দীর্ঘদিনের শ্রম এবং উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার গুণে যে আমটির উদ্ভব ঘটেছে, পরে সেই ব্যক্তির নামে আমটি পরিচিতি লাভ করেছে। যেমন বিহারের ফজলি বিবির নামে ফজলি। বেনারসের খোঁড়া ফকিরের নামে ল্যাংড়া। এমনিভাবে আলফনসো, আনোয়ার রাতাউল, মোহাম্মাদওয়ালা, বিশ্বনাথ চ্যাটার্জি, লতিফ আলীওয়ালা, সিদ্দিকপছন্দ, রামপ্রসাদ, মাহমুদা, রুবি, (ফ্লোরিডা) হিমাউদ্দিন, এডামস (ফ্লোরিডা), জাহাঙ্গীর (তামিলনাড়ূ) ইত্যাদি। দেবদেবীর নামে আমের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। লক্ষ্মণভোগ, সীতাভোগ, কালীভোগ, জগন্নাথভোগ, গোপালভোগ, মোহনভোগ, গোবিন্দভোগ ইত্যাদি। কোনো শ্রেণী বা পেশার অথবা বিশিষ্টজনের উপাধি বা পদবির ভিত্তিতে আমের বহু নাম রয়েছে, যেমন রানী পছন্দ, বেগম পছন্দ, নবাব পছন্দ, শাহ পছন্দ, শাহী পছন্দ, রানী ভবানী, মহারাজ পছন্দ, আলমশাহী, ডক্টর পছন্দ, নাজির পছন্দ, ভাইসরয়, রাজভোগ, বেগমফুলীরাজা, সাফদার পছন্দ, ফকিরওয়ালা, খানবিলাস ইত্যাদি। কোনো কোনো আমের বৈশিষ্ট্যসূচক নাম রয়েছে; যেমন চিনিচাম্পা, জাফরান, খাজুরি, আনারস, কাঁচামিঠা, বারোমাসি, দুধসর, আশ্বিনা, বৈশাখী, ভাদুরিয়া, ভাদুরি, শ্রাবণী, সফেদা, ক্ষীরপুলি, সিন্দুরী ইত্যাদি। রোমান্টিক নামের অনেক আম রয়েছে। যেমন দিল পছন্দ, হুসনেআরা, নাজুকবদন, পেয়ারি, সামার বাহিশ্ত। আমের আকার ও সৌষ্ঠবের ভিত্তিতেও নামকরণ হয়েছে। যেমন হাতীঝুল, পাঁচসেরি, ওমলেট, তোতাপুরী, করেলা, নাগিন, লাড্ডু, চ্যাপ্টা, গোলা, নাশপাতি, বোতল, লম্বা ভদ্রা ইত্যাদি। আমের বর্ণের (রঙ) ভিত্তিতেও এর নামকরণ করা হয়েছে সিন্ধুরিয়া, জাফরান, কালা, স্বর্ণরেখা, জর্দুলু, সুরমা, সুবর্ণরেখা, নীলাম্বরী ইত্যাদি। স্বাদ ও গন্ধ নিয়ে অনেক নাম_রসগোলা, মিছরিকান্ত, চিনি ফজলি, চিনি বাসা, মিছরিদানা, শরবতি, মালাই, দুধিয়া, আনারস, গোলাপখাস, গোলাপজাম, সফেদা, বেলখাস, পেয়ারাফুলি ইত্যাদি।
শাদওয়ালা বা শাদৌলা নামের বিখ্যাত একটি আমের জাত মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে জন্মে থাকে। জানা গেছে, নবাব আলীবর্দী খান ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্যক্তিগত পছন্দের আম ছিল এই শাদওয়ালা। নদীয়া, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের হিমসাগর; মালদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলের ক্ষীরসাপাত এবং মুর্শিদাবাদের শাদওয়ালা বা শাদৌলা_ এই আমের জাতগুলোর মধ্যে স্বাদ, গন্ধ ও গঠনের বৈশিষ্ট্যে খুব বড় একটা তফাত নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন