বর্তমান আওয়ামী লীগের যারা নেতা, তাদের সঙ্গে তৃণমূলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই নেতাদের ওপর তৃণমূলের ত্যাগী নেতাদের আস্থা নেই। ফলে তৃণমূল হয়ে পড়েছে নিষ্ক্রিয়। জামায়াত শিবিরের তাণ্ডবের সময়ে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই জামায়াত সন্ত্রাস চালাতে পেরেছে অবাধে। আওয়ামী লীগের সংগঠন সক্রিয় থাকলে জামায়াত এমন তাণ্ডব চালাতে পারত না।
টক শো’র আলোচনায় এই কথাগুলো সেই সময় বার বার বলেছি। প্রতিবারই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা। এমনকি সাধারণ কর্মীÑউচ্চ শিক্ষিত বড় বড় চাকরিজীবী সমর্থকরাও ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার সমর্থকরা কোনোভাবেই মনে করছিলেন না যে, তারা ভুল করছেন, ভুল পথে চলছেন। সরকার যা করছিল, তারা তাতেই সম্মতি দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।’
এখন এই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্যে বেশ বড় আঘাত। কেন এমন আঘাত পেল, অনেক রকমের বিশ্লেষণ হবে। আঘাত পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দিতে চাইছি না। পুরনো কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করে বিনয়ের সঙ্গে নতুন করে ভাবতে অনুরোধ করছি শুধু।
১. জনগণ যে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল, ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তার চরিত্র বদলে ফেলেছে। জনগণ ভোট দিয়েছিল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে। আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করেছে বেসামরিক-সামরিক আমলাদের দিয়ে, রাজনীতিবিদদের দূরে সরিয়ে। এই আমলা আওয়ামী লীগকে জনমানুষ ভোট বা সমর্থন কোনোটাই দেয়নি।
২. শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে। সামগ্রিকভাবে দায়ী আওয়ামী সরকার। সাবেক দুই আমলা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন প্রায় ৫০ লাখ বিনিয়োগকারীকে। অর্থমন্ত্রী তাদের বলেছেন ‘বোগাস’ ‘রাবিশ’। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন ‘চোর’ ‘ডাকাত’Ñ এসব বিনিয়োগকারীদের জন্য তাদের ‘হৃদয় কাঁদে না।’
এটা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বক্তব্য? এসব বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনো বিশ্লেষণ করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার ভেবে দেখেনি ৫০ লাখ বিনিয়োগকারী মানে ৫০ লাখ পরিবার। এরা ভোটার!
৩. হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছে। কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান হয়েছে। সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায়, জনগণের ৪ হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করতে চায়Ñ এটা দৃশ্যমান হয়নি। দৃশ্যমান হয়েছে সরকার অপরাধীদের শাস্তির বিষয়ে, টাকা উদ্ধারের বিষয়ে আন্তরিক নয়। অর্থমন্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণ মানুষকে ক্ষিপ্ত করেছে।
৪. পদ্মা সেতু বিষয়ে আওয়ামী লীগ যে গোয়েবলসীয় নীতি নিয়েছে, যা মানুষ প্রচণ্ড রকমভাবে অপছন্দ করেছে। আবুল হোসেনকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলায় মানুষ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়েছে। কে দুর্নীতি করেছে, কে দুর্নীতি করেনিÑ সেটা প্রমাণের আগেই মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। যা সরকারের পক্ষে যায়নি। সরকার মনে করেছে ‘দুর্নীতি হয়নি, দুর্নীতি হয়নি’ বললেই মানুষ তা বিশ্বাস করবে।
বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির বিষয়টি আলোচিত হওয়ায় মানুষ মনে করেছে এতে ‘বাংলাদেশে’র অসম্মান হচ্ছে। এতটা অসম্মানিত জনমানুষ হতে চায়নি। জনভাবনার বিষয়টি আমলানির্ভর আওয়ামী সরকার গুরুত্বই দেয়নি।
৫. ড. ইউনূসের উপরে আঘাতকে মানুষ মনে করেছে তাদের নিজেদের উপরে আঘাত। যতই আইনের কথা বলা হোক গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসকে সরানো মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। ড. ইউনূসের অসম্মান জনমানুষ নিজেদের অসম্মান মনে করেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা, মন্ত্রী, নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি বিষয়ে সরকার নীরব থেকেছে। আবার বলেছে কেউ কোনো দুর্নীতি করেনি, বলেছে তদন্ত না করে। সুরঞ্জিত সেনের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই দৃশ্যমান ছিল যে, তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু আবার তাকে মন্ত্রী বানানোটা মানুষ দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা মনে করেছে।
সারা পৃথিবীর চোখে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসকে ‘সুদখোর’ ‘দুর্নীতিবাজ’ বলায় মানুষ হৃদয়ে আঘাত পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, নেতা-পাতি নেতারাও ড. ইউনূসকে দুর্নীতিবাজ বলেছেন, অসম্মানিত করেছেন। অথচ সরকার তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ পায়নি। তারপরও তাকে অসম্মান করা অব্যাহত থেকেছে। ড. ইউনূসকে অসম্মান করায় মানুষের মনে ক্ষত তৈরি হয়েছে। সরকার এই ক্ষত নিরাময়ের উদ্যোগ তো নেয়ইনি, প্রতিনিয়ত ক্ষত বৃদ্ধি করেছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের ৮০ লাখ ঋণগ্রহীতা। মানে ৮০ লাখ পরিবার। তারা ভোটার। তাদের কাছে ড. ইউনূস দেবতা বা পীরতুল্য সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাদের মনের আঘাতের বিষয়টি সরকার বিবেচনায় নেয়নি।
৬. শুধু ড. ইউনূস নয়, ড. আকবর আলি খান, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংবাদিক এবিএম মূসাসহ অনেক সম্মানিত মানুষকে দিনের পর দিন অসম্মান করে গেছে বর্তমান সরকারের নেতা মন্ত্রীরা। এসব ব্যক্তিত্বকে যে দেশের মানুষ সম্মান করেন, পছন্দ করেনÑ সেটা বিবেচনা করা হয়নি।
৭. ভারত সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা অব্যাহত রেখেছে। যে দিন বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হচ্ছেন, পরের দিন ভারতের রাষ্ট্রদূত বলছেন, গত ছয় মাসে সীমান্তে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। মানুষ মনে করেছে তাদের সঙ্গে রসিকতা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। যা মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি।
৮. এক সময় ভারতবিরোধী রাজনীতি এদেশে রমরমা ছিল। তীব্র জনমত ছিল ট্রানজিটের বিরুদ্ধে। বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে। ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের কি কি এবং কত লাভ হবেÑ সরকার কমিটি করে, অঙ্ক দিয়ে বুঝিয়েছে। সরকারের যৌক্তিক ব্যাখ্যা মিডিয়া সমর্থন করেছে, করেছি। টক শো’তে দিনের পর দিন ট্রানজিটের পক্ষে আলোচনা করেছি। বাংলাদেশের লাভ হবে- এটা ভেবে জনমানুষ ভারত বিরোধিতার জায়গা থেকে সরে এসেছে।
মানুষকে বোঝানো হয়েছিল আশুগঞ্জ বন্দর ট্রানজিটের উপযোগী করা হবে, ব্রিজ-রাস্তা বানানো হবে। তারপর শুল্ক বা ফি’র বিনিময়ে ভারতকে দেয়া হবে ট্রানজিট সুবিধা।
একদিন দেখা গেল ট্রানজিট শুরু হয়ে গেছে। আশুগঞ্জ বন্দরে বালুর বস্তা ফেলে ভারতীয় পণ্য নামানো হচ্ছে। ব্রিজ নয়, প্রায় ২০টি খালের ওপর বাঁধ দেয়া হয়েছে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক যাওয়ার জন্যে। সবচেয়ে বিস্ময়কর তিতাস নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে দিল সরকার। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল! এভাবে ভারতীয় পণ্য যেতে শুরু করল কোনো শুল্ক বা ট্যাক্স ছাড়া!!
সাবেক আমলা অর্থ-উপদেষ্টা বললেন, ‘আমরা যদি অশিক্ষিত হতাম, আমরা যদি অসভ্য হতাম, আমরা যদি বর্বর হতামÑ তবে ভারতের কাছে ট্যাক্স চাইতাম।’ ক্ষিপ্ত হয়ে মিডিয়ার সামনে এসব কথা বললেন তিনি। এই বক্তব্য যে জনমানুষকে কতটা ক্ষিপ্ত করল, সেটা হিসাব করার প্রয়োজন মনে করল না আওয়ামী সরকার। মানুষ মনে করল তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে সরকার।
৯. টেলিভিশনের টক শো’তে এসব বিষয়সহ আরও নানা বিষয়ের সমালোচনা সরকার সহ্য করতে চাইল না। সরকার টক শো’র আলোচকদের ‘সিঁধেল চোর’ বলে অসম্মানিত করতে থাকল। যা টকশো-প্রিয় মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।
১০. বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে রেন্টাল, কুইক রেন্টালের দুর্নীতি মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। মানুষ দেখেছে সরকার কিছু ব্যবসায়ী ও দলীয় ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় অর্থ ভাগাভাগি করে নেয়ার সুযোগ দিয়েছে। এশিয়া এনার্জির পক্ষে সরকারের অবস্থানকে ফুলবাড়িসহ সচেতন মানুষের একটি বড় অংশ নিজেদের প্রতারণার শিকার বলে মনে করেছে। এক্ষেত্রেও অসততার দায়ে অভিযুক্ত আমলা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে আওয়ামী সরকার। স্থল এবং সমুদ্রে বিদেশি গ্যাস কোম্পানির পক্ষে সরকারের অবস্থানও মেনে নিতে পারেনি জনমানুষ।
১১. আওয়ামী লীগ নেতা সমর্থকরা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছেন ‘ধর্মান্ধতার বিজয়’। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধের বিষয়টিকে সামনে এনে এমন কথা বলা হচ্ছে।
হেফাজতের সঙ্গে বিরোধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার করায় জামায়াত, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে দৃঢ়ভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এসবই সত্যি। হেফাজতের ভোট আগেও ছিল, নতুন করে হেফাজতের ভোট জন্ম হয়নি। তাদের ভোট আগেও বিএনপি পেত, এবারও বিএনপি পেয়েছে। পার্থক্য আগে হেফাজত দৃশ্যমানভাবে বিএনপির পক্ষে ছিল না, এবার ছিল। তাতে ভোটের ক্ষেত্রে বড় কোনো পার্থক্য হয়নি। তবে এবার হেফাজত মানসিকতার ভোট এককভাবে বিএনপি পেয়েছে। আগে কিছু ভোট আওয়ামী লীগও পেত। রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ জামায়াতের ভোটের একটা অংশ আওয়ামী লীগ পেত স্থানীয় রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে। মেয়র মহিউদ্দিন আগেরবারগুলোতে পেয়েছেন। খায়রুজ্জামান লিটন গত নির্বাচনে পেয়েছিলেন। এবার যা পাননি। এবারও জামায়াতের এবং হেফাজতের একাংশের ভোট যদি লিটন পেতেন, তবে হয়ত ৫ হাজার ভোট বাড়ত। পরাজয়ের ব্যবধানটা কমত, জিতত না।
সুতরাং হেফাজত বা জামায়াতের ভোটে বিএনপি জিতেছেÑ আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে, ধর্মান্ধতার বিজয় হয়েছে, এভাবে বিশ্লেষণ করলে তা সঠিক হবে না। খণ্ডিত বিশ্লেষণ হবে। এতে অকারণে হেফাজতের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা হবে। বাস্তবে হেফাজত মোটেই এতটা শক্তিশালী নয়।
আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের অন্যান্য বড় দোষগুলো আড়াল করে হেফাজত, ধর্মকে পরাজয়ের প্রধান কারণ মনে করে, সেটা হবে আরেকটি বড় ভুল।
১২. আওয়ামী লীগ যে ঘরে বাইরে বিস্ময়কর রকমের দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে সেটা মানুষের চোখে দৃশ্যমানভাবে ধরা পড়ছে। কোনো সাফল্য নেই অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু উড়ে চলেছেন। আমেরিকা তো বটেই ইউরোপের শক্তিশালী দেশ জার্মানি, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি হয়েছে। তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। মানুষের কাছে দৃশ্যমান হয়েছে সম্পর্ক ভালো শুধু ভারতের সঙ্গে। সেটা সবকিছু দেয়ার সম্পর্ক, কোনো কিছু নেয়ার নয়।
মানুষের এই মনোভাবনা দূর করার উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি সরকারকে।
১৩. ঢাকাকে দুইভাগ করাসহ অনেক অপ্রয়োজনীয় কারণে জনঅসন্তোষ তৈরি করেছে সরকার। হাতে গোনা কয়েকজন হাইব্রিড আওয়ামী লীগার সরকারের সব কাজকে ‘খুব ভালো’ ‘খুব ভালো’ বলে টেলিভিশনে কথা বলে নিজেরা মানুষের বিরক্তির কারণ হয়েছেন। ভুল পথকে সঠিক বলায় সরকারের ইমেজেরও ক্ষতি করেছেন।
১৪. জাতীয় সংসদের একটি আলোচনা এবং আওয়ামী লীগের দুর্বলতার প্রমাণ দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করি। গত ১৩ জুন জাতীয় সংসদে বিএনপি সাংসদ আসিয়া আশরাফী পাপিয়া সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট করে কিছু অভিযোগ এনেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা পুতুলের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেছেন। পাপিয়া বলেছেন, ‘সজীব ওয়াজেদ জয় আর পুতুল যে বিদেশে থাকছেন, তাদের বাড়ির উৎস কী? ২০০৬ সালে ভার্জিনিয়ার একটি শহরে ১০ লাখ ডলারে একটি বাড়ি কিনেছেন জয়। ভার্জিনিয়ার আরেকটি শহর আলেকজান্দ্রিয়ায় ১০ লাখ ডলারে আরেকটি বাড়ি কিনেছেন সজীব ওয়াজেদ। ১ নভেম্বর ২০০৭ সালে ফ্লোরিডায় পাঁচ লাখ ডলার খরচ করে বাড়ি কিনেছেন জয়। ১৬ অক্টোবর ২০০৪ সালে সাড়ে ১০ লাখ ডলার খরচ করে ফ্লোরিডায় আরেকটি বাড়ি কিনেছেন জয়। এছাড়া একই অঙ্গরাজ্যে আরও তিনটি বাড়ি আছে তার। ২০০৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত কী করেছেন আর করেননি, সেটা পরবর্তীকালে জানানো হবে।’
পাপিয়া আরও অনেক অভিযোগ করেছেন। সেসব আলোচনার মধ্যে আনছি না। প্রত্যাশা করছিলাম আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের কেউ বা কয়েকজন এর নিশ্চয় জবাব দেবেন। জবাব দিলেন, আওয়ামী সংসদ সদস্য আবদুর রহমান। তিনি বললেন, সজীব ওয়াজেদ জয় আমেরিকায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। পেশা কি সেটা বললেন না। ডাউন পেমেন্ট দিয়ে আমেরিকায় বাড়ি কেনা যায় সেটা বললেন। আরও বললেন, পুতুল এবং তার স্বামী চাকরি করেন।
তারপর বলতে শুরু করলেন তারেক রহমান এবং বিএনপির নেতা-মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থেকে কত রকমের দুর্নীতি করেছেন সেই বর্ণনা। যার কোনোটাই নতুন তথ্য নয়। তারেক জিয়া, হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, লন্ডনে অবস্থান, বিলাসী জীবনযাপনÑ এসব তথ্য মানুষ জানে। মানুষ এও জানে যে, সরকার বিচার করে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি এখনও।
কিন্তু সবচেয়ে বিস্মিত হলাম এটা দেখে যে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগের সুনির্দিষ্ট করে জবাব দিলেন না আওয়ামী সাংসদ। জবাব না দেয়ায় কি প্রমাণ হলো? জয়ের বিরুদ্ধে আনা পাপিয়ার অভিযোগগুলো সত্যি! মানুষ কি বিশ্বাস করবে, তারেক জিয়ারা দুর্নীতি করেছিল, জয়ের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ?
যোগ্যতার সঙ্গে পাপিয়ার অভিযোগ খণ্ডন করলেন না বা করতে পারলেন না আওয়ামী সাংসদ। পাল্টা অভিযোগে যে জয়ের ইমেজ বৃদ্ধি পেল না, সেটা হয়ত হিসাবই করলেন না। এই অভিযোগগুলো জবাব না দিয়ে অথবা যতটুকু দিলেন তাতে পাপিয়ার আনা অভিযোগ সংসদের রেকর্ডে থেকে গেল। যা আগামীর রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হবে।
১৫. আওয়ামী লীগ মনে করেছিল যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল, এবারও সেটাকে কাজে লাগানো যাবে। বিচার করা এবং কিছুটা টালবাহানা করে যে মানুষকে বিরক্ত করা হয়েছে, আওয়ামী নেতৃত্ব সেটা বিবেচনা করেনি।
আর মানুষ শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচার করার জন্যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি। ভোট দিয়েছিল বিএনপির অপশাসন এবং অপকর্ম থেকে মুক্তির আশায়। ভোট দিয়ে বিজয়ী করার পর মানুষ দেখেছে অপশাসন, অপকর্ম এবং অযোগ্যতা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই ফলাফলকে শুধু স্থানীয় সরকারের নির্বাচন বলে হেলাফেলা করা হবে আর একটি বড় ভুল। এটা জনমতের প্রতিফলন। আগামী জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে অশনি সংকেত, আওয়ামী লীগের জন্যে।
১৬. আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছে। এর জন্যে অবশ্যই প্রশংসা তাদের প্রাপ্য। আগের মতো ভোট কারচুপির মেকানিজম এখন আর করা যায় কিনাÑ সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
‘যা করছি তাই ঠিক’ এমন একগুঁয়েমিপূর্ণ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন আওয়ামী লীগের। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে, কৃতকর্মের ভুল শোধরানোর পথের সন্ধান করার সুযোগ এখনও আছে কিনা, নিশ্চিত নই। তবে আওয়ামী লীগের একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখা দরকার বলে মনে করি।
(সাপ্তাহিক, ২১/০৬/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন