প্রথমে জাপানের গল্প। জাপান পৃথিবীর দ্রুত শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে
সুপরিচিত। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যাবে, পঞ্চাশ বছর
আগে জাপানও অতিদরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিল। জাপানে রাস্তাঘাটে ভিখারি
ছিল। মানুষ গাছের নিচে বসে চুল, দাড়ি কাটত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের
পর জাপান দারিদ্র্য সীমার নিচে স্থান পায়। সেই দারিদ্র্য অবস্থা থেকে
প্রত্যয়ী জাপানিরা পৃথিবীর অতিউন্নত অর্থনৈতিক সীমারেখায় পৌঁছেছে।
জাপানিরা পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছ থেকে ‘অতিপরিশ্রমী’ হিসেবে বিদ্রƒপও
শুনেছে। কিন্তু দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের জন্য নিজেরা সর্বশক্তি দিয়ে
পরিশ্রম করে গেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপানের ১০০ মিলিয়ন মানুষ ভয়ঙ্কর
দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। একদিকে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা, অপরদিকে
ধ্বংসস্তূপের অর্থনীতি পুনর্গঠন ও আধুনিকীকরণ ছিল জাপানিদের জন্য বড়
চ্যালেঞ্জ। এ বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে মাত্র চার দশকে একটি
আধুনিক, সমৃদ্ধ জাপান গড়ে তুলেছে! চার দশক পর জাপানের উত্থান নিয়ে
অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন হলো- প্রতিকূলতাই জাপানিদের জন্য আশীর্বাদ।
১. একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ এলাকায় বিপুল জনগণের বসবাস ছিল জাপানিদের
জন্য প্রথম আশীর্বাদ। বাঁচার তাগিদে প্রচ- রকমের কর্মপ্রেরণা এবং
প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল তাদের মধ্যে।
২. কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকাটা ছিল জাপানিদের জন্য দ্বিতীয় আশীর্বাদ।
ফলে জাপানিরা সারা পৃথিবীর অঢেল সম্পদ আহরণে সচেষ্ট হয়েছিল।
৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা ছিল
জাপানিদের জন্য তৃতীয় আশীর্বাদ। পরে নতুন এবং অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে তারা
শিল্প-কারখানা গড়ে তুলল।
এবার শুনুন চীনাদের উন্নয়নের কথা। চীন যে একটি অমিত সম্ভ¢াবনার দেশ, তা
অনুধাবন করা গিয়েছিল সত্তরের দশকে। তখন থেকেই চীনারা রাষ্ট্রের কৃষি,
শিল্প, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষাÑ এ চারটি বিষয়ের ওপর
গুরুত্বারোপ করে। এটাই চীনা শিল্প বিপ্লবের অন্যতম ভিত্তি। বলা হয়ে থাকে,
পৃথিবীর পাঁচ ভাগের একভাগ জনসংখ্যা বাস করে চীনে। আশির দশক থেকে চীনে ছোট
ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে বাজার অর্থনীতির
দ্রুত প্রসার ঘটে। চীন তার বাজার উš§ুক্ত করে দেয় বিদেশি পুঁজি ও
টেকনোলজির জন্য। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিশেষ কিছু শিল্প এলাকা তৈরি করে।
এর ফলে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, যা চীনকে একটি কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র
থেকে শিল্পনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করে। সমাজ ও অর্থনীতির স্থিতিশীলতা
রক্ষায় ৩টি বিষয়কে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে চীনা নেতৃত্ব- ১.
দুর্নীতি, ২. শহর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের সম্পদের ব্যবধান এবং ৩.
পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা। কম দাম, গ্রহণযোগ্য মান, প্যাকিং ও পণ্যের
বৈচিত্র্যে চীন এখন একচেটিয়া ব্যবসায়িক প্রাধান্য বিস্তার করেছে
সারাবিশ্বে। বর্তমান ধারায় উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে চীনে
তৈরি হবে হাজার হাজার মাল্টি মিলিওনিয়ার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের
মধ্যে চীন বিশ্বের ৩০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে। বিশ্বের পণ্যবাজারে
চীনের বিস্তৃতি এখন ‘ফুটওয়্যার থেকে আন্ডারওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার থেকে
সফটওয়্যার পর্যন্ত।’ তাই বিপুল বেগে বিকাশমান অর্থনীতির বিশালতায় চীনকে
প্রায়ই দৈত্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
সিঙ্গাপুরের কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে, অন্যরকম চিত্র। মাত্র ৫০ বছর
আগেও সিঙ্গাপুর ছিল একটি হতদরিদ্র দেশ। তখন সিঙ্গাপুরকে ‘কলোনি অব কুলিজ’
বলে উপহাস করা হতো। কালপরিক্রমায় সেই দেশটির মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ৩০
হাজার মার্কিন ডলারের বেশি। মাত্র ৬১৬ বর্গকিলোমিটারের সিঙ্গাপুরে রয়েছে
বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস। কিন্তু ৪০ বছরে
সিঙ্গাপুরে জাতিগত বা ধর্মীয় কোনো দাঙ্গা হয়নি। সামান্যতম উসকানিও সেখানে
কঠোরভাবে দমন করা হয়। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য শুধু একটি গুদামঘর
হিসেবে পরিচিত ছোট্ট সীমানার সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা
প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ নিজের লেখা বইতে বলেছেন, মালয়েশিয়া যখন
সিঙ্গাপুরকে পৃথক করে দিল, তখন মনে হলো- ‘ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি’।
কিন্তু সেই অনিশ্চিত সিঙ্গাপুর দরিদ্র অবস্থান থেকে কত উপরে উঠে এসেছে,
তা রীতিমতো অভাবনীয়। দুনিয়াতে ‘সিটি স্টেট’ বলতে এখন সিঙ্গাপুরকেই বোঝায়।
সিঙ্গাপুরের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে
দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি। প্রতি বছর এখানে কয়েকশ’ বিলিয়ন মার্কিন
ডলারের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয়। এ সাফল্যের নেপথ্যে আরও তিনটি কারণ-
১. সিঙ্গাপুরের জনগণ কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী; ২. তারা মালিক-শ্রমিক
বিরোধ বাধতে দেয় না। আগেই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে; ৩. সিঙ্গাপুরে লোকসংখ্যার
তুলনায় শিল্প-কারখানার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। বলা যায়, সিঙ্গাপুরের
সমৃদ্ধির নেপথ্য মূলত বন্দরকে কেন্দ্র করেই।
মালয়েশিয়ার দিকে তাকালে কী দেখব। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে
মুক্ত মালয়েশিয়া ছিল দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। মাহাথির মোহাম্মদ মন্ত্রীদের
কাছে ব্যবসায়ী সমাজের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করলেন। ১৯৭৮ সালে শিল্প ও
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের
প্রত্যেকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারে মনোযোগী হন। তার
দৃষ্টিভঙ্গি ছিল-
১. আইনশৃঙ্খলার অস্বাভাবিকতায় কেউ যেন ভীতসন্ত্রস্ত না হয়; ২.
বিনিয়োগকারী যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পড়েন; ৩. কর্মীদের উচ্ছৃঙ্খলতা
ও দুর্নীতির কালো থাবা যেন উৎপাদন ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি না করে।
বলা যায়, এ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ মালয়েশিয়াকে বাণিজ্যবান্ধব রাষ্ট্রে পরিণত
করে। ফলে দেখা গেছে, শুধু টিন ও রাবার রফতানিকারক দেশ মালয়েশিয়া মাত্র
দুই দশকে ইলেকট্রনিক, ইস্পাত, যন্ত্রপাতি এমনকি মোটরগাড়ি রফতানিকারক
রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ,
বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে মালয়েশিয়াকে
দ্রুত শিল্পায়নে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা দাতা সংস্থার
পরামর্শ এড়িয়ে দেশের জন্য যা মঙ্গলকর, তা-ই করেছেন মাহাথির। এর ফলে
মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকে অনগ্রসরতার পাতাল থেকে সগর্বে আরোহণ করেছে
অগ্রগতির শীর্ষ চূড়ায়।
আমাদের দেশেও শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। অনেক দেশীয় কোম্পানি ক্রমেই গ্রুপ অব
কোম্পানিতে পরিণত হচ্ছে। কোম্পানি কারও নিজের সম্পদ নয়। কোম্পানি দেশ ও
জনগণের সম্পদ। দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই কোম্পানি
পরিচালিত হয়। একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে শুধু মালিক বা উদ্যোক্তারা লাভবান হয়
না। লাভবান হয় দেশের মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র। গার্মেন্ট শিল্পের কথাই ধরা
যাক। একটি মধ্যমানের গার্মেন্টে প্রায় ১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এ
গার্মেন্টের পোশাক দেশীয় চাহিদা মেটায় এবং বিদেশে রফতানি হয়। সরকার
রাজস্ব পায়। এখন গার্মেন্টটির শ্রমিকদের কম বেতন দেয়া বা কোনো অনিয়ম
ঘটছে, এমন কোনো কারণে গার্মেন্টটি বন্ধ করাটা সমীচীন নয়। দোষ খোঁজার আগে
এর অবদান বিবেচনা করা উচিত। আমাদের দেশের ইতিবাচক শিল্পোদ্যোক্তাদের নিয়ে
১০ বছরের একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে পাল্টে যাবে দেশের
চেহারা। এ জন্য প্রয়োজন-
১. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি ইতিবাচক সরকার গঠন। যে সরকার পরপর দুই
টার্ম দেশ পরিচালনা করবে; ২. দেশের জনগণ এবং দেশের সম্পদকে কাজে লাগানো;
৩. দেশের অপচয়, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ, কালো টাকার লাগাম টেনে ধরা; ৪.
শিল্প-কলকারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা দেয়া;
৫. কৃষকদের আধুনিক কৃষি-প্রযুক্তির সুবিধা ও তাদের ন্যায্যমূল্য দিয়ে
উৎপাদন বাড়ানো; ৬. তরুণ সমাজের উপযোগী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা; ৭. নতুন,
তরুণ, দেশপ্রেমী এবং ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা; ৮.
রাজনৈতিক অস্থিরতাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে আসা; ৯. সেক্টরভিত্তিক
পেশাজীবী ফোরাম গঠন করে উন্নয়নে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয়া; ১০. দেশের
কল্যাণে শিক্ষক, চিকিৎসক, পুলিশ, লেখক-সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও
বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ পেশা হিসেবে সুবিধা প্রদান করা।
আমরা জানি, দারিদ্র্য দূর করার উপায় হলো ভালো জিনিস সস্তায় উৎপাদন করে
বিক্রি করা। চীনারা সেটা করে দেখাতে পেরেছে। অথচ আমরা কেরানীগঞ্জের
জিঞ্জিরাকে শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে পারছি না। জিঞ্জিরা দুই নম্বর
বা নকল জিনিস তৈরির এলাকা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। প্রশ্ন হলো- যারা
নিজেদের চেষ্টায় নকলপণ্য তৈরি করতে পারছে, তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং
বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কেন উন্নতমানের দেশিপণ্য তৈরির কাজে
লাগানো যাচ্ছে না? ধোলাইখালের অশিক্ষিত শ্রমিকরা যদি মেশিনারিজ পার্টস
তৈরি করতে পারে, তাহলে তাদের কেন প্রশিক্ষিত করে ধোলাইখালকে শিল্প এলাকায়
পরিণত করা যাচ্ছে না? সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এসব কিছুই সম্ভব। সরকার
প্রণোদনা দিলে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসবেন এ শিল্পে। দেশের অনেক
ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিল্প পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এসব
শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ফলে কাজ জানা মানুষগুলোও
বেকার হচ্ছে। এসব শিল্পে বংশানুক্রমে কর্মসংস্থানে ধারাবাহিকতা থাকে।
সরকার না পারলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের তো উৎসাহিত করতে পারে। এভাবে ছোট
ছোট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখলে মানুষ কাজ করে খেতে পারবে। ঢাকার বাইরে বিশেষত
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিল্প স্থাপন করলেই বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে, এমন
আহ্বান ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করবে। ঢাকার বাইরে শিল্প গড়ে উঠলে মানুষের
শহরমুখী চাপ কমবে।
আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনা বিদ্যমান। কার্যকরকরণের অভাবে সুফল পাওয়া
যাচ্ছে না। সরকার শিল্পবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করলে, দেশের
শিল্পোদ্যোক্তাদের নিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা করলে লাখো-কোটি
বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির
জন্য যুব উন্নয়ন অধিদফতর, কর্মসংস্থান ব্যাংক, অন্য ব্যাংকগুলো এবং
জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সমন্বয়ে উপযোগী প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে ঋণ
সহায়তা দিয়ে মধ্যম সারির শিক্ষিতদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে
পারে। প্রশিক্ষণ দিয়ে, ঋণ সহায়তা দিয়ে জনশক্তি রফতানি বাড়ানো যেতে পারে।
সমবায়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে সামাজিক পুঁজিভিত্তিক ছোট-বড় প্রকল্প গড়ে
তোলা যেতে পারে।
আমরা কী ভাবছি? বাংলাদেশে জনসংখ্যার আধিক্য যেমন আছে, তেমনি আছে
প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। বাংলাদেশ এখন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম
জিডিপি অর্জনকারী দেশ। আমাদের উচিত, কথা কম বলে কাজ বেশি করা। বিদ্যমান
সমস্যা মোকাবিলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সম্পদের সম্ভাবনায় সমৃদ্ধি
সম্ভব। এই দেশজ চেতনায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। এদেশে কিচ্ছু হবে না,
আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, সরকার এই করে দেয় না, সেই করে দেয় না- এসব
হীনমানসিকতা আগে বদলাতে হবে। বদলাতে হলে চাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমিও
পারব। আমার যা আছে তা নিয়েই এগিয়ে যাব। সরকারের পক্ষে সবকিছু করে দেয়া
সম্ভব নয়। নিজেদেরও কিছু করার আছে। একা সম্ভব না হলে সমবেত প্রচেষ্টায়
সম্ভব হবে। চেষ্টা তো করতে হবে। উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
স্বাধীনতার সূচনালগ্নে মালয়েশিয়া যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, বাংলাদেশ
সৌভাগ্যবশত তেমন জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। এদেশের শতকরা ৯৮ জন বাংলায়
কথা বলে। সমসাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ প্রায় সবাই। আঞ্চলিক ভিন্নতাও কোনো
জটিলতা সৃষ্টি করেনি আমাদের মাঝে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ছাড়া ধর্মভিত্তিক
অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করেনি জনসমষ্টির মধ্যে তেমন অনতিক্রম্য কোনো দূরত্ব।
অতীতে একসঙ্গে নির্যাতিত হওয়ার বেদনা, মুক্তিযুদ্ধে সমানভাবে ত্যাগ
স্বীকার এবং বিজয়ের আনন্দে সমান অংশীদার হওয়ার গৌরবের স্মৃতিও জাতীয়
পর্যায়ে সৃষ্টি করেছিল এক ধরনের নিবিড় আত্মীয়তা ও ঐক্য। বাংলাদেশ একটি
ঐক্যবদ্ধ জাতি। মুক্তিযুদ্ধের আগুনে ঝলসে সেই ঐক্য আরও দৃঢ় ও গভীর হয়।
১৯৫৭ সালে মালয়েশিয়া যে অবস্থায় ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ তার চেয়ে ভালো
অবস্থায় থেকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কেন, স্বাধীনতার ৪১ বছর অতিক্রম
করার পরও আমরা লক্ষ্যস্থলের ধারে-কাছে যেতে পারলাম না? আপাত মনে হয়,
নেতৃত্বের সঙ্কট ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রধান কারণ। তাহলে বাংলাদেশের
জাতীয় জীবনে এখন মাহাথির মোহাম্মদের মতো একজন নেতার বড্ড বেশি প্রয়োজন।
কিন্তু কে নেবে সে দায়িত্ব? সত্তরের দশকের দিকে বিদেশিদের সহায়তায় এ
দেশের উদ্যোক্তারা গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশ ঘটাতে শুরু করেছিল। সেই শিল্প
থেকে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এ শিল্পের বিকাশের
ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ৪০ লাখ শ্রমিকসহ অন্তত দুই কোটি
লোকের। বাংলাদেশের মাটির নিচে লুকিয়ে আছে সম্পদের বিশাল ভা-ার। শুধু এই
খনিজসম্পদ দিয়েই বাংলাদেশ হতে পারে সমৃদ্ধিশালী একটি দেশ। তেল, গ্যাস,
কয়লা, চুনাপাথর, তামা, লোহা, গন্ধক, নুড়িপাথর, শক্তপাথর, বালি- এসব
অফুরন্ত সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। পর্যটন শিল্পে রয়েছে
বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনা। আমাদের আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত
কক্সবাজার। আছে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। প্রাকৃতিক মনোরম
দৃশ্য, স্থাপনা, ঐতিহ্যজড়িত পর্যটন স্পট রয়েছে দেশজুড়ে। জনশক্তি রফতানি
আরেক সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশের প্রবাসী রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়ছে।
ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা থাকলে এক্ষেত্রে আরও উন্নতি সাধন সম্ভব। বিশ্বে
বাংলাদেশ রেমিট্যান্স আয়ের দিক দিয়ে শীর্ষ ১০টির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।
জনশক্তি রফতানির তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বে
মূল্যবান সম্পদ হলো মানবসম্পদ। এই বিশাল সম্ভাবনাময় সম্পদটি বাংলাদেশের
হাতের মুঠোয়। ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাতকে দক্ষ কর্মীর হাত হিসেবে গড়ে
তুলতে পারলে সহজেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। প্রয়োজন শুধু
যোগ্য নেতৃত্বের।
জনবহুল বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে পরিকল্পিতভাবে
অগ্রসর হলে এর সুফল পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার রয়েছে চারটি স্তর-
বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত। নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনদের
কাজের ক্ষেত্র রকমারি। উচ্চবিত্তদের জন্য রয়েছে অবারিত সুযোগ। মধ্যবর্তী
অবস্থানে মধ্যবিত্ত শ্রেণী আছে উভয়সঙ্কটে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমস্যা
সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভাঙতে হবে মধ্যবিত্তের
সীমাবদ্ধতার শেকল। কেননা, মধ্যবিত্তশ্রেণী সমাজের মূল্যবোধের ধারাকে ধারণ
এবং লালনের মাধ্যমে একে প্রবাহিত করে প্রজন্মান্তরে। সমাজে নতুন
মূল্যবোধও জাগরিত হয় মধ্যবিত্ত-শ্রেণী থেকেই। আমাদের বাংলাদেশ আমরাই গড়ব।
আমাদেরই গড়তে হবে। কেউ এসে আমাদের বিজয়, অর্জন, সাফল্যকে হাতে তুলে
দেয়নি। এসব কিছুই সময়ের পরীক্ষায়, আমাদের শ্রম আর মেধাশক্তির বিনিময়ে
ছিনিয়ে আনতে হয়েছে। আমাদের সামনের পথ আরও সুগম্য। সামনের সময় সুন্দর।
সামনের দিন গতিময়। অফুরন্ত সম্ভাবনার। আসুন সবাই দেশকে অন্তর দিয়ে
কাজে-কর্মে ভালোবাসি। আসুন, সবে মিলে কাজ করি- এক হয়ে দেশ গড়ি।
এস এম মুকুল, গবেষক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন