সাপ্তাহিকী
|
রাইস উদ্দিন
|
|
কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহি পল্লী সাহিত্যে
23 Jun, 2013
ডঃ মুহাম্মদ সহীদূল্লাহ তার পল্লীসাহিত্য প্রবন্ধে লিখেছেন-গ্রামবাংলার প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য সাহিত্য।বায়ু সাগরে ডুবেও যেমন আমরা বায়ুর গুরুত্ব বুঝিনা তেমনী পল্লীতে যে সকল সাহিত্য ছড়িয়ে রয়েছে তার গুরত্বও আমরা বুঝিনা।তিনি যথার্থই লিখেছেন।এক সময় মানুষের চিত্বে আনন্দ দিতে পুথিঁ পাঠের আসর বসতো।সেখানে ছেলে বুড়ো সকলে মিলে উপভোগ করতো অলৌকিক সব কাহিনী।প্রেমের কাহিনি এগুলো অবাস্তব লালিত্যে গঠিত হত।জীন পরীদের তাত্পর্যময় আচরণ ফুটে উঠত সে সকল কাহিনী গুলোতে।আবার দেখা যেত বীরত্ব গাঁথা কাহিনী –যেমন সোহরাব রুস্তম,হানিফা ও শহরবানু।মহানুভবতার প্রতিক হিসেবে দাতা হাতেম তাঈ স্থানপেত পুথিঁর আসরে।উনবিংশ শতাব্দীতে এর প্রচলন এবং প্রভাব খুব বেশি ছিল।তখন মানুষের মনে হিংসা বিদ্বেষ ঝগড়া মারামারি খুব কম ছিল,অবসর কাটাতেই তারা শীতের মৌসুমে চাঁদনী রাত গুলোতে সবাই আনন্দে মেতে থাকতো পুঁথির আসরে।ছুট্ট সময় আমি নিজে নবাব গঞ্জ উপজেলার সুল্লা গ্রামের ইয়াসিন সরকার নামে একজন বয়স্ক পুথিঁ পাঠকের মূখে অনেক বার পুথিঁ পাঠ শুনেছি,শুনেছি আনেক কি্চ্ছা।যেমন গাজিকালূ গুলবাকুলীর আষেকী পুস্প ইত্যাদী।সম্মানিত পাঠক বৃন্দ!বিস্বাশ করুন ওগুলো শুনে এক অজানা রাজ্যে চলে যেতাম।স্বপ্ন জগতে নিজেই রাজকুমার হয়ে রাজকুমারীকে ভয়ংকর রাক্ষসের কবল থেকে উদ্ধার করতাম।এখন আর পুথিঁপাঠ হয়না।কিচ্ছা কাহিনীর আসর বসেনা।সময় বদলে গেছে মানুষবদলেছে,সাহিত্যের দিকপরিবর্তন ঘঠেছে।তারপরও কিছু সাহিত্য ও শিল্পকর্ম এখনো বহালতবিয়তে রয়েছো আজ তেমনি একটি পল্লী সাহিত্যের কথা বলবো যাহা একজন সফল সাহিত্যিকের কলমের ছোঁয়ায় হয়ে উঠতে পারে জীবন্ত ও প্রানবন্ত।দোহার থানার অন্তরগত বাস্ত ইউনিয়নের মঈনট গ্রামে এখনও রয়েছে এক ঐতিহ্যবাহি পরিবার যার নাম ফকির পরিবার।তারা সবাই নিজেদেরকে পীর বলে দাবী করে থাকেন।তাদের পরিবারের কৃষ্টিকালচার ও আচারাচরণ দেখে আমার মনে পরে ইমদাদুল হক মিলন সাহেবের আব্দুল্লাহ উপন্যাসের কথা।এই পরিবারের কোন সদস্য কাজ করেন না।ভক্তদের দেওয়া নযর-নেওয়ায দিয়েই তাদের পরিবারের ভরনপোষন করে থাকেন।এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মহিশুর ফকির গেদন শাহ।তার অলৌকিক শক্তি এবং কাশ্ফকেরামত সম্পর্কে জনশ্রুতি ছিল গগনচুম্বী।কথায় আছে-বাড়ীর গরু পালানের ঘাস খায়না,কথাটি তাদের বেলায় শতভাগ সত্যি।উনাদের ভক্তবৃন্দ সবই বহিরাগত যেমন-কুমিল্লা এবং সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহের।
সেখানে বছরে একটি নিদ্দিষ্ট দিনে উরস অনুষ্ঠিত হয়।সাত দিন ধরে চলে মেলা,যা অদের ভাষায় বলা হয় ধামাইল।সবচেয়ে বৈচিত্রের ও আনন্দের বিষয় হচ্ছে-সাত রঙের সাতটি বাঁশ নিয়ে নৃত্য।একটা বাঁশের উজন হবে কমপক্ষে বিশ থেকে পঁচিশ কেজি উজনের।দর্শকের মন কেরে নেওয়ার মত এ নৃত্য, সত্যিই আকর্শনীয় এবং তাতে রেয়েছে শৈল্পিকতা নাদেখলে বুঝা যাবেনা।আড়াই দিন ব্যাপী চলে এ নৃত্য নিজস্ব শিশ্যদের বাড়ি গিয়ে।সাথে থাকে কবিয়াল আরও থাকে বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্র।কবিয়াল তাদের সহশিল্পীদের নিয়ে পুথিঁ ও গানে গানে মাতিয়ে রাখে শ্রোতাদের।তাদের জারী গানে বা পুথিঁর উপাত্য বিষয় ইমাম হাসান হুসেনকে নিয়ে লোকো গাঁথা।সম্মনিত পাঠক!আরো চমকপ্রদ বিষয় হলো-বাঁশ গুলো,সাত রকমের রঙে এত সুন্দর করে বিভিন্ন রকম কাপরে আবৃত যা সত্যি অপুর্ব।এক একটি বাঁশের নামকরনও ভিন্ন ভিন্ন।
-আল্লাহর নামে যে বাঁশটি সেটি সাদা কাপড়ে আবৃত এবং মাথায় সাদা চুল লাগানো।রাসুল সাঃ এর নামে যেটি তা সাদার সাথে হালকা গোলাপী কাপড়ে আবৃত এবং মাথায় কালো চুল লাগানো।হযরত আলী রাঃএর নামে যে বাঁশ ওটি আলাদা রং ও কাপড় ব্যবহৃত হয়েছে।ফাতিমা রাঃ এর নামে যেটি সেটিও ব্যতিক্রম ধরনের তবে মাথায় কালো চুল রয়েছ।হাসান ও হোসেন রাঃ এর নামে দুটি বাঁশ লাল ও কালো রঙের কাপড় দ্বারা আবৃত এবং মাথায় কালো চুল লাগানো।আর একটি বাঁশ রয়েছে রাসূল সঃ এর নাকি একজন পালক নাতি ছিল যার নাম দমের মাদার"তার নামে নামকরন এ বাঁশটি একদম আলাদা বৈশিষ্টের এবং ঐ নামটিকে কেন্দ্র করেই সব বাঁশগুলির নাম করন করা হয়েছে তাহলো-মাদার বাঁশ।মাদার বাঁশ যেটি ঐটি নাকি খুব জালালী (গরম)এটি সম্পর্কে তাদের পুথিঁর মধ্যে একটি গল্প রয়েছে গল্পটি লেখা সম্ভব হলো না-তিনি ছিলেন বাতাস ও দম অর্থাত স্বাষপ্রশ্বাষকে নিয়ন্ত্রনকারী সকলপ্রাণীর স্বাষপ্রশ্বাষ নিয়ন্ত্রন করে থাকেন।
আড়াই দিন নৃত্য শেষে বাড়ী ফিরেন ফকির তার দলবল নিয়ে।উরসের দিন বাড়ীর আঙ্গিনায় রাতে তেঁতুল গাছের লাকড়ী পুড়িঁয়ে কয়লা করা হয় এবং লাল টকটকে আগুনের কয়লার উপর নৃত্যকারীরা নৃত্য করতে থাকে।এক সময় সমস্ত কয়লা গুলো পাঁয়ের আঘাতে ছাইঁ হয়ে যায়-বড়ই আশ্চার্য্যের বিশয় ঐ ছাইগুলো ভক্তরা প্রতিযোগীতার মধ্যদিয়ে সংগ্রহ করে থাকে ওগলো নাকি সকল রুগের মহা্-ওয়ুধ।পীর পরিবারের সদস্যরা সে রাতে কাতার বেঁধে বসে থাকেন ভক্তরা বাড়ীথেকে আনা খাঁটি সরিষার তৈল তাদের মাথায় পালাক্রমে ঢালতে থাকেন।একপর্যায় তাদের তৈল দ্বরা স্নান হয়ে যায় এবং ভক্তরা তাদের পায়ে সেজদার মত করে ভক্তি করে জান্নাত পাওয়ার আশায়।উরসের শেষে,সুবেহ সাদীকের সময় বাঁশগুলোকে পদ্মায় গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয় যেমন হিন্দুরা পুজাঁ শেষে তারা তাদের প্রতিমা সুমহ পানিতে ভাসিয়ে দেয়।সেই দিনকে তারা মত্স মূখ বলে কারন আড়াই দিন একাধারে রোযা থাকার পর তারা মাছভাত খেয়ে রোযা ভাঙ্গে থাকেন এবং ফকির তার ভক্তবৃন্দ সবাইকে নিয়ে নদী থেকে গুসলকরে ঠান্ডা হয়ে আসেন।
যে বাঁশগুলো ভাসিয়ে দেওয়া হয় ঐ বাঁশ নেওয়ার জন্যও রীতিমত মল্লযুদ্ধ সংগঠিত হয়।তাতে দুএকজন বাঁশের খুঁচায় আহত হয় এমন কি মারাও যায়্।কথিত আছে ঐ বাঁশ দিয়ে নদী বা খালে ভেশাল পাতাহলে অনেক মাছ নাকি পাওয়া যায়।ওগুলি দিয়ে মাছধরার পলো উঁচা তৈরী হয় এবং ওগুলো অনেক টিকসই হয়।এবার আশা যাক-পীড় ও ভক্তদের প্রসংগে-কথিত আছে পীড়বংশের প্রতিষ্ঠাতা পীড় গেদন শাহ জীবীত থাকা কালে সুদুর ময়মনসিংহ থেকে ভক্তরাবৃন্দ নৌকা যোগে যখন পীরের বাড়ী আসছিল,পদ্মা নদীতে দই ভর্তি নৌকা সহ সবাই ঝরের কবলে পরে নৌকাসহ তলিয়ে যায় এবং মারা যায়।আশ্চার্যজনক ভাবে একজন ভক্ত প্রানে বেঁচে কোন রকম পীড়ের কাছে এসে পৌছেন এবং ঘটনা তাকে বয়ান করেন।পীড় সাহেব ঘটনা শুনে স্বহাস্য বলেলন'কোন ভয় নাই বত্স!আমার জন্য যদি খালেস নিয়তে এসে থাকে তাহলে ভক্তের ভরা কখনো ডুবে যেতে পারেনা্।তুমি কালপ্রত্যুশে আমার বাড়ী বরাবর পদ্ম্যার ঘাটে গিয়ে অপেক্ষা করো!দেখবে খাটের ভরা ঘাটে এসে ভিরবেই।পরদিন পীড়ের কথাই সত্যি হলো দই ভর্তি নৌকা লোকবল সহ ঘাটে এসে পৌছলো।এ ঘটনা বিদ্যুতের ন্যায় চারদিকে ছড়িয়ে পরলো এবং গেদন শাহের খ্যাতি ছড়িয়ে পরলো দিকিবিদক।
এখন আর আগের মত পীরদের কোন কথা আর কাজে কাস্ফকেরামতি দেখা যায়না।কথায় আছে ঝরে বক মরে ফকিরের কেরামতি বারে।এটিও এখন লক্ষ্যকরা যায়না।আগের মত নযরেনওযাজও উঠেনা,যাদিয়ে সাড়া বছর কেটে যাবে।তাদের অবস্থা নাকী এখন খুবই নাজুক।উরস ছাড়াও তারা বছরের মাঝখানে ভক্তদের বাড়ি যান উপটৌকন গ্রহনের জন্য যা দিয়ে বছরের বাকি দিন গুলি ভাল ভাবে চলে।এখন নাকি তারা তাদের পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া এসব রীতিনীতি থেকে কিছুটা ফিরে আসতে শুরু করেছে-লেখাপড়া করে চাকুরীতে যোগ দিয়েছে।কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।তাদের অনেকই মেয়েদের মত এখন লম্বা চুল রাখেনা।তাদের এ নতুন প্রজন্ম যারা, তারা বাস্তবতার নিরিখে অলৌকিক ও অস্বাভাবিক কাহিনী গুলো আর বিস্বাশ করেত চায়না।শিক্ষিত হওয়ার কারনে তাদের মধ্যে জীবনে নৈপুণ্য এসেছে,চিন্তার জগতে বিপ্লব এসেছে এবং বদলে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্যবাহী জীবন ধারা।এভাবেই গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পল্লিসাহিত্য দিন দিন বিলিন হয়ে যাচ্ছে।জানিনা কিভাবে আর কত দিন এগুলো বেচে থাকবে ?কেই বা নিবে এগুলি সংরক্ষনের দায়িত্ব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন