সাপ্তাহিকী
|
আব্দুল মান্নান
|
|
সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঃ একটি পর্যালোচনা
23 Jun, 2013
গত ১৫ জুন, ২০১৩ তে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল এই চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ফলাফল আমাদের সবার জানা। তারপরও বিভিন্ন মিডিয়াতে এবং জনগণের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়েই চলেছে। ফলাফল নিয়ে চলছে নানা ধরণের বিশ্লেষণ। সকলেই নির্বাচনে ১৪ দলের তথা আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় গভীরভাবে খতিয়ে দেখছেন এবং কারণগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। আলোচকদের আলোচনা থেকে অন্যতম অনেকগুলি কারণের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের কথাও বারবার ঘুরে-ফিরে সামনে চলে আসছে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় এবং নির্দলীয় একটি নির্বাচন হলেও এবারে এর উপর জাতীয় ও দলীয় রাজনীতির প্রভাব ছিল শতকরা একশ ভাগ। প্রচার অভিযানে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের দলীয় সংশ্লিষ্টতা বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে।
যে কারণেই হোক সাধারনত অধিকাংশ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের লক্ষ্য থাকে পরবর্তী নির্বাচনে আবারো জয়ী হওয়া। ফলে তাঁরা সাধ্যমতো জনকল্যানমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করে থাকেন। উল্লিখিত চারটি সিটি করপোরেশনের মেয়রদের ব্যাপারে একই কথা প্রযোজ্য। যতদূর জানা যায় চারটি সিটির মেয়রগণ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো যথেষ্ট উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। প্রশ্ন হলো তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তাঁদের পরাজয় ঘটল কেন? পরাজয়ের কারণগুলির সাথে হেফাজতে ইসলাম-ই বা কিভাবে জড়িয়ে পড়ল তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় পালা বদলের একটা স্বাভাবিক কার্যক্রম। সম্প্রতি চারটি সিটি করপোরেশনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন স্থানীয় এবং জাতীয় উভয় ক্ষেত্রেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনী ফলাফল থেকে প্রতীয়মান হয়েছে জনগণ স্থানীয় সমস্যাগুলিকে যত না বড় করে দেখেছে, তার চেয়ে বড় করে দেখেছে জাতীয় সমস্যাগুলিকে। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। একটি দেশের বৃহত্তর অঙ্গনে নগরগুলির অবস্থান বিন্দু তুল্য। কাজেই সারা দেশ যেখানে নৈরাজ্য আর অশান্তিতে ছেয়ে গেছে সেখানে নগরবাসী আশেপাশের আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পেতে পারেনা। দেশের বড় বড় সমস্যাগুলির সমাধান না হলে স্থানীয় অনেক সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব নয়। কাজেই নগরবাসী যথাযথভাবেই দেশের সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং ব্যালটের মাধ্যমে নিজেদের মত ব্যক্ত করেছে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবেনা সত্য, কিন্তু নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সতর্ক বার্তা হিসাবে এটা একটা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমান সরকার সাড়ে চার বছর আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতির সিংহভাগ পূরণ করতে তো পারেইনি বরঞ্চ বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার অপকৌশলগুলি সঠিকভাবে গ্রহণ করেছে। দলীয় ক্যাডারদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেয়া, প্রশাসনে দলীয়করণ, দুর্নীতিবাজদের পক্ষাবলম্বন, নিজেদের স্বার্থ বিলিয়ে দিয়ে প্রভু রাষ্ট্রের মন জয় করার চেষ্টা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা সহ নানাবিধ অনৈতিক কাজে সরকার লিপ্ত। এগুলির সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে শাহ্বাগ ও শাপলা চত্তরের ঘটনা প্রবাহ। সরকারের অনৈতিক কাজগুলি জনগণের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছে এবং দেশের চারটি প্রান্ত থেকে জনমতের নমুনা সরকারের জনপ্রিয়তার ধস স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
বর্তমান সরকার গদ্দীনশীন হওয়ার পর থেকেই বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াতকে কোনঠাসা করার জন্য নিপীড়নের চরম পন্থা গ্রহণ করে। তারা মূল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের মদ-মত্ততায় মেতে উঠে। আওয়ামীলীগের প্রথম তিন বছর (১৯৭২ - ১৯৭৫) সহ বিগত প্রায় চল্লিশ বছর যাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করা হলোনা, সেখানে এ সরকার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সাথে সাথে রায়কে প্রভাবিত করার জন্য আইনও সংশোধন করল। যুদ্ধাপরাধ বা মানবতা বিরোধী অপরাধ যেটাই হোকনা কেন, বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক অভিসন্ধি থেকে অন্যায় কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারেনা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবশ্যই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে আসল অপরধীদের বিচার সকলের কাম্য।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণে সরকার জামায়াতের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে বরাবর-ই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করেও গণতান্ত্রিক সকল অধিকার কেড়ে নিয়ে এবং অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। আর একই সাথে সরকার ও এর বশংবদ প্রচার মাধ্যমগুলি একযোগে প্রচার করছে জামায়াতকে শায়েস্তা করার অর্থ ইসলামের বিরোধীতা নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে দেশে যা হবার তাই হচ্ছে।
জনগণকে বোকা বানানোর উদ্দেশ্যে সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে রাখলেও বিগত সাড়ে চার বছরে সরকার নারী উন্নয়ন নীতিমালার কোনো কোনো ধারা, পর্দা, স্কুল ও মাদ্রাসার পাঠ্য বইয়ে ইসলামী আকিদা পরিপন্থী শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিকত্ব ধংস করার নানা কৌশল গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি শাহ্বাগ গণজাগরণ নাটক মঞ্চায়িত হলো। এ নাটকের অন্তরালে ছিল এবং এখনও সক্রিয় রয়েছে ইসলামের বিরুদ্ধাচারণকারী একটি সংঘবদ্ধ দল। দেশের আপামর জনতা প্রথমে এই ষড়যন্ত্র বুঝতে না পারলেও পরে তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। উপলব্ধি করতে পেরেছে হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দও। ফলশ্রুতিতে তাঁদের নেতৃত্বে জন্ম নিয়েছে শাপলা চত্তর এবং পালিত হয়েছে অবরোধ কর্মসুচী। কর্মসূচি বাস্তবায়ন কালে ফ্লাশয়াআউট অপারেশনের মাধামে তাদের উপর নেমে এসেছিল অমানিশার ঘোর অন্ধকার। রাজনৈতিক কোনো দাবি নয়, ইসলামের শাশ্বত ও সুন্দর নীতিমালা প্রতিষ্ঠার দাবি গ্রহণ করাতো হলো-ই না, প্রাণ দিতে হলো অজানা সংখ্যক মাদ্রাসার ছাত্র ও সত্য পথের সৈনিকদের। এখান থেকেই হেফাজতে ইসলামের নেতা ও কর্মীগণ রাজনৈতিক ময়দানে ভূমিকা রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সেটার প্রভাব আমরা দেখতে পেলাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে।
জামায়াতের নেতা-কর্মীগণ কোনো আন্দোলন শুরু করলে স্বাধীনতার শত্রু এবং যুদ্ধাপরাধের মামলা বানচাল করার ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলে তাদেরকে অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। আর এখন সরকার নিজে ইস্যু তৈরি করে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের উপরও একইভাবে নির্যাতন শুরু করেছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ জনসাধারণকে কিছুটা বুঝাতে পারলেও হেফাজতের ব্যাপারে সরকার সফল হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক এবং ছাত্ররা পবিত্র কুরআনকে বুকে ধারণ করে এর মর্যাদা রক্ষা করে চলেছে মাদ্রাসা চালু হওয়ার পর থেকে। অথচ আজ সরকার তাদেরকে কুরআনের অবমাননাকারী, অগ্নি সংযোগকারী, মানুষ হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত করার ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে। এই অপপ্রচার সরকারের জন্য যে বুমেরাং হয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
হেফাজতে ইসলামকে ব্যঙ্গ করে বলা হয় হেফাজতে জামায়াত। কিন্তু ব্যঙ্গকারীরা জানেনা জামায়াত ও হেফাজতের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। হেফাজতের মূল নেতৃবৃন্দ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়াটাকে একটা নোংরা কাজ মনে করে। পক্ষান্তরে জামায়াত মনে করে ইসলামের আলোকে রাজনীতি করা ঈমানের দাবি। সরকারের চলমান হঠকারিতা এই দুই দলের মধ্যে যে সামান্য মত পার্থক্য ছিল তা দূর করতে সাহায্য করেছে বলেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে ১৮ দলীয় জোটের পক্ষে হয়ে উভয়ে কাজ করেছে।
শাপলা চত্তরের অবরোধে এবং ঐ কালো রাতে বিএনপি হেফাজতে ইসলামের পক্ষে কি ভূমিকা রেখেছিল তাও তাদেরকে খতিয়ে দেখতে হবে। ভাববার কোনোই কারণ নেই যে হেফাজতে ইসলাম বিপদে পড়ে তাদেরকে সমর্থন করেছে। সামনের দিকে বিএনপি যদি হেফাজতের পাশে সময় মত দাঁড়াতে না পারে তাহলে হেফাজত মুখ ফিরিয়ে নিলে বলার কিছুই থাকবেনা।
বিভিন্ন টকশোর মাধ্যমে জামায়াত-শিবির প্রশ্নে বিএনপির অনেকের মধ্য লজ্জা-লজ্জাভাব দেখা যায়। আবার তারা মনে-মনে ভাবে পেটুয়া বাহিনী হিসাবে জামায়াত-শিবির মন্দ নয়। কাজেই ঐ সুবিধাটুকু নিতে আপত্তি না থাকার-ই পক্ষে তারা। বিগত বছরগুলির সরকারের প্রচার কৌশল কারোর দৃষ্টি এড়াতে পারবেনা। বিএনপির হাইকমাণ্ডের দৃঢ়তার কারণে জামায়াতকে ত্যাগ না করায় বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীদের দোসর হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রচার ছিল তুঙ্গে। ঐ প্রচার কি বিএনপির ভোটে কোনো ভাটা পড়েছে? সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল দেখলে তা মনে হয়না। দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধী বা মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার চায়, কিন্তু আওয়ামীলীগের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ছকের মধ্যে থেকে নয়।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল সন্তর্পণে পা ফেলার জন্য আগাম সতর্ক বার্তা। সময় এসেছে ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে ছোট-খাটো মত পার্থক্য ভুলে গিয়ে দু দলের (জামায়াত ও হেফাজত) মধ্যে ঐক্য নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য ইসলামী দলগুলিকে সাথে নিয়ে বৃহত্তর ইসলামী মোর্চা তৈরি করা। ইসলামী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলিকে দেশের জনগনের আশা-আকাঙ্খা, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজেদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। সন্দেহ-সংসয়, অবিশ্বাস, নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখা, ওয়াদা পালনে অনীহা কোনো ব্যক্তি বা দল আর যাই করুক জাতি গঠনে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন