অনেকের মতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সেকুলারিজমই মূল উপাদান বা সেকুলারিজম-এর আদর্শই মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি। আবার অনেকে এটাকে মোটেও মেন নিতে চাননা। আসুন এ মতের পক্ষে বিপক্ষে দালীলিক ভিত্তি বিবেচনা করে দেখা যাক।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগের দলিলপত্রগুলোতে কী ছিল?
ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচী দেয়। সে ছয় দফার অধীনে অনেকগুলো উপদফা ছিল। এই ছয়দফাই মুলত মুক্তিযুদ্ধের মুলভিত্তি। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর পশ্চিমীরা ছয় দফা মানতে রাজী না হবার কারণেই মার্চের আলোচনাগুলো একের পর এক ভেস্তে যায় এবং দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে এগোয়। এই গুরুত্বপূর্ণ ছয় দফার মূল দফা বা উপদফার কোথাও সেকুলারিজম বা ধর্ম নিরেপক্ষতার বিষয়টি পরক্ষ বা প্রত্যক্ষ্য কোনভাবেই অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। [বিস্তারিত দেখুনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ২৬৭-২৭৩]
জানুয়ারী ১৯৬৯ সালে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ (যাতে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ছিল) ১১ দফা প্রদান করে। শেখ মুজিব ৭০ সালে তার বক্তৃতায় ৬ দফার পাশাপাশি ১১ দফার কথাও উল্লেখ করেন গুরুত্বের সাথে। এই ১১ দফারও কোথাও সেকুলারিজমের কথা নেই। [বিস্তারিত দেখুনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ৪০৯-৪১২]
১লা আগষ্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ "পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নীতি ও কর্মসূচীর ঘোষণা (মেনিফেস্টো)" প্রকাশ করে। এতেও সেকুলারিজমের কথা নেই। অবশ্য অর্থনৈতিক আদর্শ শিরোণামে উল্লেখ করা হয়: " আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণীহীন" সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমান শোষণ, বৈষম্য. অবিচার ও দুর্দশার হাত হইতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।" [বিস্তারিত দেখুনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ৪৭৩]
বামপন্থী দলগুলোর নথিপত্রে সেকুলারিজমের উল্লেখ দেখা যায়। ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক স্বাধীন জনতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ১১-দফা কর্মসূচীতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়নি। বলা হয়, "ধর্মের নাম ব্যবহার করিয়া সকল প্রকার শোষণ উচ্ছেদ করা হইবে।" [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ৪৯৪] অবশ্য এই একই সংগঠনের (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন) পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ সালে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে পেশকৃত ১৪-দফা দাবীর ৩ নং দফায় বলা হয়: "রাষ্ট্র হইবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র "। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ৬৫৩] ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ, মোজাফফর) পাকিস্তান শাসনতন্ত্রের জন্য ১৭ দফা প্রস্তাবের ১৫ নং দফায় বলা হয়: "পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষ (সেকুলার) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলিয়া ঘোষণা করিতে হইবে"। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ৭০১] বামপন্থীদের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রস্তাব আসাটা অস্বাভাবিক কিছুনা। কিন্তু আমাদেরকে ভাবতে হবে এটা কি বাংলার সকল মানুষের দাবি ছিল, সকল মুক্তিযোদ্ধদের দাবি ছিল? এসময় আওয়ামী লীগের কোন দাবী, প্রচারপত্র বা শেখ মুজিবের বক্তৃতায় ধর্মনিরপেক্ষতার কোন কথা ছিলনা। বরং বিভিন্ন বক্তৃতা ও নথি বিশ্লেষণ করলে এর বিপরীত চিত্রটিই আমরা দেখতে পাই।
১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডিন্যান্স (LFO) জারি হয়। ন্যাপ (ভাসানী) LFO-সহ নির্বাচনকেই প্রত্যাখ্যান করে। মস্কোপন্থী ন্যাপ LFO-এর ২০ ধারাভুক্ত বিষয়গুলো বাতিল দাবী করে। আওয়ামী লীগ সহ বাদ-বাকী দল নির্বাচনে অংশগ্রহন করে LFO-এর অধীনেই। এই LFO-এর ২০ ধারাটি বিষয়বস্তু ছিল: "Fundamental principles of the constitution"। এর (a) উপধারায় বলা হয়: "Pakistan Shall be a Federal Republic to be known as the Islamic Republic of Pakistan... " . (b) উপধারায় বলা হয় "(i) Islamic ideology which is the basis for creation of Pakistan shall be preserved; and (ii) the Head of the State shall be a Muslim." [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ৫১১]
LFO-এর অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় আইনগতভাবে এর প্রতি দায়বদ্ধ থাকলেও শেখ মুজিব রাজনৈতিকভাবে একে প্রত্যাখ্যান করে, এর মোকাবেলায় ছয় দফাকে দাড় করান। তার নির্বাচনী প্রচারণার পুরোটা জুড়েই ছিল ছয় দফার পক্ষে জনগণকে কনভিন্স করার চেষ্টা। নির্বাচনে জয়ের পর তিনি একে "referendum on the six-point programme" বলে অভিহিত করেন। [The Dawn, Karachi, December 18, 1970, referred in Bangladesh Documents, Volume I, page-131] আর এই ছয় দফার কথা আমরা আগেই বলেছি যে এতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা নেই।
নির্বাচনী প্রচারিভিযানে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বক্তৃতাগুলোর কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা পাওয়া যায়না। ৭ জুন ১৯৭০ আ্ওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করে। এদিন ঢাকার রেস কোর্সে অনুষ্ঠিত সমাবেশ সম্পর্কে ডন পত্রিকার রিপোর্টে লিখা হয়: "Sheikh repeatedly held out the assurance that Islam was in no danger on the sacred land of Pakistan, and lashed out at those who raised cries of 'Islam in danger' on flimsy grounds..."[Bangladesh Documents, Volume I , page 82]
২৫ অক্টোবর রংপুরের জনসভায় শেখ মুজিব বলেন: "... six-point programme would never destroy Pakistan or Islam but it would only destroy exploiters. " “জয় বাংলা” স্লোগান সম্পর্কে বলেন সেখানে কোন “wrong” বা “un Islamic” কিছু নেই। [The PEOPLE, Dacca – October 26, 1970, cited in Bangladesh Documents, Volume I, page- 102, 103]
১৫ নভেম্বর মৌলভীবাজারে বলেন, “…Neither Pakistan nor Islam will go. What will go is the big bellies of capitalists”
লক্ষণীয় বিষয় হলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কী ছিল? ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে “Basic features of the constitution” শিরোণামের অধীনে লেখা ছিল: “Islam is the deeply cherished faith of the overwhelming majority of the people. Awami League affirms that a clear guarantee shall be embodied in the Constitution to the effect that no law repugnant to the injunctions of Islam as laid down in the Holy Quran and Sunnah shall be enacted or enforced in Pakistan. The sanctity of the religious institutions shall be constitutionally guaranteed. Adequate provisions shall be made for extending religious education at all levels.” [Bangladesh Documents, page- 67, 68]
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০সালে। নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর ৩ জানুয়ারী ১৯৭১ সালে ঢাকায় এক সমাবেশে শেখ মুজিব বলেন, “Is There any objection anywhere against Islamic ways and systems after Awami League leaders have been elected to both National and Provincial Assemblies? Are not the people going their own way of life and has any harm been done to Islam? Has Islam gone and are not the people professing this great religion?” The PAKISTAN TIMES –এর রিপোর্টে আরও বলা হয়, “The rally offered ‘fateha’ for those killed in different movement for the people’s cause and kept its proceedings suspended on the advice of Sheikh Mujib during the Asr azan.” “… At the end of his speech Sheikh Mujib raised ‘nara-i-takbir’ slogan.” (Bangladesh Documents, page-137)
নির্বাচনের পর জাতীয় পরিষদের পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করার কথা ছিল। আওয়ামী লীগ চাইছিল ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করতে। সেমতে তারা একটি খসড়া সংবিধানও রচনা করেছিল। ডঃ কামাল হোসেনের সূত্রে আওয়ামী লীগের সংবিধান কমিটি কর্তৃক ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণীত পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্রের একটি কপি “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র”-এর দ্বিতীয় খন্ডে সংযোজন করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে Preamble শুরু করা হয়েছে এভাবে: “In the name of Allah, the Beneficent, the Merciful, We, the peoples of the autonomous States of Bangladesh, the Punjab, Sind, Pakhtunistan and Baluchistan,…” Preamble-এ আরও বলা হয়েছে: “Further resolving that guarantees shall be embodied in this Constitution… to enable the Muslims of Pakistan, individually and collectively, to order their lives in accordance with the teachings of Islam as set out in the Holy Quran and the Sunnah.” এই খসড়া শাসনতন্ত্রের PART III-তে Islam নামক ধারায় তিনটি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে: “(1) No law shall be repugnant to the injunctions of Islam as laid down in the Holy Quran and Sunnah. (2) Facilities shall be provided for the teaching of the Holy Quran and Islamiat to the Muslims of Pakistan. (3) Observance of Islamic moral standards should be promoted amongst the Muslims of Pakistan.” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খন্ড]
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর দলিলগুলোতে কী পাওয়া যায়?
১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। সেখানে স্বাধীনতা ঘোষণার ৯টি কারণ বা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয় (Whereas…AND…Whereas এই আকারে) সেখানে কোথাও ধর্ম সংক্রান্ত কোন সমস্যার কথা উল্লেখ নাই (যেহেতু ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি, যেহেতু জেনোসাইড করা হয়েছে ইত্যাদি স্বাধীনতা ঘোষনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে)। স্বাধীনতা ঘোষণার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে: “We…in order to ensure for the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice, declare and constitute Bangladesh to be sovereign Peopels’ Republic…” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খন্ড] তাহলে দেখা যাচ্ছে এখানে equality, human dignity এবং social justice-এর কথা বলা হয়েছে, সেকুলারিজমের কথা বলা হয়নি।
১১ এপ্রিল নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ বা ১৭ এপ্রিল বিশ্বের উদ্দেশ্যে ইস্যুকৃত প্রেস স্টেটমেন্টেও এধরনের কোন কথা নেই।
অন্যদিকে ১৪ এপ্রিল জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী প্রকাশ করা হয়। সেটা শুরু করা হয় এভাবে:
“আল্লাহুআকবর
স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনগণের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের
নির্দেশাবলী”
এটি শেষ করা হয় এভাবে: “এ সংগ্রাম আমাদের বাচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন।
স্মরণ করুনঃ আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন
‘অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ সুখকর’।
বিশ্বাস রাখুনঃ
‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী’।
জয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব!
জয় বাংলা!”
[বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খন্ড]
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কী সেকুলার কোন চেতনা কাজ করেছে? এ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজল জলিল বলেন: “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মীয় অনুপ্রেরণা মোটেও অনুপস্থিত ছিলনা। প্রতিটি যোদ্ধার শ্বাসে-নিঃশ্বাসে, রণক্ষেত্রের প্রতিটি ইঞ্চিতে স্মরণ করা হয়েছে মহান স্রষ্টাকে – তার কাছে কামনা – প্রার্থনা করা হয়েছে বিজয়ের জন্য, নিরাপত্তার জন্য। অধিকাংশ যোদ্ধাই যেহেতু ছিল এদেশের সংখ্যাগুরু মসলিম জনগণেরই সন্তান, সেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর বুলেট, মর্টারের সন্মুখে আল্লাহ এবং রসূলই ছিল তাদের ভরসাস্থল। সুতরাং ’৭১ –এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ইসলাম অনুপস্থিত ছিল বলে যারা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন, তারা কেবল বাস্তবতাকেই অস্বীকার করছেন।” (মেজর (অবঃ) এম এ জলিল, কৈফিয়ত ও কিছু কথা, পঞ্চম প্রকাশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ২৬)
তিন আরও বলেন: “ইসলাম পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, রাজতন্ত্র সহ সকল ধরনের স্বৈরশাসনের ঘোর বিরোধী। … স্বাভাবিক কারণেই ইসলাম যুক্তিযুদ্ধ চেতনার পক্ষের শক্তি।” (অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, সপ্তম অধ্যায়)
তিনি মন্তব্য করেন, “যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভূত মাথায় বহন করে এনেছে তারা …ভুল করেছে…।” “…ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দান ইসলাম তো করেই না, অন্যান্য ধর্ম মতেও তদ্রুপ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ ছিল, ধর্মযুদ্ধ ছিল না। সুতরাং যুদ্ধোত্তর কালে ধর্মের প্রতি উষ্মা কিম্বা কটক্ষ করার কোন যুক্তিই নেই, থাকতেও পারে না। তবুও রয়েছে কেন?”(অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, সপ্তম অধ্যায়)
সেকুলারিজম কোথায় থেকে এল?
২৩ নভেম্বর ১৯৭১ তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন: “The present struggle will thus be completed by our achieving the secular-democratic-socialist order promised by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৪০]
৭ ডিসেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে আমার সরকাএরর মৌলিক নীতি ইতিপূর্বেই ঘোষণা করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের সুখী আর সমৃদ্ধিশালী বাংলা গঠন করতে হবে।” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খন্ড]
১৭ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন বেতার ভাষণে বলেন: “দেশের দ্রুত পুনর্গঠনের কাজে আমরা ভারতের সহযোগিতা ও সাহায্য কামনা করব। শুধু পুনঃনির্মাণ নঢ –নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। সংগ্রামের কালে সমগ্র জাতির যে ঐক্য ও আত্মত্যাগের পিরচয় আমরা দিয়েছি সে ঐক্য ও ত্যাগের মেনাভাব অটুট রাখেত হবে। তবেই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি দৃঢ় হবে। সেই নতুন আলোর পথে আজ আমরা যাত্রা করলাম। জয় বাংলা” [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খন্ড]
১০ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে নয়া দিল্লীতে একটি পাবলিক মিটিং-এ শেখ মুজিবুর রহমান-এর বক্তব্য সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়: “He said that he believed in the ideals of secularism, democracy, freedom of man and peace in the world.” “…He ended his speech with a shout of ‘Jai Hind’. Mrs Gandhi then joined him by hailing ‘Jai Bangla’.”(U.N.I – January 10, 1972; cited in Bangladesh Documents Volume II, page - 607) এই একই দিনের বক্তব্য সম্পর্কে দি নিউ ইয়র্ক টাইমস (১১ জানুয়ারী ১৯৭২) লিখে: “He said his country would be founded on the same principles as India – ‘Bangla Desh stands for secularism, socialism and democracy.’” [Bangladesh Documents Volume II, page – 609]
১৭ মার্চ ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় এক সমাবেশে বলেন: “Change is the law of life. Many changes are taking place in India and Bangaldesh…Our policies in India are built upon democracy, secularism and socialism, not because they are fine-sounding words but because only a combination of these three principles can enable a country of our size and diversity to be united and strong… Common principles and objectives have brought Bangladesh and India together. We shall firmly stand together by them, and derive inspiration from them for our march forward.” [India Bangladesh Relations Documents -1971-2002, Volume-I, Edited & Introduced by Avtar Singh Bhasin, page-27]
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে পাস হয়। ২৭ নভেম্বর ১৯৭২ সালে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবু সাইদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে এক ভোজসভায় ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি.ভি. গিরি বলেন: “…We have been immensely impressed by the fact that, in its devotion to the democratic process, the Bangladesh Government has succeeded so soon in adopting a Constitution, with the four guiding principles of Nationalism, Socialism, Democracy and Secularim, ideas which have inspired our own people.” [India Bangladesh Relations Documents -1971-2002, Volume-I, Edited & Introduced by Avtar Singh Bhasin, page-60]
১১ জানুয়ারী নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়ে দিচ্ছে যে বাংলাদেশ ভারতের মূলনীতিগুলোই গ্রহন করতে যাচ্ছে। পরবর্তীতে ১৭ মার্চ ইন্দিরার সুপারিশ মূলক বক্তব্য এবং ৪ নভেম্বর ভারতের প্রেসিডেন্টের ধন্যবাদ জ্ঞাপন থেকে সংবিধানের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে ভারত সংশ্লিষ্টতার দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ ব্যাপারে মেজর জলিল তার “অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা” বই-এর অষ্টম অধ্যায়ে “আওয়ামী লীগের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উৎস” শিরোণামে উল্লেখ করেন: “
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের ৭২-এর সংবিধান প্রণেতা হচ্ছে স্বয়ং দিল্লীর শাসক চক্র। ৭২-এর সংবিধানের উৎস তাই বাংলাদেশের জনগণ নয়, সম্প্রসারণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ভারতীয় শাসক চক্রই হচ্ছে মূল উৎস।” “…যুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের কোটি কোটি বুভুক্ষ মানুষের জন্য অন্নবস্ত্রের পূর্বেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এসে মাথায় চেপে বসে। এই ৪ মূলনীতি আরোপ করার মধ্য দিয়ে দিল্লীর কর্তারা তাদের মূল লক্ষ্যই স্থির রেখেছে কেবল। কারণ ভারতীয় সংবিধানও ৪ মূলনীতির ব্যতিক্রম নয়। তাই বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ সন্নিবেশিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে মূলত ভারতেরই একটি অংগরাজ্য হিসেবে সুক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং নীতির গোপন সূত্রে বেঁধে দেয়া হয়েছে।”
লেখকদ্বয়ঃ গবেষক ও শিক্ষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন