সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
নগরের একপ্রান্তে প্রচুর ক্ষুধা কিন্তু ডিনার নেই, আরেক প্রান্তে প্রচুর ডিনার কিন্তু ক্ষুধা নেই
15 Jun, 2013
শিরোনামটি প্রয়াত শ্রদ্ধেয় হুমায়ন আহমেদের নাটক থেকে ধার করা। আয় বৈষম্য বুঝানোর জন্য তিনি এই উপমা ব্যাবহার করেছিলেন।
সাম্যবাদের কবি, বিদ্রোহী কবি নজরুল বৈষম্য ও ব্যাবধানের বিরুদ্ধে লিখে গেছেন।
“তোমরা রহিবে তেতলার পরে আমরা রহিব নিচে
অথচ তোমাকে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে”।
সময় গড়িয়েছে, উন্নত এবং হচ্ছি আমরা কিন্তু সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে বৈষম্য। নজরুলের যুগে যেটা তিনতলা আর নিচতলার ব্যবাধান ছিল, সময়ের পরিক্রমায় আজ তা গাছতলা আর শততলায় পরিনত হয়েছে।
ধরা যাক মিস্টার এক্স এর পার্টির কথা। বন্ধুদেরদের নিয়ে সপ্তাহান্তে ভালো রেস্টুরেন্টে গেছেন খেতে, দশ জন নানান পদ খেয়ে হয়ত কুড়ি হাজার টাকা বিল দিয়ে আসছেন, সাথে ওয়েটার কে মোটা টিপস। তারপরও ভাবছেন, এই হোটেলটা বেশ সস্তা, এত খেলাম কিন্তু বিল কত কম! একই সময়ে গার্মেন্টস কর্মী শরীফা তার এক বছরের সন্তান নিয়ে পাড়ার ফার্মেসীতে বসা ডাক্তারের সামনে বসে আছেন। ডাক্তার তাকে বলছেন এই অসুখ ঔষধে সারানো যাবে না, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, বেশ কিছু টেস্ট করতে হবে, লম্বা সময় নিয়ে চিকিতসা করতে হবে। কিন্তু শরীফার আর্জি স্যার সামনের মাসে আগে তো বাচ্চাকে হাসপাতাল নিতে পারবা না, এখন তো খাবার টাকাই নাই! বাচ্চার রোগ যে বড় অসময়ে চলে এসেছে!
সময়ের আবর্তে যেমন মানুষ বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে উতপাদন, বেড়েছে প্রযুক্তি। শিক্ষার হার বেড়েছে, শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। প্রায় পুরো পৃথিবী থেকে রাজতন্ত্র বিদায় নিয়ে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে আমরা মডার্ণ যুগ পার হয়ে পোষ্ট মডার্ণ যুগে চলে এসেছি। আমরা সভ্যতার মাপে অনেক উচুতে উঠে গেছি বলে প্রতিনিয়ত দাবী করি। “গ্লোবালাইজেশন” এর ফলে সারা বিশ্ব আজ একটা গ্রামে পরিণত হয়েছে। আর সব কিছুর সাথে পাল্লা দিয়েই বাড়েছে দারিদ্র আর তার চেয়েও ভয়াবহ ভাবে বেড়েছে বৈষম্য।
কিন্তু কেন? পৃথিবীর সম্পদ কি তার সকল মানুষদের খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়? মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “পৃথিবীর সম্পদ সকল মানুষের “প্রয়োজন” মিটানোর জন্য যথেষ্ট কিন্তু “লোভ” মিটানোর জন্য নেহায়েত অপ্রতুল”। কিছু মানুষের লোভ এর যোগান দিতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ তার বেচে থাকবার ন্যুনতম প্রয়োজনটুকু পাচ্ছে না। রানা প্লাজা যদি লোভের প্রতীক হয় তবে রানা প্লাজা ধসে মারা মানুষ গুলি বৈষম্যের প্রতিক।
বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে যখন “উন্নয়ন” একটা জনপ্রিয় বিশ্ব-শ্লোগানে পরিনত হয় তখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা বৈষম্য নিয়ে খুব ভাবিত ছিলেন না। সাধারন ভাবে বিশ্বাস করা হতো উন্নয়নের সুফল চুইয়ে পড়ে (trickle down Effect) দারিদ্রের বিমোচন ঘটাবে। কিন্ত বাস্তবে তা ঘটেনি। আজকের পৃথিবীতে ২০% বড়লোক মানুষ আশি শতাংশের বেশি সম্পদের মালিক আর গরীব ৪০% শতাংশ মানুষের মালিকানায় আছে মাত্র ৪% সম্পদ (সুত্রঃ ইউএনডিপি)। উন্নয়নের জোয়ারে রানা প্লাজার মত ভবন গড়ে তোলে একজন কিন্তু হাজারো দরিদ্র শ্রমিক “ঝুকিপুর্ণ ভবনে কাজ করবনা” এটুকু বলবার স্বাধীনতাটুকু পর্যন্ত রাখে না। একজন গার্মেন্টস মালিক বছর অন্তর ব্যবসার বিস্তার ঘটান, নতুন ফ্যাক্টরি করেন, নতুন মডেলের গাড়ি আসে কিন্তু একজন শ্রমিকের বাচ্চা অসুস্থ হলে তাকে পরের মাসের বেতনের অপেক্ষায় থাকতে হয়, সে বেতনও ঠিক সময়মত পাবেন কিনা তার নিশ্চয়তা থাকেনা। এই শরিফা কোন হাতের কাছে কোন সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে তার বাচ্চার চিকিতসা বিনে পয়সায় করাতে পারেন না আবার এমন বেতনও পান না যে বাইরে চিকিতসা করাবেন। পুষ্টির কথা না হয় বাদই দিলাম! যখন এক পার্টিতে খাবার অপচয় হয়, আরেক দিকে না খেয়ে ঘুমাতে যায় বিলিওন মানুষ! সভ্যতার চাকচিক্যের আড়ালে থেকে যায় বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হতদরিদ্র মানুষ গুলি। রাস্তায় বিএমডাব্লিও হাঁকিয়ে যাবার সময় ফুটপাথে অর্ধ ঊলংগ মানুষটি যখন পেটের দায়ে হাত পাতে তখন আমাদের মনে মমতা জন্মে না, জন্মে বিরক্তি!
বিশেব্যাংকের বিশ্ব ব্যাপী করা এক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে দরিদ্র লোকজন মনে করেন তাদের দারিদ্রের পিছনের সরকারের ব্যার্থতা মুলত দায়ী। তারা বেচে থাকবার জন্য যে বেসিক প্রয়োজন আশা করেন সরকারের কাছ থেকে তার প্রায় কিছুই পাননা মুলত পলিসির অভাবে কিম্বা পলিসি থাকলেও ব্যপক দুর্ণীতি এবং সিস্টিমের অদক্ষতার জন্য।
আজ পলিসি মেকাররা টেকসই উন্নতির কথা বলছেন। দারিদ্র ও বৈষম্য না কমলে সভ্যতার চাকচিক্য যতই দৃষ্টিমধুর হোক না কেন, তা হয়ত সময়ের সাথে টিকতে পারবে না। দারিদ্র ও বৈষম্য না কমাতে পারার ব্যার্থতার চরম মুল্য হয়ত আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের দিতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন