ধর্মের কোণ বিকল্প নেই। ধর্ম যা দিতে পারে মানুষকে অন্য কিছু তা দিতে পারেনা। দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনৈতিক মতবাদ, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বা শিল্পকলা কোনকিছুরই সে ক্ষমতা নেই। ধর্মের জায়গা দখল করার বা ধর্মকে ছাড়িয়ে যাবার সাধ্য নেই কোনকিছুর।
ধর্মের কাছে মানুষের অতি প্রয়োজনীয় এমন পাচটি জিনিষ আছে যা আর কারো কাছে নেই। এই জিনিষগুলির অভাবে মানুষের জীবন শূন্য, সঙ্কটাপন্ন ও অর্থহীন হয়ে যায়।
এক, ধর্মের কাছে জীবন, জগত ও অস্তিত্বের ব্যখ্যা আছে। একমাত্র ধর্মই বলে দিতে পারে আমি কে, আমি কোথা থেকে এসেছি, এই বিশ্বচরাচরে আমার অবস্থান কি, আমার কাজ কি এখানে এই দুনিয়াতে এবং আমার জীবনের চূড়ান্ত পরিনতি কি। এসব প্রশ্নের উত্তর ছাড়া জীবনের কোণ কিছুর কোণ মানে খুজে পাওয়া যায়না। এই মানের অভাবে মানুষের জীবন হয়ে যায় একটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গোলকধাধা। অন্ধকারে হাতড়ে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাওয়া আর কোণ গতি থাকেনা তখন মানুষের। এই জীবনটা এবং এই পৃথিবীর সবকিছু হয়ে যায় শূন্য, শুষ্ক, যন্ত্রণাময় ও মূল্যহীন। জীবনের অর্থ খুজে না পেয়ে বহু সংবেদনশীল মানুষ আত্মহত্যা পর্যন্ত করে বসে।
দুই, আপদ, বিপদ, দুঃখ, বেদনা, বঞ্চনা ও হতাশা দিয়ে ভরা এই জীবনে একমাত্র ধর্মই পারে মানুষকে সান্তনা জোগাতে, আস্থা ও আশার বানী শোণাতে। জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতি আসে যখন মানুষ আর কোণ অবলম্বন খুজে পায়না। দুনিয়ার কোণ কিছুরই কোণ সান্তনা দেবার বা আশা যোগানোর সাধ্য থাকেনা সে সময়। তেমন দুর্যোগের মুহূর্তে একমাত্র ধর্মের ভিতরেই শান্তির আশ্রয় মেলে মানুষের। জীবনে এমন অনেক যন্ত্রণা আসে যখন সবচেয়ে মুল্যবান অবলম্বন হয় ধৈর্য। এই ধৈর্য তখন একমাত্র ধর্মই জোগান দিতে পারে। কোণ মানুষও নয় বা কোণ মতবাদও নয়। দুনিয়ার সবকিছুই অসহায় হয়ে দূরে সরে যায়। অবিচল ও যথার্থ সাহায্যকারী হিসেবে কাছে পাওয়া যায় কেবল ধর্মকেই। সে কখনো সাথ ছাড়েনা বা বিশ্বাসঘাতকতা করেনা। চরম মানসিক দ্বন্দ ও যাতনার মধ্যে ধর্মই পারে মানুষকে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার বা আত্মহত্যার দুর্গতি থেকে বাচাতে।
তিন, একমাত্র ধর্মই পারে অধঃপতিত মানুষকে উদ্ধার করতে – তাকে ক্ষমা ও সংশোধন করে সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে তুলতে। সে অধঃপতন যতোই দীর্ঘ বা গভীর হোক না কেন তাতে ধর্মের কোণ অসুবিধা হয় না। যেকোণ সময়, যেকোণ অবস্থায়ই তাকে ক্ষমা ও মুক্তির বার্তা শোনাতে পারে ধর্ম। রাষ্ট্রও অনেক সময় সবকিছু ক্ষমা করতে পারেনা। সমাজও পারেনা। ব্যক্তি মানুষও পারেনা। কিন্তু ধর্মের মধ্যে ক্ষমার আয়োজন আছে। একবার নয়, বারবার ক্ষমা লাভের সুযোগ আছে। যেকোণ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা ও তাকে সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হবার উপায় আছে। দুনিয়ার সবকিছু তাকে ফেলে দিলেও ধর্ম তাকে ফেলেনা। ধর্মের কাছে সে সবসময় মুল্যবান। তাকে কাছে টেনে নিয়ে আপন করে নিতে ধর্ম সবসময়ই প্রস্তুত।
চার, মৃত্যুর পর কি হবে আমার এই মহা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব কেবল ধর্মের কাছেই আছে। মৃত্যুর পর যে জীবন মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে তার জন্য কি ভাবে তৈরি হতে হবে সেকথাও একমাত্র ধর্মই পারে বলতে। মৃত্যুর পরের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হওয়া মানুষের জন্য একান্তই স্বাভাবিক। যে কখনো এ নিয়ে ভাবেনা তাকে মানুষ বলাই যায়না। জড়পিণ্ডের নিচেও তার অবস্থান। আর যে মনে করে মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই বা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে মৃত্যুর পর কি হবে সেজন্য সে উদ্বিগ্ন নয় তার আক্কেলের দুর্দশা প্রকাশ করার উপযুক্ত ভাষা খুজে পাওয়া যায়না।
পাচ, নানামুখি ও সংঘর্ষশীল আকর্ষণ ও প্রয়োজনের এই জটিল জীবনে একমাত্র ধর্মই মানুষকে দিতে পারে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্বেগহীন জীবনের ছক। এর অভাবে মানুষের জীবন হয়ে যায় দ্বন্দমুখর ও আত্মবিধ্বংসী। জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগের মধ্যে থাকেনা কোণ সংযোগ ও সমন্বয়। জীবন হয়ে যায় এলোমেলো, বিশৃঙ্খল ও অসংলগ্ন। জীবন পরিনত হয় একটা যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধ চলতে থাকে নিজের ভিতরে, বাইরে ও চতুর্দিকের আর সব কিছুর সাথে। এ যুদ্ধের কোণ বিরাম থাকেনা।
দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, রাজনৈতিক মতবাদ, জাতিয়তাবোধ বা শিল্পকলা কোণ কিছুরই সাধ্য নেই মানুষকে এই পাচটি মহা মুল্যবান জিনিষ দেবার। এমনকি এসবের ধারেকাছেও যাবার।
দর্শন তো এক চমকপ্রদ বুদ্ধিবৃত্তিক নিস্ফলতা। দার্শনিকরা কেবল যুক্তিতর্কের জটিল জাল বুনতেই জানে। একেক দার্শনিক একেক জাল বোনে। এ জালের মধ্যে তারা নিজেরাও আটকে পড়ে এবং অন্যদেরও আটকে ফেলে। টেরই পায়না যে তারা জালের মধ্যে বন্দি হয়ে যাচ্ছে। দুই দার্শনিক কখনো এক কথা বলেনা। তাদের নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্কেরও কোণ শেষ নেই। ওদিকে সত্য উপেক্ষিত হয়ে অসহায়ভাবে দূরে পড়ে থাকে। চূড়ান্ত সত্যের নাগাল পায়না দর্শন বা সে পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনা। একটা পর্যায় আসে যখন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ক্লান্ত ও বিমুঢ় হয়ে থমকে দাড়ায় একটা জায়গায়। এর ওধারে যাবার এখতিয়ার ও সাধ্য থাকেনা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির। দার্শনিকদের মধ্যে যারা সৎ ও বিবেকবান তারা ক্লান্তি ও হতাশার সাথে তাদের অসহায় অবস্থার কথাটা স্বীকার করে এবং বলে যে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উপর ভর করে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব নয় সত্যের নাগাল পাওয়া। বুদ্ধিবৃত্তির দর্প এভাবেই চূর্ণ হয়ে যায়। দর্শন তাই কেবল বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের নিষ্ফল হাতড়ে বেড়ানোরই ইতিবৃত্ত ছাড়া আর কিছু নয়।
বিজ্ঞানের কাজ বস্তু নিয়ে। কিন্তু মানুষ তো কেবল বস্তু নয়। মানুষের জীবনের অসংখ গুরুত্বপূর্ণ দিক ও বিভাগ আছে যেগুলি বিজ্ঞানের আওতার বাইরে। বিজ্ঞান ব্যস্ত বস্তুর ‘কি’ নিয়ে, ‘কেন’ নিয়ে নয়। অর্থাৎ তার কাছে সামান্য গুটিকয়েক জিনিষের কিছু বাহ্যিক বর্ণনা আছে মাত্র। তাদের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা বা তাৎপর্য কি বিজ্ঞানের তা জানা নেই। ব্যাখ্যা ও তাৎপর্যের কথা বলা বিজ্ঞানের সাধ্যের বাইরে। বিজ্ঞান বস্তু সম্মন্ধে অল্প একটু আধটু জানতে হয়তো পারে, কিন্তু বুঝতে পারেনা এসব বস্তুর অর্থ বা তাৎপর্য কি। জানা আর অর্থ বা তাৎপর্য বোঝা কখনো এক জিনিষ নয়। শুধু জেনে তেমন বড়ো একটা লাভ হয়না। তাছাড়া এই বিশ্বচরাচর সমন্ধে বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত যতোটুকু জানতে পেরেছে তা তো সামান্য একটা বালির কনার চেয়েও কম। তবে বিজ্ঞানও ইদানিং একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছে এবং নড়েচড়ে বসতে চাচ্ছে। বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান। রহস্যময় কথাবার্তা বলা শুরু করে দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞান। এমন কথাও বলছে যে একটা জিনিষ নড়েও না,আবার একই জায়গায়ও থাকেনা। এধরনের কথা ধর্মের কথার চেয়ে কি কম রহস্যময়? দেখা যাক পদার্থবিজ্ঞান আর কতদূর যায়।
অন্য কিছু যতোটুকু যা জানুক না কেন, বিজ্ঞান সবচেয়ে কম চেনে, জানে ও বোঝে মানুষকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এতো উন্নতি স্বত্তেও মানুষের দেহের খুব কম কথাই জানে। মন তো পড়েই থাকল। মনোবিজ্ঞান মানুষের মনের ও অন্তরের এ পর্যন্ত বলতে গেলে কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারেনি। মানুষ আজো পর্যন্ত বিজ্ঞানের কাছে এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য হয়ে রয়েছে।
যারা দাবী করে বিজ্ঞানের এই চরম উন্নতির যুগে ধর্মের আর কোণ প্রয়োজন নেই তারা না বোঝে বিজ্ঞান, না বোঝে ধর্ম। কিছু লেখাপড়া হয়তো তাদের থাকতে পারে। কিন্তু লেখাপড়া তাদের মূর্খতাকে দূর না করে বরং তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ও গভীর করেছে। এই শ্রেণীর লেখাপড়া করা মানুষগুলি নিজেদেরও শত্রু এবং অন্যদেরও শত্রু। লেখাপড়া করে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করা যায়, বাকপটু হওয়া যায়, কেউ কেউ হয়তো পণ্ডিতও হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু জ্ঞানী হওয়া যায় এমন কোণ নিশ্চয়তা নেই। অনেক কিছু জানা আর জ্ঞানী হওয়া দুটো ভিন্ন ব্যপার। লেখাপড়া করে সবাই সমান উপকৃত হয়না। জ্ঞানী হবার জন্য বেশি লেখাপড়া অপরিহার্য নয়। কারো কারো কোণ লেখাপড়াই লাগেনা। তাদের জন্য জীবন ও তার চারপাশে যা কিছু আছে সেটাই যথেষ্ট।
বিজ্ঞানের উপর ভর করে গড়ে উঠা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নিত্যনতুন কিছু ঠুনকো খেলনাই বানাতে জানে শুধু। মানুষের অন্তরের মৌলিক প্রশ্নের আশপাশ দিয়েও প্রযুক্তি হাঁটে না। হাঁটার সাধ্যও নেই এর। প্রযুক্তির হাতের বানানো এসব খেলনা বাসি হয়ে যায়, পুরানো হয়ে যায়, জরাজীর্ণ হয়ে যায়, নিশ্চিহ্ন যায়। এগুলি নিছক ঠুনকো খেলনা হলেও হয়তো একটা কথা হোত। কিন্তু তা তো নয়। এগুলি যে মহা সর্বনাশও ডেকে আনতে পারে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের হাত ধরেই তো এই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সব ধরনের প্রানের অস্তিত্ব মহা হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে। তেমন দিন কি মনে হয় আর খুব বেশি দূরে যেদিন চারিদিকে প্রযুক্তির প্রবল উৎকর্ষের মধ্যে দাড়িয়েই মানুষ করুন আক্ষেপ করে বলবে এর চেয়ে ভাল ছিল গরুর ও ঘোড়ার গাড়ি, পাল তোলা নৌকা ও জাহাজ, ফালের লাঙ্গল, হাতে বোনা তাতের কাপড়, ধীরস্থির ও শান্ত জীবন? বিশুদ্ধ একটু পানি ও নির্মল একটু বাতসের জন্য হাহাকার করার দিন তো ইতিমধ্যেই এসে গেছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ মানুষকে ও অন্য সবধরনের জীবনকে যেভাবে বিপন্ন করে ফেলেছে সে জন্য যেকোণ কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ একে অভিশাপ বলে গণ্য করতে বাধ্য। মানুষের মধ্যে যারা চিরকাল বেআক্কেল অবোধ শিশুই রয়ে যায় তারাই কেবল প্রযুক্তির হাতের এসব ঠুনকো ও বিপজ্জনক খেলনা নিয়েই নেশাগ্রস্থের মতো আমৃত্যু মশগুল ও তৃপ্ত থাকতে পারে।
এই নাবালকদের সাথে যোগ হয়েছে অর্থনীতির পণ্ডিতদের। এরা কেবল একটা জিনিষই বোঝে। বোঝে অবিরাম একটার পর একটা নিষ্প্রয়োজন উৎপাদন ও অপরিমিত ভোগ। মানুষের ভোগের চাহিদা বাড়িয়ে তোলা ও তা অব্যাহতভাবে মিটিয়ে যাবার ব্যবস্থার মধ্যেই নাকি রয়েছে অর্থনীতির প্রান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিই তাদের কাছে জীবনের সবকিছু। কিন্তু এটা যে কি সার্বিক ধ্বংস ও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে পৃথিবীর বুকে যাকিছু আছে তার সবকিছুর জন্য তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হতে চায়না। মানব সমাজের একটা বড়ো দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয় যে এই নেশাগ্রস্থ বেআক্কেল, দায়দায়িত্ব জ্ঞানহীন অবোধ শিশুদের হাতেই আজ পড়ে গেছে পৃথিবীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব। ধ্বংস ও বিপর্যয়ের নায়কেরা ভাবে তারা মানব কল্যান করে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক মতবাদ এতোই খেলো জিনিষ যে তা নিয়ে কথা খরচ করা একটা বিরক্তিকর কাজ। তবু যেহেতু এর পেছনে মানুষ খুব সহজেই ছোটে তাই দুএকটি কথা না বলে উপায় থাকেনা। মানুষের অন্তর যখন একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তখুনি কেবল সে রাজনৈতিক মতবাদের মধ্যেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান খোজে। মানুষের ইতিহাস যতটুকু জানা যায় তা থেকে বলা যায় একটার পর একটা রাজনৈতিক মতবাদ মানুষকে কেবল হতাশই করে এসেছে। প্রতিটি মতবাদই দেখা গেছে মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ ও ভঙ্গুর। কোনটিই মানব প্রকৃতি ও মানুষের যথার্থ প্রয়োজন ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারেনি এবং সে প্রয়োজন পুরনের উপযুক্ত পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারেনি। মানুষ বারবার আশাহত হয়েছে। পৃথিবীর কোণ রাজনৈতিক মতবাদ এ পর্যন্ত বুঝতেই চায়নি যে মানুষের অধিকাংশ সমস্যাই রাজনৈতিক নয়, সমস্যা মানুষের নিজের মধ্যেই। মানুষের আসল সমস্যা রাজনৈতিক নয়, আসল সমস্যা আধ্যাত্মিক। ব্যাধি বাইরে নয়, ব্যাধি মূলত মানুষের অন্তরে। আর সে ব্যাধির কোণ রাজনৈতিক চিকিৎসা নেই। আছে কেবল আধ্যাত্মিক চিকিৎসা। রাজনীতিবিদরা সে চিকিৎসার সন্ধান জানেনা। তাছাড়া রাজনীতিবিদরাই তো দেখা যায় সবচেয়ে বেশি ব্যাধিগ্রস্থ। তাদের নিজেদেরই চিকিৎসার প্রয়োজন অন্যদের চেয়েও বেশি।
শিল্পকলা? শিল্পকলার মধ্যে মোহনীয়তা আছে, মাদকতা আছে এবং কোণ কোণ ক্ষেত্রে সৌন্দর্য ও সুষমা আছে। শিল্পকলা মনকে কেড়ে নিতে পারে সহজে। কিন্তু জীবনের মৌলিক কোণ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা। শিল্পকলা বরং তার মোহনীয় মায়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলে মানুষের মনোযোগ জীবনের মৌলিক প্রশ্ন থেকে অন্যদিকে সরিয়ে দিতে সাহায্য করে অধিকাংশ সময়। শিল্পকলা বড়োজোর জীবনের কিছু ছবি তুলে ধরতে পারে। তাও খুব সামান্যই। বিশ্বচরাচরের কথা বাদই দিলাম। জীবনেরই অনেক ক্ষেত্র আছে, অনেক অভিজ্ঞতা আছে যার মধ্যে প্রবেশ করার সাধ্য কোণ শিল্পীরই নেই। তাছাড়া যে ছবি তুলে ধরা হয় তাও খুব নির্ভরযোগ্য হয় না। কারন শিল্পীর নিজস্ব আবেগ, অনুভুতি ও ঝোকপ্রবনতা থেকেই যায় তার শিল্পকর্মের মধ্যে। শিল্পীর সামর্থ্যও একটা গুরত্বপূর্ণ সমস্যা। বাস্তবতাকে পুরোপুরি বোঝা এবং একই সাথে সেটাকে কোণ একটা শিল্প মাধ্যমে পুরোপুরি তুলে ধরা মানুষের সাধ্যের বাইরে। শিল্পের মাধ্যমও একটা বড়ো সমস্যা। সব মাধ্যম দিয়ে সব কাজ হয় না। একটা দিয়ে যা হয় অন্যটা দিয়ে তা হয়না। কোণ মাধ্যমই সব কাজ পারেনা। অথচ শিল্পীকে সীমাবদ্ধতা দিয়ে ঘেরা কোন না কোণ একটি মাধ্যম নিয়েই কাজ করতে হয়। মোটকথা শিল্পকলার সীমাবদ্ধতা তিন ক্ষেত্রে। শিল্পীর নিজের জানার ও উপলব্ধির সীমাবদ্ধতা, তার প্রকাশ ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং যে মাধ্যম সে ব্যবহার করে সেই মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা। এতো সীমাবদ্ধতা যেখানে সেখানে আর বেশি কি আশা করা যেতে পারে? ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভুতি নির্ভর শিল্পকলা একটা চোরাবালি। মানুষের আবেগ ও অনুভুতির বিপজ্জনক প্রশ্রয় এর মধ্যে মেলে বলেই এটা একটা চোরাবালি হয়ে উঠে। সত্য ও বাস্তবতা আড়াল হয়ে যায় দৃষ্টি থেকে তখন। এই চোরাবালিতে ডুবে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বহু মানুষ । শিল্পকলা সহজে একটা আবেশ ও মুগ্ধতার ঘোর সৃষ্টি করতে পারে মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। এই আবেশ ও মুগ্ধতার ঘোরকেই যারা জীবনের পরম প্রাপ্তি বলে ভাবতে পারে তারাই কেবল শিল্পকলা নিয়ে বুদ হয়ে থাকতে পারে। শিল্পকলার যারা তপস্যা করে তাদের মনের মধ্যে যতোখানি আবেগের আতিশয্য ও আত্মবিলাসী চিত্তবিলাস আছে তার তুলনায় স্বচ্ছ বিচার-বুদ্ধি ও বিবেচনা অনেক কম আছে।
মহৎ শিল্পকলাও আছে। কিন্তু পরিমাণ তার খুব কম। মহৎ শিল্পের মধ্যে অন্যের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার তাড়না কাজ করেনা। শিল্পীর নিজের চেয়ে বড়ো কারো কাছে আত্মনিবেদনের তাড়না কাজ করে। মহৎ শিল্পের মধ্যে একটা প্রচণ্ড কাতর আকুতি থাকে শিল্পীর সবরকম সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে অন্য কোথাও যাবার। আকুতি থাকে একটা ভিন্ন পরিপূর্ণতার জগতে পৌছুবার। স্বীকৃতি মেলে শিল্পীর দীনতা, হীনতা ও অপূর্ণতার করুন অনুভুতির।
সুস্থ মাথায় ও দায়িত্বশীলতার সাথে চিন্তা করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে সমস্ত জ্ঞানের মালিক আল্লাহতা’আলার কাছ থেকে তার মনোনীত নবী ও রসুলের মাধ্যমে পাওয়া ‘ওয়াহি’ ছাড়া মানুষের জন্য কোণ সঠিক জ্ঞানের মাধ্যম নেই, ‘ওয়াহির’ মাধ্যমে পাওয়া জীবনে চলার পথ ছাড়া নেই কোণ সঠিক পথের সন্ধান। ঐশী ধর্মের তাই কোণ বিকল্প নেই এই পৃথিবীতে। হবেও না কোণদিন। ধর্ম যা দিতে পারে তা আর কোনকিছু পারেনা। মানুষের যোগ্যতা নেই ধর্ম তৈরি করার। সঠিক ও সার্থক ধর্মের জন্য যে সর্বব্যপি পরিপূর্ণ জ্ঞান প্রয়োজন তা কোণ মানুষের একক ভাবেও নেই, সামস্টিক ভাবেও নেই। কোণ কোন নির্বোধ অথচ অহংকারী মানুষ অবশ্য ধর্ম তৈরি চেষ্টা করে দেখেছে। কিন্তু তার মধ্যে এতো ফাঁকফোকর ও গোজামিল থেকে গেছে যে তা আর কোণ কাজে আসেনি মানুষের। ধর্ম রচনাকারী এ সব মানুষগুলি কেবল হাস্যাস্পদই হয়েছে শেষ পর্যন্ত। ধর্ম আসতে হবে এই সৃষ্ট জগতের যিনি মালিক এবং যার সব জানা আছে তার কাছ থেকেই। একমাত্র তিনিই জানের মানুষের কি প্রয়োজন, মানুষের জন্য কি উপযোগী। ধর্ম হতে হবে ঐশী।
ঐশী ধর্ম বলে স্বীকৃত যেসব ধর্ম আমাদের সামনে আছে তাদের মধ্যে ইসলামের প্রাধান্য তিনটি কারনে। এক, ইসলামের মূল দলিলদস্তাবেজ সব ঠিক আছে। কোণ কিছুই বিকৃত হয়ে বা হারিয়ে যায়নি। এই দাবীর জন্য যতো ঐতিহাসিক প্রমান প্রয়োজন সবই আছে। বলা যায় প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই আছে। ইসলাম যে ঐশী ধর্ম এবং তা যে একেবারে অবিকৃত অবস্থায় আছে এ নিয়ে সন্দেহ করার কোণ যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই। দুই, ইসলামের জীবন ব্যাখা পূর্ণাঙ্গ ও বিভিন্ন অংশের মধ্যে পুরোপুরি সঙ্গতিশীল। কোথাও কোণ ঘাটতি বা স্ববিরোধিতা নেই। তিন, ইসলামের মধ্যে যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যামুখী জীবনের সন্ধান পাওয়া যায় তা এতো ভারসাম্যপূর্ণ যে তার কোণ তুলনা মেলেনা। জীবনযাপনের যে ছক ইসলাম আমাদের কাছে পেশ করে তা ইসলামের মূল জীবন ব্যখ্যার সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ও একেবারেই পরিপূর্ণ। জীবনের কোণ একটা দিক উপেক্ষিত হয়নি এতে। যে জিনিষের যতোটুকু গুরুত্ব সে জিনিষ ঠিক ততোটুকুই গুরুত্ব পেয়েছে ইসলামে। ইসলামের ছোট থেকে বড়ো প্রতিটি বিধিবিধানই তার মুলের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত এবং নিজ নিজ স্থানে যথার্থ। এই তিনটি জিনিষ ইসলামে যেমন সন্তোষজনক ভাবে মেলে তেমন আর কোথাও মেলেনা।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে কিছু অর্বাচীন ও বেপরোয়া মানুষ আছে যারা মানুষের কাছ থেকে ইসলামকে কেড়ে নিতে চায়। মানুষকে তাদের সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে চায় তারা। মানুষকে আশ্রয় ও অবলম্বনহীন করে দিয়ে দিশেহারা ও উদ্ভ্রান্ত শরণার্থীতে পরিনত করতে চায়। এ ধরনের মানুষ আগেও ছিল, কিন্তু এখন তাদের সংখ্যা ও কাজ করার সুযোগ বেড়েছে অনেক। এই মানুসগুলির কিছু মিষ্টি মিষ্টি বুলি আছে। আর আছে কিছু কটু গালি। মিষ্টি বুলি পটানোর জন্য, কটু গালি যারা তাদের মিষ্টি বুলিতে পটেনা তাদের লাঞ্ছিত করার জন্য। আজ আমরা দিনরাত এসব মিষ্টি বুলি আর কটু গালি শূনতে পাচ্ছি। এদের মিষ্টি বুলিতে যারা ভুলেছে বা কটু গালিতে ঘাবড়ে গেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মানুষকে যারা ধর্মহীন করতে চায় তারা একটা বাস্তব সত্য সমন্ধে একেবারেই অজ্ঞ। তারা জানেনা মানুষকে ধর্মহীন করা যায় না কিছুতেই। কিছু না কিছু মেনেই মানুষকে জীবন চালাতে হয়। একটা কিছু বোধ বা ধারনা তাকে আঁকড়ে ধরতেই হয়। সেটা হতে পারে প্রচলিত বা সমসাময়িক ধ্যানধারণা বা তার নিজস্ব কামনা ও বাসনা বা এসবের সংমিস্রন। এটাই হয়ে দাড়ায় তার ধর্ম। ধর্ম নাম থাকুক না থাকুক তাতে বাস্তব সত্যের কোণ হেরফের হয়না। সঠিক ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে মানুষ নিজের মতো করে একটা জগাখিচুড়ী ধর্ম বানিয়ে নেবেই। উপাসনাও মানুষ না করে থাকতে পারেনা। কিছু না কিছুর প্রতি জীবনে সে অনুগত থাকবেই। তার জন্য বহু ত্যাগও সে স্বীকার করতে প্রস্তুত। সেটাই তার উপাস্য। সত্যিকার অর্থে নাস্তিক বলেও কিছু নেই। সে বুঝুক আর না বুঝুক, স্বীকার করুক আর না করুক, সেও কোণ কিছুকে সত্য জ্ঞান করে তার উপর অটল থাকতে চায়। সেটাই তার উপাস্য। নকল উপাস্যের কোণ অভাব নেই এই দুনিয়াতে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কাছের ও মধুর হচ্ছে মানুষের নিজের অহং। মানুষের ব্যপারে বাস্তব সত্য হোল হয় সে যথার্থ উপাস্যের উপাসনা করবে, না হয় সে অপাত্রের উপাসনা করবে, হয় সঠিক ধর্ম অনুযায়ী চলবে, না হয় সে বেঠিক একটা কিছুকে ধর্মের মর্যাদায় বসিয়ে তার উপর চলবে। আসল প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কি উপাসনা যার যথার্থ প্রাপ্য তার উপাসনা করবে, না নকল কিছুকে উপাস্যের স্থানে বসিয়ে তার উপাসনা করবে, সে কি সঠিক ধর্মকে তার জীবনের দিশারী হিসেবে গ্রহন করবে, না হরেক রকম ভ্রান্ত পথে ঘুরতে ঘুরতে জীবন পার করে দেবে। সঠিক উপাস্যের উপসনা না করলে এবং সঠিক ধর্মকে অনুসরন না করলে নকল উপাস্যের এবং ধর্মের ফাদে পড়তেই হবে মানুষকে। এর অন্যথা হবার উপায় নেই মানুষের জন্য। এটাই মানব নিয়তি। এই নিয়তির বাইরে যাবার সাধ্য নেই কোণ মানুষের।
দুনিয়া জুড়ে আজ একটা বিশাল বাজার বসেছে বাজে কথার। জাতিসংঘ থেকে সাধারন শিশু বিদ্যালয় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। বাজে কথার ব্যপারিরা বিপুল উৎসাহ ও উদ্যমে তাদের কথার পশরা সাজিয়ে সেগুলির দিকে ডাকছে মানুষকে। প্রচণ্ড ও অনর্গল এ বাজারের কোলাহল। কাজের কথা এখানে কিছু নেই, কিন্তু আয়োজনটা বিপুল ও জমকালো। কাজের কথা আছে কেবল ধর্মের কাছে। কিন্তু বাজে কথার এই অনর্গল কান ফাটানো ও উন্মত্ত কোলাহলে ধর্মের কণ্ঠ চাপা পড়ে যায় বা হারিয়ে যায়। ধর্মের অবশ্য তাতে কোণ ক্ষতি হয় না, ক্ষতি হয় মানুষের। মানুষ সঠিক পথ হারিয়ে ধ্বংসের পথে চলতে শুরু করে। এই মহা বিপদ থেকে বাচতে হলে বাজে কথার এ বাজারকে তার আপন স্বরূপে আমাদের চেনা দরকার। বাজে কথার এই বাজারের আকর্ষণীয় মোড়কে জড়ানো কোণ পশরা খরিদ করা থেকে আমাদের নিজেদের হেফাজত করা প্রয়োজন। মেহেরবান আল্লাহতা’আলা আমাদের সহায় হোন।
( লেখক বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, email –
[email protected] )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন