সাপ্তাহিকী
|
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
|
|
সুশীল ও টকশো সমাচার
15 Jun, 2013
সমাজের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ সাংবাদিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সহ বিভিন্ন পর্যায়ের অগ্রসর চিন্তার ধারকরা তাঁদের চিন্তা চেতনাকে মিডিয়ার মাধ্যমে জনগনের সামনে উপস্থাপন করেন । আর পাঠক সমাজ লেখকের লিখিত বিষয়ে পড়ে সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নমুখী সমাজ গঠনে অনুপ্রাণিত হন । এভাবেই পাঠক সমাদৃত ও সমাজ উন্নয়নে অনুপ্রেরণাদায়ক লেখকরা সমাজ রাষ্ট্রে চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন । রাষ্ট্রের নাগরিকদের চিন্তা-চেতনার স্তর উন্নয়নে বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য । বর্তমানে অসংখ্য বেসরকারী টিভির টকশোর বদৌলতে প্রায় প্রতিদিনই আমরা হরেক রকম চিন্তাশীল মানুষের চিন্তা চেতনা সম্পর্কে জানতে পারছি । টকশোর সন্মাণিত আলোচকরা তাদের আলোচনায় রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধান ও উন্নয়ন অগ্রগতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছেন, তা সমালোচনার দাবী রাখে ।
টিভি টকশোর আলোচকদের একটা বৃহৎ অংশের অগভীর চিন্তা-চেতনা, লেজুরবৃত্তি মানুষিকতা, প্রস্ততিহীন অত্যধিক উপস্থিতি এবং একই বিষয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে উপস্থাপনা যেমনি ওনাদের ব্যক্তিগত ইমেজকে সংকটে ফেলছে তেমনি শ্রোতা দর্শক হিসেবে আমরা বিভ্রান্ত ও বিরক্ত হচ্ছি । প্রায়শঃ দেখতে পাই ওনারা যতটা বর্তমান বা ভবিষ্যত নিয়ে বলেন তার চাইতে বেশী অতীত আশ্রয়ী বক্তব্য নিয়ে হাজির হন । এসব দেখে দেশ জাতির চিন্তার ঐক্য তৈরী করছে নাকি দেশ জাতিকে দ্বিধা বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করছে, তা অবশ্যই গবেষনার দাবী রাখে । টিভি টকশোর এই আলোচকদের মধ্যে যারা সরাসরি রাজনৈতিক দল ভূক্ত নয় আবার বুদ্ধিজীবির স্বীকৃতিও অর্জন করতে সক্ষম হননি, এমন সব চিন্তাবিদরা নিজেদের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ভাবতে ও বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ।
বেশ কিছু দিন পূর্বে এ ধরনের একজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি খ্যাত নবীন বুদ্ধিজীবির সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সুযোগে প্রশ্ন রেখেছিলাম গল্প, উপন্যাস, কবিতা, সংগিত বা নাটকের সমালোচনা লিখে দিতে পারবেন কিনা? উত্তরে বিনয়ের সাথে বললেন তুমিতো জান আমি শিল্প, সাহিত্য বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোক নই । আমার দ্বারা এই কঠিন কাজ সম্ভব নয় । অথচ আমার সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবি সাহেব রাজনীতির লোক না হয়েও টিভি টকশোতে রাজনীতির সমালোচনাতে সর্বদা মুখর এবং টিভি টকশোতে উপস্থিতি অনেকটা নিয়মিত । এতে আমার মধ্যে অন্য রকম আগ্রহ জন্মায়, রাজনীতি সত্যিই কি এতোটা সহজ বিষয় ! যা নিয়ে আমরা হরহামেশা মন্তব্য, তিরস্কার, আলোচনা, সমালোচনা করতে পারি । বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন, রাজনীতি বিজ্ঞান অন্য সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাইতে কঠিন । কারন রাজনীতিবিদরা একদিকে মাঠের জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হয়, আবার মাঠের রায় অনুকূলে আসলে রাষ্ট্রের আওতাধীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখাকে পরিচালনায় দক্ষতা দেখাতে হয় । তাই স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায় রাজনীতি সবচেয়ে কঠিন কাজ, কারন সব সহজ কঠিন জ্ঞান-বিজ্ঞানকে রাজনীতিবিদদেরই পরিচালনা করতে হয় ।
দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্য তা জানিনা, শুধু সুশীলরা কেন, হাটে মাঠে ঘাটে কমবেশী আমরা সবাই জেনে না জেনে রাজনীতিবিদদের তুলোধুনো করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্যবোধ করি না, ক্ষেত্র বিশেষ ফ্যাশন বলেও মনে হয়, কেউ কেউ আবার নিজেকে সুশীল প্রমানের কৌশল হিসেবে গ্রহন করেন ।
যাহোক, টিভি টকশোর সুশীলরা যে ভাষায় রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেন, তাতে মনে হয় রাষ্ট্রের সব ব্যর্থতায় দায় রাজনীতিবিদদেরই । রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের সমস্ত অর্জনকে ধুলিৎস্মাত করছেন । রাজনীতিবিদদের অর্জনের স্বীকৃতি না দিয়ে এভাবে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করাটা কতটা নৈতিক, তাও সমালোচনার দাবী রাখে, আমার বিবেচনায় ক্ষেত্র বিশেষ অনৈতিক মনে হয় । যে রাজনীতি আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলা, স্বাধীন ভূখন্ড, পতাকা ও স্বাধীন জাতির পরিচিতি দিয়েছে, সেই রাজনীতিই আজ হাজারো প্রশ্নবানে জর্জরিত । রাজনীতিবিদদের সাপাই লিখার জন্য বসিনি, বলতে চাই আমরা যে মাত্রায় অভিযোগ করছি, তা কতটুকু যৌক্তিক । রাজনীতিবিদদের নৈতিক স্খলন, নীতিহীন আচরণ, দল পরিচালনায় অগনতান্ত্রিক আচরণ ও ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা অবশ্যই সমালোচনার দাবি রাখে ।
শুধু তাই নয়, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির পারষ্পরিক বৈরী সম্পর্ক ও পরষ্পরকে বিশ্বাসে আনতে না পারা ও গনতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায় দূর্বলতার কারনে নির্বাচনে দল নিরপেক্ষ সুশীলদের নিয়ে নির্বাচনকালিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হয় । ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সবকটি সুশীল নির্ভর তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সফল ভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছেন, তাও বলা যাবে না । অথচ এ নিয়ে সুশীলদের সমালোচনা রাজনীতিবিদরা তেমনটা করেন না, একমাত্র বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে কদাচিৎ তির্যক মন্তব্য করেন । যা আমরা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেই না । যদিও সত্যিকার অর্থেই সেদিন সামরিক বাহিনীর কর্তা মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন, প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন ও কতিপয় ব্যক্তির ষড়যন্ত্রকে রুখতে ব্যর্থ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুশীল বুদ্ধিজীবি খ্যাত উপদেষ্টারা পদত্যাগের মত অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন ।
রাজনৈতিক দল গুলির যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা অর্জনকে রুখতে অরাজনৈতিক সুশীল নির্ভর তত্ত্বাবধায়ক সরকার উদ্ভাবন আমাদের দেশের রাজনীতিকরাই করেন । এক্ষেত্রে বাংলাদেশই পথিকৃত, যা বর্তমানে পাকিস্থান ও নেপাল গ্রহন করেছে । গনতন্ত্রমনা মানুষ মাত্রই বিশ্বাস করেন উন্নত গনতান্ত্রিক চর্চায় এ ব্যবস্থা ঠিক না । কারন একটি দলকে ভোট দিয়ে পাঁচ বৎসরের জন্য বিশ্বাস করলেও মেয়াদান্তে পরবর্তী সরকার নির্বাচন তদারকীতে বিশ্বাস রাখতে পারি না । কিন্তু উন্নত গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে একটি নির্বাচিত সরকার মেয়াদান্তে নির্বাচন পরিচালনা করে আরেকটি নির্বাচিত সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন । যা আমরা এখনও করতে সক্ষম হইনি, কিন্তু উন্নত গনতন্ত্র চর্চায় আমাদেরও ঐ পর্যায়ে যেতে হবে ।
বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক বাতিল করেছেন এবং উন্নত গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মত তাদের অধীনে নির্বাচন ও পরবর্তী সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক পরিবর্তন এনেছেন । বাস্তবতা হচ্ছে, কোন এক সময় আমাদের এই পরিবর্তন আনতেই হবে । সমস্যা হচ্ছে আমাদের গনতন্ত্র চর্চা, রাষ্ট্রের গনতান্ত্রিক কাঠামোগত ভিত ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী গনতান্ত্রিক কাঠামোতে দাঁড় করাতে পারিনি তাই তাবৎ গনতান্ত্রিক বিশ্বের উদাহরন দিয়ে বললেও আমরা কিন্তু এখনও তত্ত্বাবধায়কের অপরিহার্য্যতা কাটিয়ে ওঠতে পারিনি । আর এই মোক্ষম সুযোগটি সুশীলরাও হাতছাড়া করতে চান না, জীবনের কোন একটা সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রীসম উপদেষ্টা হয়ে রাষ্ট্র চালাতে চান । এই কারনে বা রাজনীতিকে অপছন্দ বা রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারনেই হোক, সুশীল নামক বুদ্ধিজীবিরা দল গুলোকে পরষ্পরের প্রতি অবিশ্বাসী বা বিভাজন তৈরীতে সহায়ক যুক্তিতর্কের প্রাধান্যতা নিয়ে টকশোতে হাজির হন । যা রাষ্ট্রের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও গনতন্ত্র বিকাশে অন্তরায় ।
ক্ষমতার প্রতি নির্মোহ ও সমাজ রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ প্রজ্ঞাবান সুশীল বুদ্ধিজীবিরা রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনাকে রাজনীতিবিদদের ধ্যান-জ্ঞানের বিষয় বলে মনে করেন । রাজনীতির দুর্বলতা ও জরাজীর্ণতা রাজনীতিবিদদেরই কাটিয়ে ওঠতে হবে, প্রয়োজনে সুশীলরা পরামর্শ দিবেন কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি পরিচালনায় আসবেন না । তবেই আমরা এগুবো, উন্নত গনতন্ত্রের ধারক বাহকের গৌরব অর্জন করব ।
লেখকঃ প্রবাসী, জাপান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন