সাপ্তাহিকী
|
ড. মঈনুল আহসান
|
|
শাসকের মিথ্যাচারে মানবতার বিপর্যয়ই কি এসময়ের বাস্তবতা
15 Jun, 2013
পানিতেই বাঁচে প্রাণ। পানি পাণ করাবিনা টেকে না মানুষেরজান। কিন্তু সেই পাণ করা পানিই হতে পারে মানুষের মরণের কারণ যদি তা হয় দূষিত। একই ভাবে যে মানুষ গড়ে তুলতে পারে সুমহান সভ্যতা, সৃষ্টি করতে পারে মহা আদর্শ। সেই মানুষই হতে পারে সভ্যতার ঘাতক, সৃষ্টির প্রতি মহা উৎপীড়ক যদি তার মধ্যে ঢুকে পড়ে দূষণ। সেই মানবিক দূষণের প্রধান পাথেয় বোধকরি মিথ্যাচার। আগুন যেমন কাঠকে পুড়িয়ে করে কয়লা তেমনি নির্লজ্জ মিথ্যাচারের নিয়মিত অনুশীলনও মানুষকে পরিণত করতে পারে রক্ত-মাংসের শয়তানে।এহেন দূষিত মানুষই যখন হয়ে ওঠে শাসক তখন সেখানে কোন আশা আর অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে তেমন শাসকেরাই আজ জাঁকিয়ে বসেছে বিশ্বের অধিকাংশ মসনদে। এরা নির্বিচারে পদ দলিত করে চলেছে মানবতাকে। অর্থহীন করে তুলছে সভ্যতার সব অর্জনকে।
জঘন্য মিথ্যাচার ছিল বুশ-ব্লেয়ারের শুরু করা চলতি মানব হত্যাযজ্ঞের প্রধান কারক যা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি এখনো।যে মহা মারণাস্ত্রের (উইপন অব মাস ডেস্ট্রাকশন) ধুঁয়া তুলে শুরু করা হয়েছিল এই হত্যাযজ্ঞ সেটাই ছিল বরং একটা মহা মিথ্যাস্ত্র। এমন মিথ্যাচার এই মহাবিশ্ব বোধকরি দেখেনি আর কখনো। একই মিথ্যাচার প্রতি মূহুর্তে করা হচ্ছে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ইসরাইলকে নিয়ে। এরা যখন বিশ্ব দরবারের কথিত সব নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নির্বিচারে বোমাবাজি করে আশেপাশের রাষ্ট্রগুলোতে তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে জাতিসংঘ পর্যন্ত তাকে সমর্থন করে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে। কিন্তু আক্রান্ত দেশ ও মানুষেরও যে কিছুঅধিকার আছে সে কথা এড়িয়ে যাওয়া হয়মৃদু হাসির আড়ালে, কূটনৈতিক কথামালার মারপ্যাঁচে।এ এক মর্মান্তিক অবিচার, নির্মমপরিহাস।
শাসক সমাজের এহেন মারপ্যাঁচের মিথ্যাচার পরিশীলিত হতে হতে এখন এমনই এক উচ্চতায় পৌঁছেছে যে মিথ্যাচার করা হচ্ছে প্রকাশ্যে, লক্ষ-কোটি মানুষের মানুষে সামনে, এমনকি শপথের মঞ্চেই। বিহ্বল পাবলিক সহসা ধরতেও পারছে না বুঝতেও পারছে না যে কোথাকার পানি গড়াচ্ছে কোথায়।এহেন ঘটনা বিশ্ববাসী দেখেছে প্রেসিডেন্ট ওবামার এবারের শপথ অনুষ্ঠানে। এবার তিনি শপথ নিয়েছেন দু দুটো বাইবেলের উপর হাত রেখে। কিন্তু শপথের পরপরই বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন সেই বাইবেলের বাণী। বলেছেন সমকামীদের অধিকার বিষয়ে তার আবেগ আপ্লুত আগ্রহের কথা। এটা কোনঅনিচ্ছাকৃতভুল ছিল না। এটা ছিল সজ্ঞানেসব জেনে শুনে বাইবেলের বিপরীতে অবস্থান নেয়া। প্রকারান্তরেনিজের শপথের গ্রন্থ বাইবেলকেই অস্বীকার করা। তথা নিজের শপথকেও অস্বীকার করা।
বড় দেশের বড় বড় নেতাদের এমন প্রতারণা ও মিথ্যাচারে অনুপ্রাণিত হয়েই বোধকরি আমাদের দেশের নেতারাও ইদানীং নেমে পড়েছেন বল্গাহীন মিথ্যাচারে। অসংখ্য নেতার ছোট্ট এই দেশের রাজনীতিতে আগেও মিথ্যাচার ছিল, ছিল প্রতারণাও। বর্তমান বিরোধী দল নেত্রীও গত মেয়াদে ক্ষমতায় বসেই ষাট মন্ত্রীর কেবিনেট বানিয়ে প্রতারণা করেছিলেন জনগণের সাথে। সেটাকে আবার ষোল কলায় পূর্ণ করেছিলেন অর্বাচীন পূত্রধনকে নিয়ে মাতামাতি করে। কিন্তু এখনকার মত সমস্ত বিবেক বর্জিত,দেশ- কাল ও জনস্বার্থের চরম পরিপন্থী এমন নির্লজ্জ ও জঘন্য মিথ্যার বেসাতিছিল না সেটা। বস্তুত এর আগে এ দেশবাসীবোধকরি আর কখনই দেখেনি বর্তমানের মত এমন শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি। চলমান এই বেসাতিতেআদ্যোপান্ত জড়িয়ে পড়েছে দেশের আইনজীবী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সমাজের ঊর্ধ্বতন সকল স্তরের মানুষ। আর এদের নেতৃত্বে রয়েছেন স্বয়ং দেশের সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যাচারই বস্তুত সংক্রামিত হয়েছে দেশের অন্যসব শীর্ষ স্থানীয়দের মধ্যে। কারণ মাথাতে পচন ধরলে পরেই তা শুধু শরীরের অন্যত্র ছড়াতে পারে, অন্যথায় নয়।
ইহুদী ও তাদের বন্ধুদের প্রতারণা, শঠতা ও মিথ্যাচার জগতবিখ্যাত। ঐসব অনাচার বস্তুত তাদের মজ্জাগত। তাই তাদের কর্মকাণ্ডে কেউ বিস্মিত হয় না। বরং তাদের কাজ ও বক্তব্যের উল্টোটাই যে সত্য তা সবাই বুঝে নেয় অনায়াসে। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণই ভিন্ন।যে কোন পরিস্থিতিতে একজন মুসলমানের মিথ্যাচার খুবই অবাস্তব এবং অগ্রহণযোগ্য। তাই এদেশের মুসলিম নামধারী শাসক শ্রেণীর ইদানীং কালের মিথ্যার পসরাদেশে-বিদেশে কোথাও-ই পাত্তা পাচ্ছে না এক বিন্দুও। কিন্তু তারপরও ক্ষমতাসীনদের হুঁশ হওয়ার কোন লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
আমদের প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যাচারে সর্বশেষ পরিণতি রক্তস্নাত মতিঝিল। পাকি হানাদারদের মত একই ভাবে একই বর্বর হিংস্রতায় তিনি তার বাহিনীকে নিশুতি রাতের আঁধারে লেলিয়ে দিয়েছেন নিরস্ত্র আল-কোরআনের শিক্ষক ওতার হত-দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উপর। এরদ্বারা তিনি প্রমাণ করেছেন শান্তি ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কথা বলে এতদিন তিনি যত গলাবাজি করেছেন তার সবই ছিল মিথ্যা। নির্ভেজাল লোক দেখানো। তিনি যদি সত্যবাদী হতেন তার কথায় তা হলে অবশ্যই তিনি সমস্যার স্বস্তিদায়ক সমাধানের পথে হাঁটতেন।ঘুমন্ত দেশবাসীর রাতকে যুদ্ধকালীন বিভীষিকার আতংকে আতংকিত করে তুলতেন না গুলি, বোমা আর গ্রেনেডের তাণ্ডবে।
প্রধানমন্ত্রী মূলত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েইসৃষ্টি করেছেন আজকের এই পরিস্থিতি। নিজেতত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘাড়ে সাওয়ার হয়ে ক্ষমতায় এসে দিনের পর দিন ধরে সেই তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত সমস্যাকেই টেনে নিয়ে চলেছেন অনির্বাচিত কারো হাতে ক্ষমতা দেবেন না বলে। কিন্তু সেই তিনিই আবার পার্লামেন্টের স্পিকার করেছেন ইলেক্টেডদের বাদ দিয়ে সিলেক্টেড একজনকে। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি নির্বিকারে বলেছেন রানা তার দলের কেউ নয় অথচ বিশ্ব মিডিয়াতে প্রচারিত ভিডিও ক্লিপে রানাকে দেখা যাচ্ছে হুড খোলা গাড়ীতেক্ষমতাসীনদের বিশাল মিছিলের নেতৃত্বে। একই ভবে রাজধানীর প্রকাশ্য রাজপথে চাপাতির পৈশাচিক কোপাকুপিতে নিহত বিশ্বজিতের হত্যাকারীদেকেও বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে তারা ছাত্রলীগের কেউ নয় বলে। অথচ পত্রিকার ছবি, টিভি ফুটেজে তাদের খুনিআওয়ামী চেহারা ছিল স্পষ্ট। কি নিদারুণ এইসব মিথ্যাচার। হাজার হাজার মাইল দূরের প্রবাসীদের আরামের ঘুমকেও হারাম করে দিয়েছে আওয়ামী নেতৃত্বের এই সব জালিয়াতি, প্রতারণা আর স্বেচ্ছাচারিতা।
আওয়ামী শাসনের সাথে এইসব অপকর্মেরআত্মীয়তা যেন আজন্ম কালের। এরা যেন একে অপরেরঅবশ্য পরিপূরক।একের সাথে অন্যে যেন অষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা। কয়লা থেকে সরানো যায় না যেমন কালোকে আর ময়লাকে আওয়ামী লীগ থেকেও যেন আলাদা করা সম্ভব নয় শঠতা, মিথ্যাচার আর অপশাসনকে। এদের দ্বারা শাসিত সত্তুর দশকের প্রথমার্ধ মানবতার ইতিহাসে এখনো হয়ে আছে এক কালো অধ্যায়। একই ভাবে তাদের কারণে নব্বইয়ের শেষার্ধও হয়েছে ব্যাপক ভাবে সমালোচিত। ক্ষমতার মত ক্ষমতার বাহিরেও এরা দেশ, জাতি ও মানবতার জন্যে একই রকম বিষাক্ত। এদের নির্দেশিত শত শত দিবসের হরতাল-অবরোধের নৈরাজ্যে এদেশের কত মানুষ যে কত ভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছে তার হিসেব করাটাও বোধকরি অসম্ভব। আর রাষ্ট্রর ক্ষতি তো বলাই বাহুল্য। ক্ষমতায় গিয়েও বিরোধী দলকে অযথাই বাধ্য করে হরতালের সেই ধারা তারা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করেছে অদৃশ্য কোন এক কারণে। আওয়ামী লীগেরএ পর্যায়ের ক্ষমতাকালে এরই মধ্যে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে এক ঘরে। এদের বিচিত্র ও বিতর্কিত সব নীতিমালা ও কর্মকাণ্ড ধিক্কৃত ও বিপর্যস্ত করে তুলেছে সমগ্র জাতিকে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে আগেরবার ক্ষমতায় থেকে বহু কসরত করেও যে সব খায়েস তারা পুরো করতে পারেনি সময়ের অভাবে তা এবার তারা সুদে-আসলে পূরণ করে ছাড়বে যে কোন মূল্য।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ভয়াবহ মিথ্যাচার হলো তাদের ‘হিডেন এজেন্ডা’ বা গোপন কার্যকলাপ। জাতিকে অন্ধকারে রেখে পরিচালিত তাদের বিবিধ কর্মকাণ্ড ব্যাপক ভাবে আলোচনায় এসেছে বারবার। তাদের এইসব অলিখিত গোপন মিশনগুলোর লক্ষ্য যে ইসলাম ও মুসলিম নিধন ও অবদমনতার নিদর্শনগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। নব্বই ভাগ মুসলমানের এই দেশে রাজনীতি করে দিন গুজরান করার পরও তারা যে কি রকম ভয়ংকর মুসলিম বিরোধী মিশন বাস্তবায়ন করে চলেছে এই মাটিতে তার একটা অকাট্য প্রমাণ অনেকটা বছর ধরে জমা পড়ে আছে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে।
সময়টা ছিল ১৯৯৭। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে দীর্ঘ বিরতির পর তখন আবার ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। নতুন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অনেক দক্ষ জনবল দরকার। বিজ্ঞাপন করা হয়েছে সেই মোতাবেক। সাথে সাথেই দরখাস্ত করলাম। দেখা গেল যোগ্যতার বিচারে আমার নিয়োগ অবশ্যম্ভাবী। তাই বেশ উৎসাহের সাথে বিভিন্ন বিভাগের পরিচিত-অপরিচিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক একাডেমিক অবস্থার উপর একটা সাধারণ ধারণা নেয়ার চেষ্টা করলাম। অল্প সময়েই বেশ ভাব হয়ে গেল অনেকের সাথে। আলাপচারিতার ফাঁকে তাদের প্রায় সবাই আমাকে একটা কমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। জানতে চাইলেন চাকুরী প্রার্থীদের মধ্যে কোন হিন্দু আছে কিনা। খুবই অবাক করা প্রশ্ন। প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম যারপর নাই। উত্তর দেয়ার বদলে উল্টো জানতে চেয়েছি এ প্রশ্নের কারণ কি। জবাবে তারা যা বলেছিলেন তা আমার মনে থাকবে আমৃত্যু। তারা জানালেন সরকারের কাছ থেকে অলিখিত ও অঘোষিত নির্দেশ আছে প্রার্থী তালিকায় কোন হিন্দু থাকলে অন্য কাউকে কোন অবস্থাতেই চাকুরীর জন্যে বিবেচনা করা যাবে না। বলাই বাহুল্য যে চাকুরীটা আমার হয়নি।
ঘটনাটা ছিল চরম সাম্প্রদায়িকতার প্রকৃষ্ট নমুনা।মুখে ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় বড় কথা বললেও আওয়ামী লীগ যে আসলে জাতিকে সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে সংগোপনে তা নিজের ঐঅভিজ্ঞতা না হলে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হতো।উল্লেখ্য যে ঐ সময় খুবির ভিসি ছিলেন বুয়েটের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। আওয়ামী সমর্থনে পুষ্ট এই ভিসির পক্ষে যে কি করা সম্ভব তা ভালভাবেই বুঝেছিলাম সেদিন। তাইবুয়েট জুড়ে এখনতিনি কেন যে এতটা ঘৃণিত তা আমার অন্তত বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না।
সরকারি গোপন মিশনের পাশাপাশি দলের সব শ্রেণীর এমপি, মন্ত্রী, নেতা কর্মীদের প্রকাশ্য ও গোপন কর্মকাণ্ডও প্রতিটি আওয়ামী শাসনের যেন অতি অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গ। সরকারি মন্ত্রণালয়-বিভাগগুলো থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি অলি-গলির পান-বিড়ির দোকানগুলো পর্যন্ত এদের শাসনামলে তোলার জন্যে ভাগাভাগি হয়ে যায় দলীয় নেতা-নেত্রী আর ক্যাডারদের মধ্যে। এদের সর্বভুক চাহিদা জেঁকে বসে দেশের উপর, দেশের প্রতিটি নাগরিকের উপর। ঊর্ধ্বতন-অধস্তন, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে পর্যন্ত এরা পরিণত করে ছাড়েকলুর বলদে। এদের অত্যাচারে ক্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও আর যাওয়ার জায়গা থাকে না কোথাও। দেশকে সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভক্ত করে ব্যক্তি ও দলের লাভালাভের পথ সুগম করতেই সম্ভবত প্রতিটি আওয়ামী সরকারকে অতিমাত্রায় তৎপর ও ব্যস্ত দেখা যায় সার্বক্ষণিক প্রশাসনিক রদ-বদলে। সৎ ও মেধাবী অফিসাররাঅব্যাহত ভাবে টার্গেট হয়ে থাকে, ওএসডি হয় অথবা চাকুরী হারায় এদের কুটিল সব অপতৎপরতায়। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনকে মেধা শূন্য করতে হেন পন্থা নাই যা এরা প্রয়োগ করে না। বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, তৎপরবর্তি সামরিক বাহিনী শুদ্ধিকরণ এবং সিভিল প্রশাসনের শত শত ওএসডি অফিসার হলো সেই আওয়ামী পন্থাসমূহের মোটা দাগের উদাহরণ। এছাড়াও আছে ছোট-খাটো আরো অসংখ্য মানবেতর উদাহরণ যা নিরীহ ব্যক্তি কেন্দ্রিকহওয়ায় রয়ে যায় নিভৃতে, লোকচক্ষুর আড়ালে।তেমনই একটা বিকটপ্রশাসনিক অত্যাচারের নমুনা দেখেছিলাম আমি নিজে।
আমার অতি পরিচিত এক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাশিকার হয়েছিলেন অভাবিত এক আওয়ামী অত্যাচার ও অবিচারের। দেশের তৎকালীন শক্তিমান ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বয়ং রাষ্ট্র ও সরকারের সমস্ত আইন-কানুন উপেক্ষা করে কয়েকজন অধস্তনসহ ঐ কর্মকর্তাকেচাকুরিচ্যুত করেছিলেন শুধুমাত্র তার নির্দেশ মত সরকারি ভাণ্ডার থেকেদলীয় নেতাকে প্রয়োজনীয় তোলা না দেয়ার কারণে। ওখানেই থেমে থাকেননি সেই স্বৈরাচারী আওয়ামী ভাইস প্রেসিডেন্ট। নিজের ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে ঐ সব প্রবীণকর্মকর্তাদেরপ্রাপ্য সমস্ত সুবিধাদিও বাতিল করে দিয়েছিলেন তাৎক্ষণিক এক নির্বাহী আদেশে।চাকুরী ক্ষেত্রে কোন অনিয়ম বা অবিচার হলেদেশের আইনেসরকারি কর্তারাসাধারণত সুরক্ষা পেয়ে থাকেন। এ বিষয়ে রয়েছে বেশ শক্ত আইন। অবিচার প্রমাণিত হলেক্ষেত্র বিশেষে চাকরিজীবীর অনুকূলে সরকারকে গুণতে হয় বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণ। চাকুরিচ্যুত ঐ কর্মকর্তারও ছিল সেই সুযোগ। পদস্থ কর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ বিভাগীয় সহকর্মীরা ভাইস প্রেসিডেন্টের আদেশের পাশ কাটিয়ে এমন ভাবে তার টার্মিনেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন যাতে কেস করা মাত্রই উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সহতিনি উদ্ধার করতে পারেন তার হারানো চাকুরী। ভদ্রলোক সেভাবেই কাজ করেছিলেন। কেস করেছিলেন যথাযথ ভাবে। বিজয় চলে এসেছিল তার হাতের মুঠোয়। শুধুমাত্র কোর্ট প্রসেসিং শেষ হওয়াটা ছিল বাঁকি। এরই মধ্যে ঘটলো অভাবিত ও অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। সুরক্ষিত কোর্ট থেকে হারিয়ে গেল ভদ্রলোকের কেস ফাইল এবং তা হারালো চিরদিনের জন্যে। সেই ফাইলের অস্তিত্বই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি কখনো কোথাও। ভদ্রলোকের ভাগ্য ভালো যে তিনি আওয়ামী শাসনের প্রথম আমলে নির্যাতিত হয়েছিলেন। আজকের এই ডিজিটালযুগের কর্মকর্তা হলে শুধু ফাইল নয় সুনিশ্চিত ভাবে তিনি নিজেই হাওয়া হয়ে যেতেন চিরতরে।
আওয়ামী সরকারেরঐসব প্রকাশ্য ও গোপন মিশনগুলো এখন যে চলছে আরো ঝড়ো গতিতে তা বলাই বাহুল্য।সেগুলোকে নির্বিবাদে লালন করে এদেশের মাটিতে পোক্ত করতে আমরা নিকট অতীতে আদালতকে লক্ষ্য করে ঝাড়ু মিছিলও হতে দেখেছি। সরকারের জাঁদরেল মন্ত্রীকেই দেখা গেছে সেই ঝাড়ু মিছিলের নেতৃত্বে। একই লক্ষ্যে পরিচালিত কার্যক্রমেইদানীং যুক্ত হয়েছে এক ডিজিটাল মাধ্যম, জাগরণ মঞ্চ যার নাম। এই মঞ্চ ঘনিষ্ঠরা দিনের পর দিন ধরে জড়িত ছিল কোরআন আর নবীজীর অবমাননায়। মাসের পর মাস ধরে সরকার নির্বিকার দেখেছে তাদের সেই অনলাইন বিকৃতাচার। অথচ মাঠে নামা মাত্রইসেই তাদেরকেই তুলে নিয়েছে কোলে, পরম জামাই আদরে। সার্বিক ব্যবস্থা করেছে তাদের থাকা-খাওয়া আর গান-বাজনার। সেই সরকার প্রধানই আবার নিজেকে দাবী করছেন সাচ্চা মুসলমান হিসেবে। মূর্তি বানানোর অজুহাত হিসেবে তিনি বাঙ্গালকে দেখাচ্ছেন সৌদি আরব। অথচ প্রতিটি মুসলমানের জন্যে নির্দেশ হলো শুধুমাত্র কোরআন ও সুন্নাহ মেনে চলা কোন দেশকে নয়।এই তিনিই দেশের নব্বই শতাংশ মুসলমানের মতামতের কোন তোয়াক্কা না করেই সংবিধান থেকে মুছে দিয়েছেন ‘বিসমিল্লাহিররাহমানির রাহিম’ যা কিনা ছিল মদিনা সনদের প্রথম বাক্য। এরপরও দাবী করছেন মদিনা সনদ মোতাবেক দেশ পরিচালনার। কি ভয়াবহ মিথ্যাচার। কি ভয়ংকর এইসব প্রতারণা। এইসব মিথ্যাচারের বিচারে কি আল্লাহ পাক অপেক্ষা করবেন কেয়ামত পর্যন্ত?অতীতের শক্তিমত্ত দানবীয় শাসকদের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না।
সরকারের সাথেজাগরণ মঞ্চের সখ্য কখনই কারো অজানা ছিল না। অজানা নয় এই মঞ্চের প্রতি সরকার প্রধানের প্রকাশ্য অনুরাগও। অনুরাগের তাড়নায় তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে ব্যক্ত করেছেন মঞ্চে যাবার বাসনা। প্রদীপ জ্বালিয়েমঞ্চের সাথে জানিয়েছেন সঙ্গতি। রাজনীতিতে বহু বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আমাদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে রাগ-অনুরাগের এহেন তাড়না যারপর নাই বিস্ময়কর। কিন্তুনিজের ঔরসজাত বেয়াদব সন্তানের মত সেই মঞ্চই যখন হামলে পড়েসরকারের উপর, সরকার আক্রান্ত হয় মঞ্চ নেতাদের কঠোর বাক্যবাণে। তখননড়েবসে সরকারের। জেগে ওঠে রণ হুংকারে।সরকারের ভেতর থেকে দাবী ওঠে মঞ্চ ভেঙ্গে দেয়ার। স্বয়ংসরকার প্রধানও ব্যক্ত করেন ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া। তিনি মঞ্চ নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেন বাস্তবতা না বোঝার জন্য এবং সবাইকেউপদেশ দেন পরিস্থিতি উপলব্ধি ও বিবেচনা করে রাজনীতি করার।বাস্তবতার নিরিখে বলতে গেলে বলতে হয় যে রাজনীতিতে নবিশ তরুণদের আবেগ তাড়িত ধমকের আগেই যদি আমাদের ক্ষমতাবানবিজ্ঞ রাজনৈতিকদের মধ্যে বাস্তবতা উপলব্ধির এই বোধটাজাগ্রত হতো তাহলে সেটাই হতো তাদের জন্যে বেশী সম্মানজনকএবং জাতির জন্যেঅধিক মঙ্গলময়।
কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে মঞ্চ ও সরকারে মধ্যে ধমকা-ধমকি বা ভাঙ্গা-ভাঙ্গিরপর্বগুলো সবই সম্ভবত পাতানো খেলা নতুবা ক্ষণিকের রাগ-বিরাগের অধ্যায় মাত্র। কারণ মঞ্চ মুখপাত্রকে নিয়মিতই দেখা যাচ্ছে পত্রিকার পাতায়। তারা এখন মিটিং করছে আরও সুরক্ষায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে। আমাদের প্রিয় বিদ্যাপীঠ যেখানে অগণিত মুক্ত চিন্তার পথিকের মত এক সময় আমারও কেটেছে অজস্র সকাল, সন্ধ্যা, রাত সেই মহান বিশ্ববিদ্যালয় আজ দলীয় চিন্তা ও চেতনাকেধারণ ও বহনে হচ্ছে বাধ্য। বড়ই হূদয়বিদারক এই দৃশ্য। কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এই অবস্থা।
বলা অনাবশ্যক যে অতীতের মত আওয়ামী শাসনেরএই আমলেওআমাদের দেশে একের পর এক ঘটে চলেছে অবিশ্বাস্য যেসব ঘটনাবলী এসবের কোনটাই বাস্তবতা বুঝে রাজনীতি করার নমুনা নয়। অর্থাৎ নিজের গর্ভজাত জাগরণ মঞ্চের ধমক খেয়ে প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছিলেন, যে উপলব্ধি বোধ তার হয়েছিল বলে মনে করা গিয়েছিল সেটাও ছিল মূলত মিথ্যা।
এতসব সীমাহীন মিথ্যাচার,অত্যাচার আর প্রতারণার মাঝেও চরম সত্যের যে আলোকচ্ছটা দীপ্যমান তা স্পষ্টতই বলে দিচ্ছে যে মিথ্যার দিন ঘনায়মান। কোন মিথ্যাই টেকেনি অতীতে তা সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন। এটাই বিশ্বজনীন বাস্তবতা। এই শেষ সময়েও যারা ব্যর্থ হবে সেই বাস্তবতা বুঝতে তাদের করুণ পরিণতি আল্লাহ পাক অবশ্যই ভুক্তভোগীদেকে দেখিয়ে দেবেন তাদের রক্তাক্ত অন্তরগুলোকে শীতল করার জন্যে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লস এঞ্জেলস, ইউএসএ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন