ক·
এই লেখাটা যখন লিখছি তখন সময় রাত দুইটা পঁয়ত্রিশ। মনটা চরম বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন। কোন কিছুই ভালো লাগছেনা। অফিসে বসে (কাজ নেই) তারা মিউজিকে আজ সকালের আমন্ত্রণে অভিনেত্রী ও শিল্পী স্বাগতা মুখার্জীর জনপ্রিয় গান শুনছি। সন্ধ্যা থেকেই মনটা খারাপ। একমাস পেরোল, কাজ নেই বসে আছি। অনেক শুভাকাঙ্খীর ফোন ও প্রশ্নে (কবে তোদের টিভি চালু হবে ?) কোন উত্তরই আমি দিতে পারিনি।
খ·
এর আগে আরো একটা খবর পেলাম। গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ১৫ ধাপ অবনমন। খবরটা দেখে মনটা কেমন থাকার কথা পাঠক, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। খবরে বলা হয়েছে, বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের ১৫ ধাপ অবনমন ঘটেছে। এ সূচকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৪৪তম, যা গত বছর ছিল ১২৯তম। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস নামের একটি সংগঠন প্রতি বছর এ সূচক প্রকাশ করে থাকে। সংগঠনটি জানায়, গণমাধ্যম সংক্রান্তô আইন এবং সাংবাদিকের নিরাপত্তার দিকগুলো বিবেচনায় এই সূচক তৈরি করা হয়। এছাড়া সূচকে বিভিন্ন দেশের অবস্থানের হেরফের বিচার করা হয় মূলত বিভিন্ন নাটকীয় রাজনৈতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে। কারণ গত বছর আরব বসন্তôসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্থান-পতন ঘটে। তবে এ বছরের সূচকে এরকম কোন নাটকীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েনি। এবারের সূচকটি তৈরি করা হয়েছে মূলত মাঝারি এবং দীর্ঘ মেয়াদে কোনো দেশের সরকার সে দেশের গণমাধ্যমের সাথে কী ধরনের আচরণ করছে বা ভবিষ্যতে কী ধরনের আচরণ করার অভিপ্রায় করছে তার ওপর ভিত্তি করে। এ সূচকে এ বছর শীর্ষে অবস্থান করা তিনটি দেশ হচ্ছে- যথাক্রমে ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ড এবং নরওয়ে। আর সর্বনিম্নে অবস্থান করা তিনটি দেশ হচ্ছে- শেষদিক থেকে যথাক্রমে তুর্কমেনিস্তôান, উত্তর কোরিয়া এবং ইরিত্রিয়া। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস’র রেকর্ড অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের ইতিহাসে ২০১২ সালটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। এ বছর প্রচুর সাংবাদিক নিহত হন। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ২৩ জন সাংবাদিক এবং ৯ জন নেটিজেন ও সিটিজেন সাংবাদিক নিহত হয়। আর ১৭৮ জন সাংবাদিক এবং ১৬৩ জন নেটিজেনকে কারাবন্দি করা হয়। বাংলাদেশের সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রম্ননি হত্যার কথা উলেস্নখ করে অভিযোগ করা হয়, তাদের বিচার কাজ অগ্রসর হচ্ছে না। রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায়ই সাংবাদিকরা পুলিশের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। [ সূত্রঃ ০৪ জুন,২০১৩, আরটিএনএন ]
গ·
এহেন পরিস্থিতিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আমার দেশ, দিগন্তô টিভি, ইসলামিক টিভি, চ্যানেল ওয়ান, যমুনা টিভি চালু, সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি, সাগর-রম্ননী হত্যার বিচার দাবি ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচির দুই সপ্তাহেরও বেশি দিন অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) যৌথ উদ্যোগে গত ২০ মে থেকে দু’প্তাহেরও বেশি সময় ধরে লাগাতার এ কর্মসূচি পালন করে আসছে সাংবাদিকরা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। নেই কারো মাথা ব্যাথা। এতগুলো সাংবাদিক কর্মচারী বেকার হলো কে দিবে এর উত্তর ?
ঘ·
এবার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যম সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় যখন চারটি বাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়। সে সময় দুর্নীতি পরায়ণদের উলস্নাসনৃত্য প্রকাশ করে কোপানলে পড়েছিলো সাপ্তাহিক খবরের কাগজ। সমালোচনা সহ্য করেননি স্বৈরশাসক এরশাদ। বন্ধ করে দেয়া হয় খবরের কাগজ। উলস্নাসনৃত্যের লেখককেও নানা হয়রাণীর মুখোমুখেী হতে হয়। তবে বন্ধ করে দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ আদালতে যায় খবরের কাগজ। আইনী লড়াইয়ে জয় লাভ করে ফিরে আসে পত্রিকাটি। যার ফলস্বরূপ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক আমলে সংবাদপত্র স্বাধীনতার প্রশ্নে এগিয়ে যায় বহুদূর। সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণের ধারা উঠিয়ে দেন এই প্রধান বিচারপতি। এরপর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সংখ্যার দিক থেকে বিস্ফোরণ ঘটে মিডিয়ার। প্রতিদিনই বাড়তে থাকে সংবাদপত্রের সংখ্যা। সর্বশেষ দুই আমলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের উদ্বোধন হতে থাকে ক’দিন পরপরই। দুই ডজনেরও বেশি টিভি চ্যানেল এখন সক্রিয় বাংলাদেশে। কিন্তু একটি পুরনো প্রশ্ন নতুন করে উচ্চারিত হচ্ছে প্রায় সর্বত্র। যা কিছু মুদ্রিত অথবা প্রচারিত হচ্ছে তার সবই কি সত্য?
ঙ·
মিডিয়ার বিশেস্নষণে যোগাযোগ তত্ত্ববিদ মার্শাল ম্যাকলুহানের একটি তত্ত্ব আলোচিত হয়ে আসছে সারা দুনিয়ায়। তিনি বলেছিলেন, মিডিয়াম ইজ দ্যা ম্যাসেজ (বাহনই বার্তা)। সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তôম্্ভ্ভ হিসেবে আখ্যায়িতত করা হয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক জুলিয়াস হ্যারিস ও স্ট্যানলি জনসন বলেছেন, ‘সংবাদ হচ্ছে সব চলতি ঘটনার সংমিশ্রণ, যে বিষয়টিতে সাধারণ মানুষের কৌতূহল আছে এবং পাঠককে আগ্রহী করে তোলে তাই সংবাদ’। কিন্তু আজ কিছু সংবাদপত্র পাঠককে কৌতূহলী ও আগ্রহী করতে অতিরঞ্জিত ও অসত্য এবং আজগুবি খবরের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত । প্রচারমাধ্যমের সত্যানুসন্ধানী ভাবমূর্তির অবসান ঘটিয়েছে এডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোয়াম চমস্ড়্গি রচিত ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্টঃ পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্যা মাস মিডিয়া গ্রন্থটিতে সংবাদ প্রবাহের তাত্ত্বিক রূপরেখা হাজির করেছেন। মূলধারার প্রভাবশালী গণমাধ্যম কর্তৃক প্রচারিত সংবাদ কিভাবে জনমতকে শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থের গতিতেই বেঁধে রাখার তৎপরতায় নিয়োজিত তা উদঘাটন করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেমন এমন হচ্ছে মিডিয়ায় ?
চ·
গত ৩১ জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডে ২০১৩ প্রকাশ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা মাঝে মধ্যেই সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। রিপোর্ট মতে, কোনো কোনো সময় নিরাপত্তা বাহিনীর চোখের সামনেই গণমাধ্যমের শত্রুরা এ ধরনের হামলা চালায়। অপর দিকে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট (আইএফজে) গত ১৮ ডিসেম্বরের পার্টনার্স ও এফিলিয়েটদের সহায়তায় প্রকাশ করে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকদের ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কিত পরিস্থিতি প্রতিবেদন। এই আন্তôর্জাতিক ফেডারেশনের পার্টনারদের সহযোগে সরেজমিন তদন্তô ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই দুই দেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা পরিস্থিতির ওপর এক প্রতিবেদন তৈরি করে। রিপোর্টে এ দুই দেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য অগ্রাধিকার করণীয় সমূহও চিহ্নিত করা হয়। আলোকপাত করা হয় ভবিষ্যৎ আন্তôর্জাতিক সংহতির ক্ষেত্রগুলোও। আইএফজে একই সাথে ভারতের মাওবাদী আন্দোলনরত রাজ্যগুলোতে সাংবাদিকেরা যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, সে সবেরও উলেস্নখ রয়েছে একই প্রতিবেদনে। আইএফজের এই রিপোর্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়- জার্নালিজম ইন বাংলাদেশ ইজ ইন দ্য পলিটিক্যাল ক্রসফায়ার। রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশের ‘ডিপলি প্যারালাইজড’ প্রকৃতির জাতীয় রাজনীতি অব্যাহতভাবে গণমাধ্যমে সৃষ্টি করছে নানা ফাটল। এখানে গণমাধ্যমের মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় কোনো পক্ষ অবলম্বনের। একই ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হয় প্রফেশনাল স্টাফদের ওপর। চলবে··
* বাংলাদেশে মিডিয়ার রাজনীতি [ পর্ব-১]
click here
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন