ঢাকা যেন এখন ট্রাজেডির নগরী। তাজরিন ট্রাজেডি, স্পেক্ট্রাম ট্রাজেডি, ফুলবাড়ি ট্রাজেডি এখন সাভার ট্রাজেডি! ঢাকা যেন এক মৃত্যু নগরীতে পরিণত। এখানে বোধহয় স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। দুর্ঘটনা পিছু ছাড়ছেনা। আহত, নিহত হচ্ছে সাধারণ ও দিনভুখা মানুষ। এমন অপঘাতে মৃত্যু আর কত? কিছুদিন পরপর ঘটেই চলেছে ট্রাজেডির আর ট্রাজেটি। অগ্নিকান্ড, লঞ্চডুবি, নৌকা ডুবি, সড়ক দুর্ঘটনা, ঘুর্ণিঝড়, টর্ণেডো, বন্যা, খড়া, ভবন ধ্বস ট্রাজেডির যেন অভাব নেই। সম্প্রতি যোগ হয়েছে- হরতাল আর ককটেল ট্রাজেডি। এসবের প্রধান কারণ মানুষের লোভ আর অসহিষ্ণুতা প্রকৃতি যেন আর সইতে পারছেনা। প্রকৃতির বিপক্ষে চলে গেছে মানুষ। আর তাই প্রকৃতিও করছে বিরূপ আচরণ। তারপরও যেন শিক্ষা হচ্ছে আমাদের।
একের পর এক ট্রাজেটিক বিপর্যয়ে প্রাণহানি ঘটছে হাজার হাজার। সম্পদ, আর্থিক বা অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বিপুল অঙ্কের। কিন্তু মানুষের প্রাণের দামের হিসাব কিকরে মিলাবো? যে হারিয়েছে প্রাণের প্রিয় মানুষ, সেই জানে তার দাম কত। আমরা শুধু বলতে পারি- মানুষের জীবনের দাম কি টাকা দিয়ে হয়? ধনীর লোভের লালসার শিকারে গরীবের জীবন এত সস্তা কেন? গরীবের জীবনের যেন কোনো দাম নেই। অপঘাতেই যেন তাদের মৃত্যু অবধারিত! তা না হলে ফাটল দেখা দেয়ার পর বন্ধ রাখার নির্দেশনার পরও কেন তিনটি দিন অপেক্ষা করা হলোনা? টাকার কি এতই দরকার ছিলো? যে কারণে প্রায় তিন হাজার শ্রমজীবি মানুষের জীবন ঝুঁকি জেনেও তাদেরকে কাজে যোগদান করতে বাধ্য করা হলো ! হায়রে মানবতা! হায়রে শ্রমিক জনতা, মনিবের কথা কি জীবন দিয়ে শুনতে হবে? হায়রে মালিক- তোমরা কবে মানুষ হবে?
সাভার যেন মৃত্যুপুরী। চারদিকে লাশ আর লাশ। আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে আহত ও স্বজনহারাদের আহাজারিতে। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ স্থানীয় ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এক হাজারেরও বেশি আহত শ্রমিককে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, রেডক্রিসেন্ট, র্যাব ও পুলিশ উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অপঘাতে মৃত্যু আর কত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে বিভিন্ন অপঘাতে ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। আহত আর অসুস্থ হয় প্রায় ২২ লাখ মানুষ। তাজরিন গার্মেন্টেসে শতাধিক কর্মী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের ২৩টি টিম আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুরসহ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৮০০ কারখানা পরিদর্শন করে। তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়- এদের মধ্যে ২৪৩ কারখানাই মারাত্মক ঝুঁকিতে। আবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত বিশেষ টিমের পরিদর্শনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় ২ হাজার কারাখানার মধ্যে ১০৭টি কারখানাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে শ্রম আদালতে মামলা করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, তারপরও কি কমবে দুঘর্টনা, অপঘাত আর ট্রাজেডি নামের ভয়ঙ্কর-বীভৎসতা?
রাজউক বলছে, অনুমোদিতভাবে ভবন তৈরির কারণে ভয়াবহ ভবন ধসের ঘটনা বাড়ছে। পুলিশের হিসাবে ১৯৯৫-২০১৩ সাল পর্যন্ত দেড়যুগে বড় ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এর আগে বিভিন্ন ঘটনায় দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং ৫ হাজারের অধিক মানুষ আহত হলেও তারা যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায়নি। বেঁচে থাকা, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করা মানুষগুলো পুণর্বাসন সুবিধা পায়নি। যাদের লোভের লালসার শিকারে পরিণত হয়ে এত এত প্রাণহানি ঘটে এবং জীবন ঝুঁকিতে পড়ে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ভবন ধসের ঘটনায় ১৯৯৭ সালে কলাবাগানে ৭ জন, ২০০২ সালে শাহজাহানপুর ঝিলপাড় এলাকায় ৪ জন, ২০০৪ সালে শাঁখারিবাজারে ১৭ জন, ২০০৫ সালে সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্টসে ৮০ জন, ২০১০ সালে তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি বস্তিতে ২৫ জন এবং ২০১১ সালে আশুলিয়া নরসিংহপুরে শারমিন গ্রুপের ভবন ধসে ১ জন নিহত হয়। এবার সাভারের এই ঘটনায় দেড় শতাধিক মৃত্যুর খবর ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। দ্রুত উদ্ধার সম্ভব না হলে মৃতের সংখ্যা কততে দাঁড়াবে আল্লাহ মালুম।
ঘটনাস্থলে লক্ষাধিক উৎসুক জনতা আর স্বজনহারাদের ভিড়। করুন আহাজারিতে নিদারুণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তিল ধারণের ঠাঁই নেই হাসপাতালগুলোতে। সারি সারি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেতা হচ্ছে আহতদের। স্বপ্রণোদিত হয়ে শত শত স্বেচ্ছসেবক উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হয়েছে। ‘রক্ত লাগবে’, পানি লাগবে, খাবার লাগবে, আলো লাগবে, সেবা লাগবে- সব কাজে এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু যারা জনগণকে পুঁজি করে রাজনীতি করেন তাদেরকে অকুস্থলে দেখা যায়না। না আওয়ামীলীগ, না বিএনপির কর্মী। কোথায় আপনারা? কোথায় রাজনৈতিক নেতারা? আপনাদের বৈধ-অবৈধ সম্পদের ভান্ডো থেকে কিছু করে দিলেও এই বিপদগ্রস্থদের জীবন বাঁচে।
আমাদের প্রশ্ন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকার পরও অননুমোদিতভাবে একের পর এক ভবন কিভাবে গড়ে উঠেছে? কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না? পরিদর্শন টিমকে অর্থ দিয়েই ম্যানেজ করার অভিযোগও শোনা যাচ্ছে! স্পেকট্রাম দুর্ঘনার ৮ বছরেও বিচার হয়নি। এভাবে ঘটনা ঘটার পর ঘটছে। প্রাণ যাচ্ছে গরীব-দিনভূখা মানুষের। আর পুঁজিবাদী মালিকরা প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন সহসাই। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যদি সুষ্ঠু বিচার হতো তাহলে হয়তোবা এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের হিসাবে রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৮০ হাজার। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৭২ হাজার। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কি কারণে এই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন গুলো এবং এর মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা? আমরা আর কত দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে, আর কত প্রাণ গেলে সচেতন এবং দায়িত্বশীল হবো?
আমরা রাশিয়া থেকে হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র কিনতে পারি। আর দুর্ঘটনার কবল থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে কাটিং মেশিন বা অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে পারিনা! এই দেশে সাধারণ মানুষের করের টাকায় যে পরিমাণ দুর্ণীতি হয়, যে পরিমাণ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়- তার ১ পার্সেন্ট টাকা দিয়ে বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আর জনবল বাড়ালে এধরণের ঘটনায় মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে আসবে। ভাবতে অবাক লাগে, পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমই-এর নিজস্ব উদ্ধার ব্যবস্থা নেই। কেন তাদের নিজস্ব হাসপাতাল থাকবেনা? কেন তাদের নিজস্ব উদ্ধারকারী টিম ও চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবেনা? তাদের কি ধনের অভাব, নাকি মনের? শ্রমিকের রক্ত পানি করা পরিশ্রমের লাভে তাদেরকে আল্লাহ অনেক দিয়েছেন। এবার তাদের প্রতিদান দেয়া উচিত।
আর কত কাঁদবো আমরা? ধনীদের লোভের লালসা মিটবে আর কত গরীব শ্রমিকের লাশে? আর কত তদন্ত কমিটি হবে? আর কত রিপোর্ট জমা হবে? আর কত রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়া হবে টাকা খেয়ে? নিরীহ গরীবের জীবন-মরণ নিয়ে আর কত দিন চলবে নির্মম এই নিয়তির খেলা? এসব প্রশ্নের উত্তর কে দিবে? সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার, না মনুষ্য বিবেক? সরকারকে সকল দায়িত্ব নিতে হবে। সরকারি তহবিল থেকে টাকা দেয়া দরকার নেই। ভবন মালিকের অর্থ-সম্পদ জব্দ করতে হবে। কারখানা মালিকের অর্থ সম্পদ জব্দ করতে হবে। তাদের সম্পদকে নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে বন্টন করে দেয়া দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীর কবির নানক ঘোষণা করেন যে, সরকার উদ্ধার কাজ ও আহতদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। শুধু শোক দিবস পালন করলেই হবেনা। সাময়িক সাহায্য কোনো সমাধান নয়। তাদেও পুণর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দুর্ঘটনার পরপরই বিএনপির ডাকা হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমেই রাজনীতিবিদের দায়িত্ব শেষ হতে পারে না। বিরোধি দলগুলোর শুধু মাত্র শোক জানানোর মধ্যেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। উদ্ধার কাজ, চিকিৎসা, খাদ্য ও পুণর্বাসন সহায়তায় বিরোধি দলগুলোর কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনা। এসবের নাম জনগণের জন্য রাজনীতি হতে পারেনা।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের মিঠেকড়া সেই ছড়াটি দিয়ে শেষ করব লেখাটি।
‘বলতে পারো বড় মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
বড় মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি,
গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি?
বলতে পারো ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে,
কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে?
ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেক রকম খেলনা,
গরীব মেয়ে পায়না আদও, সবার কাছে ফ্যালনা।
বলতে পার ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য,
ধনীর পায়ের তলায় তারা থাকতে কেন বাধ্য?
হিং-টিং-ছট প্রশ্ন এসব, মাথার মধ্যে কামড়ায়,
বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়"
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন