সাপ্তাহিকী
|
রাইস উদ্দিন
|
|
ভালবাসার অভিব্যক্তি
03 Jun, 2013
বাইশ বছর পর সেই মিষ্টি মেয়েটির সাথে সাঈদের দেখা হলো। নিজের চোখ দুটোকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা সে।
মুহাম্মদ পুরের একটি অভিজাত রেষ্টুরেন্টে সামনের টেবিলেই বসা কার যেন অপেক্ষায় রয়েছে, তানা হলে কিছুনা কিছুর অর্ডার তো দিত! সাঈদ ভাবছে, দুবার তার চোখে চোখে চোখ পড়লো অথচ তাকে চিনতে পারলোনা?
নাকি চিনেও না চেনার ভান করছে। সাঈদের স্ত্রী এবং দুই কন্যা এবং ভগ্নি ভগ্নিপতি সাথে দুই ভাগ্নে তারা সবাই বার্গার খাচ্ছে। সাঈদের সেদিকে কোনই খেয়াল নেই। টেবিলে রাখা গরম কফি প্রায় ঠান্ডা হওয়ার পথে তাতে একবারও মুখ দেয়নি।
সে্ ভাবছে এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে প্রতি পলে পলে সব কিছুর পরিবর্তন হয়, হয়না শুধু স্মৃতির পরিবর্তন। তাই এতগুলো বছর আগের স্মৃতিময় দিনগুলো এখনও তেমনি স্মৃতিময় হয়ে আছে, থাকবে চিরকাল যা বিস্মৃতির তুলি দিয়ে কখনো মুছে ফেলার নয়। সাঈদ ২২টি বছর কাটিয়ে দিয়েছে প্রবাসে। এরই মাঝে বিয়ে তার পর দুকন্যার পিতা।
আজ প্রায় দুই যুগ পরে তার ভাল লাগার মেয়েটি তাকে চিনতে পারছেনা অথচ সে তাকে ভাল বাসতো হৃদয় উজাড় করে। সাঈদের প্রতিটি গতিবিধির উপর নজর রাখতো অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মত সন্ধানী দুটো ডাগর কালো চোখ দিয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে সোজা সরল মানুষ হিসেবে সে তাকে জানতো। সাঈদ রাজিয়াকে ঠিকই প্রথমবার দৃষ্টি পড়তেই চিনে ফেলেছে। সেই চোখে পাওয়ারের চশমা হরিণীর মত লম্বা গ্রীবা ইংরেজদের মত লালচে চুল আর সাবলিল স্বাস্থ্য। ঠোটের নিচে ছোট্ট তিলটা এখন দিনে দিনে আরও স্পষ্ট হয়েছে যা দুর থেকেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সাঈদ কিছু বলতে চায়! এত দিন পর দেখা অন্তত কোশল বিনিময়তো হওয়া আবশ্যক।
পিনপতন নিরবতা! নিজের ভিতর প্রচন্ড একটা ইতস্ততা এবং জড়তা কাজ করছে! কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। ওয়েটার বার বার রিকুয়েস্ট পেপার সামনে দিচ্ছে সে তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে। এবার বুঝলাম সে কারও অপেক্ষায় বসে আছে। সাঈদ এবার নিজেকে নিয়ে ভাবছে! তার নিজের মধ্যে কি এতই পরিবর্তন ঘটেছে যার জন্যে সে তাকে চিনতে পারছেনা?
সাঈদ ছিল দেখতে সুদর্শন, সৌম্য ঊজ্জ্বল গৌরবর্ণের অতি সহজ সরল একজন যুবক। সরু নাক কালো ঘন চুল শান্ত রূচিশীল চারিত্রিক মাধুর্য্য স্নিগ্ধ উজ্জ্বলতায় সকলের কাছ ছিল সে প্রিয়পাত্র। যখন সে দশম শ্রেণীর ছাত্র, স্কুলের অনেক মেয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়েছে। তার ব্যক্তিত্বের কাছে পরাজিত হয়ে অনেক বখাটে ছেলেও তার পরম বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। সাঈদ এবার নিরুপায় হয়ে দৃষ্টি ফেরালো নিজের দিকে বুঝতে চেষ্টা করলো আবিস্কার করতে চেষ্টা করলো এতগুলি বছরে তার নিজের কায়িক পরিবর্তন ঘটেছে কতটা?
ভাবতেই তার সামনে পরিস্কার হয়ে প্রতিভাত হলো যে 'এই নিদারুণ প্রবাসের আবহাওয়া খাওয়া দাওয়া গোসলের পানি সব মিলিয়ে প্রথম থেকেই এ্যাডজাষ্ট করেনি তাকে।
এক সময় তার মাথার ঘনকালো চুল দেখে সে বলতো"
-এই! তোমার মাথার এত সুন্দর চুল দেখে আমার সত্যি হিংসে হয়। এমন চুল যদি আমার থাকতো নিজেকে গর্বিত মনে করতাম। অথচ সেই চুল এখন আর নেই কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে, কালের পরিবর্তনে যেমন নদী শুকিয়ে যায় তার রেখা পযর্ন্ত অবশিষ্ট থাকেনা নতুন প্রজন্মের লোক বুঝতেও পারেনা যে এখানে কোন নদী ছিল। তেমনি সাঈদের মাথার অবস্থা দেখে কেউ বুঝতেও পারবেনা এ মাথায় কখনো এমন ঘনকালো চুল ছিল।
এক সময় সাঈদকে সে অনুনয়বিনয় করে বলতো"
-এই একটু হাসনা? তোমার ছোট ছোট চকচকে ঝকঝকে দাঁতগুলো সত্যি যেন মুক্তা দানা! তুমি হাসলে আমার খুব ভাল লাগে! কথায় আছে না?
বাঙ্গালী মা থাকতে মায়ের মর্যাদা বুঝে না তেমনী দাঁত থাকতে মর্যাদা বুঝে না। অযত্নে অবহেলায় সাঈদের সবগুলি মাড়ির দাঁতই ফেলে দিতে হয়েছে। গালের দু পাশের চাপাই ভেঙ্গে গিয়েছে, কী করে চিনবে ব্যাচারী?
সে সাঈদের অপলক তার দিকে চেয়ে থাকাটা লক্ষ্য করছিলো।
হঠাৎ একজন মধ্যবয়েসি লোক এসে অনাকাংখিত দেড়ির জন্য ক্ষমা চেয়ে বার্গার এবং কোল্ড ড্রিন্কসের অর্ডার দিয়ে উভয়ে অন্য আর একটি টেবিলে গিয়ে বসলো। লোকটি তার হাজবেন্ট হবে হয়তো ভাবছে সাঈদ। সে সময় সে শুনেছিল কোন এক খালাতো ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে হয়েছে সে নাকি সরকারী উচ্চপদস্থ চাকুরি জীবী।
সাঈদের খুব বেশি করে হারিয়ে যাওয়া দিন গুলির কথা মনে পড়ছে। কৈশরের সেই স্মৃতিমন্থন করে একা একাই এ হাসছিলো। সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে আর সাঈদ নবম শ্রেণীতে। স্কুলের পথ ছিলো চার মাইলের কিছুটা কম। আসা যাওয়া প্রায় সাড়ে সাত মাইল। মাঝখানে নদী নাম কালিগংগা। খেয়া পারাপার হতে হয়। বর্ষায় দীর্ঘ পথ নৌকায় যেতে হয়। এখন অবশ্য সে নদী শুকিয়ে গেছে। একদিন সাঈদ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলো আকাশটা সকাল থেকেই ছিল মেঘাচ্ছন্ন যে কোন সময় মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে এমনই একটা ভাবছিল। ঝড় তুফানের আশংকায় অন্যরা টিফিনের পূর্বেই বাড়ি চলে গিয়েছিল।
ঘটনা ক্রমে সাঈদ খেয়াঘাটে এসে দেখে রাজিয়া একাই অপেক্ষা করছিল কিন্তু খেয়া নৌকা ওপারে রেখে মাঝি বাড়ি চলে গেছে কারণ এতক্ষণে পশ্চিম আকাশ ভয়াল কৃষ্ণমূর্তি ধারণ করেছে। সা্ঈদ খেয়া ঘাটে পৌঁছেতই আকাশটা যেন ভেঙ্গে পড়ার মত, প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। নদী পারে কে বা কাহারা একটি নৌকা উঠিয়ে উপর করে রেখেছে হয়তো গাব বা আলকাতরা লাগিয়ে শুকাতে দিয়েছিল। ওরা দুজনে বুদ্ধি করে ওর ভিতের ঢুকে পড়লো। বৃষ্টির শব্দ আর মাঝে মধ্যে বিজলির বিকট আওয়াজ ওদের কিশোর মনকে আন্দোলিত করছিল। ওরা প্রচন্ডভাবে চিৎকার করছিল যা কোন ভয় বা আতংকের চিৎকার ছিলো না বরং বৃষ্টিরা আওয়াজকে প্রতিহত করার প্রয়াস ছিল মাত্র। ওরা ছিল অত্যন্ত সাহসী এবং নির্ভীক, ওদের মন ছিল পরিচ্ছন্ন পবিত্র যদিও সেই মুহূর্তটা একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। সাঈদ সেই সময়ের কথাগুলো স্মরণ করে গর্ববোধ করছে এজন্য যে, সে সময় কোন সীমালংঘনের চিন্তা তাদের মনে উদয় হয়নী।
আর এক দিনের ঘটনা যে ঘটনাটি মনে হলেই সাঈদ নিজেকে অনেক লজ্জিত অনুভব করে।
বর্ষাকাল সকাল থেকেই ছিটে ফোটা বৃষ্টি, সাঈদ সাথীদের সাথে প্রতিদিনের মত স্কুলে গিয়েছে নৌকা করে। তখন প্লাস্টিকের পলিথিন ব্যাগ সবেমাত্র বেরিয়েছে যা দিয়ে বাজার থেকে দ্রব্যসামগ্রি বহন করে আনা হতো। ওরা বৃষ্টির পানি থেকে বই গুলো বাঁচাতেই এক একজন একটাকা দিয়ে পলিথিন ব্যাগ কিনেছে এবং তা দিয়ে বই বহন করে স্কুলে আসা যাওয়া করে যা তাদের জন্য সুবিধাজনক ছিল। ঐদিন সাঈদ তার ছেলে বন্ধুদের নিয়ে আগে এসেই নৌকায় বসে রয়েছে মেয়েরা আসলেই নৌকা ছাড়বে।
-দাঁত খসাই বিষ খসাই দাঁতের পুঁকা ফেলাই বলতে বলতে নৌকার কাছে এসে পৌছেছে প্রিয়বান্ধবী রাজীয়া। এবার সাঈদ প্রশ্ন করলো"
-কয় গ্রাম ফেলে এসেছো?
-গুটা দুই!
-দেখি গুটা দুই! সবাই এক সাথে খিল খিল হেসে উঠলো। রাজিয়া ভীষণ লজ্জা পেল একজন অপর জনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নৌকায় বসে পরলো তখনো দুষ্টরা হাসছিল। অথচ এসব কথোপকথোন কোন মাইন্ড করে কেউ বলেনী, তবু পরিস্থিতি একটু অস্বাভাবিকতার রূপ পরিগ্রহ করলো।
আজ সেই মেয়েটি সাঈদের মূখোমুখী হয়েও চিনতে পারছেনা। একসময় সে সাঈদের প্রতি এতই দূর্বল ছিল যে তার নিখুঁত ভালবাসার অভিব্যক্তি প্রতিটি কথা ওকাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতো। অতিসয় সহজ সরল মনের মানুষ হিসেবে সাঈদ বুঝেনি। রাজিয়া একদিন বলেই দিয়েছিল' বাদুর সূর্য্যের রশ্মি থেকে যতই বঞ্চিত থাকুক না কেন তাতে সূর্য্যের আলোকছটায় এতটুকুন ফারাক পড়েনা। কথাটি পারস্য কবি শেখ সাদীর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুণরাবৃত্তি যেন। কবির যৌবন কালে একটি সুন্দরী রুপসী মেয়ে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হয়ে একটি কবিতার পংক্তি শুনিয়েছিল। রাজিয়াও সাঈদকে তেমনি ভাবে কথাগুলো বলেছিল।
সাঈদ চিন্তা করলো আজও জীবনের শেষ ভাগে নাই বা আমাকে সে চিনলো! নাই বা আমি তার সাথে নতুন করে পরিচিত হলাম! সে তো সুখেই আছে ভাল আছে। ইচ্ছে করেই সাঈদ নিজেকে আড়াল করে রাখলো। যৌবনে যে হেতু তার ভালবাসার মূল্য দিতে পারেনি এখন ভগ্ন দেহ আর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে মিছেই তাকে কষ্ট দেয়া। সাঈদের মনের কষ্টগুলো মনে চেপে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাসায় ফিরলো ঠিকই সমগ্র রাতটাই গেল রাজিয়াকে ভেবে ভেবে। এটাই ভালবাসার অভিব্যক্তি যদিও সে তা বুঝেনি প্রকাশও পায়নি। প্রবাসে থেকে সে ভাবতো-
ফুলের মতো যে মেয়েটি
কাঁছে ছিল পাশে ছিল
হঠাৎ কেন সেই মেয়েটি
উড়াল দিল, উড়াল দিল?
এখনো কি সেই মেয়েটির
মুখশ্রী আস্ত আছে?
ফুলের মত পাপড়ি কি তার
হাওয়া পেয়ে আস্ত নাচে?
কেমন করে সেই মেয়েটি
ভুলে গেলো হাজার কথা
কেমন করে সেই মেয়েটি
করছে জনম নীরবতা?
স্বপ্ন ছিল আমার ঘরে
ফুলদানিতে থাকবে সে
সকাল বিকেল রাত দুপুরে
আমায় শুধু ডাকবে সে।
সেই মেয়েটি আর কোনদিন
আমার কাছে আসবে না?
হাত দুটোকে মালা বেঁধে করে
আমায় ভালো বাসবে না?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন