বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার ও ক্ষমতায় ঠিকে থাকার জন্য নিরন্তর এক সংগ্রাম চলছে। হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও, পোড়াও, ভাংচুর, লাঠি, গুলি, টিয়ারগ্যাস আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে আজ এসে দাড়িয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা অঘঠন ঘটেই চলছে। মসনদের অন্ধ মোহ, লোভ লালসা আর প্রতিহিংসার আগুনে দাউ দাউ করে আজ জ্বলছে বাংলাদেশ। পুড়ছে সম্পদ, ভাঙ্গছে গাড়ী- বাড়ী, মরছে মানুষ। এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। দেশের সাধারণ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ততই বাড়ছে। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় ঠিকে থাকার জন্য আর ক্ষমতাহীনরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। পরস্পর বিপরীত দুই ধারায় বিভাজিত হয়ে তারা আজ একে অপরের মূখোমুখি দাড়িয়ে গেছে। গণতন্ত্রের নামে তারা চালু করেছে, এক অদ্ভূত- উদ্ভট পরিবারতন্ত্র। মধ্যযুগীয় রাজা-রাণীর আচরণে তারা হয়ে পড়েছে অভ্যস্থ। নিজেদের দুর্নীতিবাজ- দুর্বল উত্তরাধিকারকে মসনদে বসানোর স্বপ্নে তারা আজ বিভোর। উত্তরাধিকারের দাবীতে নিজেরা রাজনীতিতে পূণর্বাসিত হয়ে পূর্বসূরির লাশ নিয়ে তারা কাড়া কাড়ি করছে। পূর্বসূরির গুণকীর্তন করে মসনদ দখল রাখার এক অদ্ভূত পায়তারায় তারা লিপ্ত হয়ে আছে। মাঝে মাঝে অলিক স্বপ্নের ফুল ঝুরি ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে তারা বিভ্রান্ত করছে। তাদের চার পাশ ঘিরে রয়েছে মৌ-লোভী, চামচা, চাটুকার, মোসাহেব। আর এ ভাবেই চামচা -চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে এক পুতুল ও এক পুতুলের মা দেশটাকে নিয়ে পুতুল খেলা খেলছে। বাংলাদেশে আজ রাজনীতির নামে চলছে অপরাজনীতি, চলছে শোষণের গণতন্ত্র আর ক্রীতদাসের অর্থনীতি।
বাংলাদেশ যার জন্ম হয়েছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। এক দীর্ঘ সংগ্রাম আর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে। যে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল রাম, রহিম, জন, পল। যে যুদ্ধে ইজ্জত দিয়েছিল গীতা, সীতা, সখিনা, জরিনা। বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম নেই যে গ্রামে শহীদ মিনার নেই, নেই শহীদের কবর কিংবা বীরঙ্গনার আর্তনাদ। বাংলাদেশের এমন কোন এলাকা নেই, যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন নেই। বাংলাদেশের এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল সামস কিংবা জামাত-শিবিরের তান্ডব হয়নি। সৌভাগ্য এ দেশের মানুষের যে লাওস, কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনামের মত সুদীর্ঘ কোন যুদ্ধ তাদের করতে হয়নি। ভাগ্যবান বাঙ্গালী জাতি সে যুদ্ধে পেয়েছিল এক অসাধারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সূদৃঢ় এক জাতীয় ঐক্য আর মহান আল্লাহর আশীর্বাদ। যার ফলে আধুনিক মারনাস্ত্রে সু-সজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ খালি হাতে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পরাজিত করে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল স্বাধীন- সার্বভৌম- অসাম্প্রদায়িক একটি দেশ, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের জন্মের পিছনে যেমন রয়েছে এক রক্তাক্ত করুণ ইতিহাস, তেমনি রয়েছে এক সুদীর্ঘ আন্দোলন -সংগ্রামের সফল ইতিহাস। যে আন্দোলন- সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য ছিল শোষন- বঞ্চনাহীন এক সূখি- সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন । যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিল সাতকোটি মানুষ। যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক আর স্বাধীনতার ঘোষক। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রতিটি বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে সূখ, শান্তি আর সমৃদ্ধি বিরাজ করবে। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবেনা। থাকবেনা হিংসা, বিদ্বেষ, মারামারি, কাটাকাটি। থাকবেনা অভাব- অনটন। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণ-বঞ্চনাহীন এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাড়াবে। আর তাই একজন নিজের সমস্ত জীবন উৎসর্গ করে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বন্দি হওয়ার পর অপর জন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। তারা উভয়েই ছিলেন পরস্পরের সম্পূরক, পরস্পরের পরিপূরক। কিন্তু তারা এমন স্বপ্ন দেখেন নাই যে স্ব -জাতীর হাতে এমন নিষ্ঠুর নির্মম ভাবে তাদের জীবন দিতে হবে। তাদের জীবৎদ্বশায় তারা কখনও কল্পনা ও করেননি যে তাদের করুণ পরিণতির পর তাদের দুর্বল উত্তরাধিকার এক দিন মসনদে আরোহন করে এ ভাবে তাদের স্বপ্নের সমাধি রচনা করবে। মহান স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে উঠা ঐক্যবদ্ধ জাতি সত্বাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে পরস্পর বিপরীত দুটি ধারায় জাতিকে বিভাজিত করে তারা মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিবে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রীয় মৌল নীতিমালা বিসর্জন দিয়ে তারা ব্যার্থ রাষ্ট্রের পথে দেশটাকে নিয়ে যাবে। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে কে কত বেশী ধার্মিক তার প্রতিযোগিতা করবে। শহীদের রক্তে লেখা বাহাত্তরের সংবিধানকে কেটে ছিড়ে ঠুটো জগন্নাথ বানাবে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্জিত রাষ্ট্রীয় মৌল নীতিমালা- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ বিসর্জন দিয়ে তারা বাংলাদেশে শোষণের গণতন্ত্র ও ক্রীতদাসের অর্থনীতি চালু করবে।
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ গণতন্ত্রের জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজব্যবস্থার জন্য যে দেশের মানুষের রয়েছে এক দীর্ঘ লড়াই আর সংগ্রামের অতীত ইতিহাস। যে সু-দীর্ঘ আন্দোলন- সংগ্রাম আর যুদ্ধের মাধ্যমে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একাত্তরে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলে ও সত্য যে, সে সময় ও কিছু সংখ্যক বাঙ্গালী কুলাঙ্গার স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। দুর্বিত্ত -হানাদারদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধাপরাধি-রাজাকার রূপে পরিচিতি লাভ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাদের অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদান না করে জাতি ভূল করলেও তারা কিন্তু ভূল করেনি। অকৃতজ্ঞ রাজাকাররা তাদের পরাজয়ের গ্লানি কিন্তু ভুলতে পারেনি। বাঙ্গালীর হাজার বছরের ইতিহাস- ঐতিহ্য আর আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল বাংলাদেশকে কিছুতেই তারা মেনে নিতে পারেনি। তারা তাদের মানসিকতাকে পরিবর্তন করতে পারেনি। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কিছুতেই তারা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা মরিয়া হয়ে উঠে।
দেশকে পুরানো ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তারা চক্রান্ত আর ষঢ়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। সদ্য স্বাধীন দেশে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলাতে গিয়ে অনেকেই তাদের পাতানো ফাদে পা ফেলেন। স্বাধীনতার বীর যোদ্ধারা একে অন্যের মুখোমুখি দাড়িয়ে পড়েন। শুরু হয় আত্মহননের পালা, নৈস্বর্গে ভাঙ্গন। একাত্তরের রণাঙ্গনের সাথীরা একে অন্যের শত্রু হয়ে উঠেন। পিছন থেকে মদদ যোগায় স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি। সদ্য স্বাধীন, বিধ্বস্ত, ধ্বংসস্তুপের মাঝে যখন জাতি রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চলছে তখন আতুড় ঘরে তাকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠে স্বাধীনতার পরাজিত রাজাকার আর তাদের দোসরেরা। দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা লগ্নে, পচাত্তরের পনরই আগষ্ট তারা আঘাত হানে স্বাধীনতার সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ঘাটিতে। নিষ্ঠুর-নির্মম ভাবে স্বপরিবারে তারা হত্যা করে বাঙ্গালী জাতি রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৩ রা নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে নিষ্ঠুর-নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতীয় চার নেতাকে। চক্রান্ত আর ষঢ়যন্ত্রের নীল নকশায় অতঃপর তারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন প্রক্রিয়া শুরম্ন করে। অভ্যূত্থান আর পাল্টা অভ্যূত্থানের মাধ্যমে তারা বীর মুক্তিযুদ্ধা কর্ণেল খালেদ মোশাররফ, হুদা, হায়দারকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। ফাসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহেরকে। শিখন্ডি বানিয়ে পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াকে। ১৯৮১ সালের ৩০ শে মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিষ্ঠুর-নির্মম ভাবে তারা জিয়াকে ও খুন করে। চক্রান্ত আর ষঢ়যন্ত্রের নীল নকশায় জিয়া হত্যার আসামী করে ফাসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে স্বাধীনতা যুদ্ধের ১২ জন বীর সেনানীকে। ঢাকা থেকে ঘাতক পাঠিয়ে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী মেজর মন্জুরকে। ক্ষমতার মসনদে অরোহন করে পাকিস্তান ফেরত সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মোহামদ এরশাদ।
নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থানে এরশাদের পতনের পর সর্বশেষ তারা বেঁচে নেয় স্বাধীনতার দুই বীরের দুর্বল-দেউলিয়া উত্তরাধিকারকে। সন্ত্রাস-দুর্নীতি-কালোটাকা আর পেশী শক্তির কাছে জিম্মী দুই নেতৃর ভিতর ক্ষমতা আর মসনদের অন্ধ মোহ-তৃষ্ণা জাগিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে তারা আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের সামনে আজ এক বিরাট নতুন চ্যালেঞ্জ। বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতায় স্বাধীনতার নেতৃত্ব দান কারী দল আজ ক্ষমতায়। দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বৎসর পর যুদ্ধাপরাধির বিচার শুরু হয়েছে। সে বিচারকে বাধাগ্রস্থ করতে পরাজিত শত্রু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। পরিবর্তনের লক্ষ্যে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ ভাবে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আজ প্রস্তুত। সে জন্য জনগণের ম্যান্ডেট আর অদালতের নির্দেশ এর প্রতি সম্মান দেখিয়ে সর্বাগ্রে বাহাত্তরের সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করে ধর্মীয় অপরাজনীতি বন্ধ করে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্জিত রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ পূণঃপ্রবর্তন করতে হবে। মধ্যযুগীয় ক্রীতদাসের ন্যায় দরিদ্রের রক্তে ভেজা শ্রম বিক্রি করে গড়ে উঠা অর্থনীতির পরিবর্তে উন্নয়নের অর্থনীতি চালু করতে হবে। শ্রমিকের হাড় ভাঙ্গা খাটুনি আর রক্তে ভেজা অর্থ কেড়ে খাওয়া মধ্য সত্বভোগীদের হাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হবে। শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য শোষিতের গণতন্ত্র কায়েম করতে নতুন করে আজ শপথ নিতে হবে। মসনদের অন্ধ মোহ আর লোভ লালসার কারণে বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোন ধরনের ব্যার্থতা কিংবা আপোষকামিতা হবে আত্মহননের সামিল। আমাদের ভূলে, আমাদের হঠকারিতায় যদি এবার ও পদস্খলন ঘটে, তবে তলিয়ে যাবে সমাজ, সভ্যতা ও দেশ। তলিয়ে যাবো আমরা সকলে, হারিয়ে যাবে-বাংলাদেশ।
লেখকঃ আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ, কক্ষ নং ১৪১, সুপ্রীমকোর্ট বার ভবন, ঢাকা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন