উলউইচ হত্যাকান্ড এখন টক অব দ্যা ওয়ার্ড। দক্ষিণ লন্ডনের উইলউইচে গত বুধবার (২২ মে, ২০১৩) দুপুরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে দুই সন্ত্রাসী যুবক লি রিগবি নামের এক বৃটিশ সেনা সদস্যকে হত্যা করে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলাম এবং মুসলমানদের জন্য গ্লানিকর এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ গোটা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। বীভৎস ঘটনার ফুটেজ সাধারণতঃ বৃটিশ মিডিয়া প্রচার করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু উলউইচ হত্যাকান্ডের ফুটেজ অন-লাইন সকল মিডিয়ায় দেখা গেছে। ঘটনার পর পর বিএনপি নেতা নিক গ্রিফিন টুইটারে মন্তব্য করেন, ‘গণহারে ইমিগ্রেশনের কারণেই এ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।’ অপরদিকে ইংলিশ ডিফেন্স লিগ বা ইডিএল’র শ খানেক লোক ঘটনার পর পর অকুস্থলের আশে পাশে জড়ো হয়ে মুসলিম বিরোধী শ্লোগান দেয়া শুরু করে। তারা পুলিশের উদ্দেশ্যে বোতলও নিক্ষেপ করে। ইডিএল নেতা টমি রবিনসন-এর একটি উক্তি অন-লাইন গার্ডিয়ান তুলে ধরেছে। তিনি বলেছেন, ‘ওরা আমাদের সৈনিকদের মস্তক কেটে ফেলছে। এর নামই ইসলাম, যা আমরা আজ দেখছি। তারা আমাদের এক সৈন্যের মাথা কেটে লন্ডনের রাজপথে ফেলে রেখেছে।’ সে আরো বলে, ‘স্কুলগুলোতে আমাদের পরবর্তী বংশধরদের শিক্ষা দেয়া হয়, ইসলাম শান্তির ধর্ম। আসলে তা নয়, এটা কখনো ছিল না। আজ আমরা যা দেখছি, এটাই ইসলাম। যথেষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রতিকার হতে হবে। সরকারকে শুনতে হবে, পুলিশকে শুনতে হবে, বৃটিশ জনগণ কতটুকু ক্ষুব্ধ তা তাদের বুঝতে হবে।’ এ ঘটনার পর পঞ্চাশ হাজারের বেশি লোক অন-লাইনে ইডিএল-এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে বলে জানা গেছে। আজকের (২৫ মে ২০১৩) গার্ডিয়ান রিপোর্ট করেছে, এ ঘটনার পর মসজিদে হামলা, অন-লাইন মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ সহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ১৫০টি ঘটনার খবর তাদের কাছে এসেছে। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় এ ঘটনা মুসলমানও ইমিগ্র্যান্টদের জীবনকে কতটুকু সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছে।
আনন্দের বিষয়, বর্তমান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডাউনিং স্ট্রিট থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এ ধরণের বর্বর কাজ ইসলাম সমর্থন করে না। মুসলিম কমিউনিটি এ দেশের জন্যে অনেক কাজ করছেন। যারা এ কাজ করেছে তারা ইসলাম ও মুসলিম কমিউনিটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যারা এ কাজ করেছে তারা আমাদের মধ্যে বিভক্তি আনতে চায়। কিন্তু আসলে এ ঘটনা আমাদের আরো ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী করবে।’ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করে বলছি, আমরা মুসলমানরা বৃটেনকে নিজেদের দেশ মনে করি এবং এ দেশের উন্নতির জন্যে দিনরাত পরিশ্রম করছি। আমরা চাই, বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে বিলাতের সকল মানুষের জীবন সুখি, সমৃদ্ধ ও সুন্দর হোক। কথিত ঘাতক তার ঘৃণ্য কাজের মাধ্যমে এ দেশের সকল মুসলমান ও ইমিগ্র্যান্টদের কলঙ্কিত করেছে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে এ ধরণের সকল ফ্যাসিস্ট ও চরমপন্থীদের মোকাবেলা করতে হবে।
ইংলিশ ডিফেন্স লিগ বা বিএনপি’র মত চরম দক্ষিণপন্থী দল এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করবে, এটা খুব স্বাভাবিক। সন্ত্রাস এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে বৃটিশ জনগণের কঠোর অবস্থানের ব্যাপারে আমাদের আস্থা আছে। এশিয়া বা আফ্রিকার কোন দেশে এ রকম ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হতো। বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে কোন খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী সে দেশের কোন সৈন্যকে এ ভাবে হত্যা করলে সে সব দেশের মানুষ এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কি করতো তা কল্পনা করতেও আমরা আতঙ্কিত হই। সে তুলনায় বৃটেনে কিছুই হয়নি এবং এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এখানে ব্যাপক কোন হাঙ্গামা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলেও আমরা মনে করি না। তবে আমাদের সবাইকে ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে যে কোন ধরণের উস্কানিমূলক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে এবং প্রয়োজনে আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হতে হবে।
উলউইচ হত্যাকান্ডের পর সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে মুসলিম নেতৃবৃন্দও তীব্রভাষায় এর নিন্দা জানিয়েছেন। মুসলিম কাউন্সিল অব বৃটেনসহ বিভিন্ন সংগঠন এবং মসজিদের বিবৃতি আমরা মিডিয়ায় দেখেছি। সন্ত্রাসী কোন ঘটনা ঘটলে আমরা স্বাভাবিক নিয়মে এর নিন্দা করি। তবে বর্তমান ঘটনার গভীরতর প্রতিক্রিয়া সামনে রেখে সংবাদপত্রের পাতায় স্থান পাওয়ার জন্যে প্রদত্ত রুটিন নিন্দাবাদের ঘোরটেপ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মুসলমান এবং ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে এ ব্যাপারে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন শুধু আমাদের দায়িত্ব নয়, নিজেদের রেকর্ড সঠিক ও উজ্জ্বল করার জন্যে তা অনিবার্য একটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা সন্ত্রাসবাদ প্রচার করে এবং সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে তাদের প্রতিহত করার জন্যে মসজিদের মিম্বর, বক্তৃতার মঞ্চ এবং প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সকল মাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে। সন্ত্রাসীরা ভিন্ন ভিন্ন নাম ও শ্লোগান দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলা চালিয়ে জানমালের ক্ষতি সাধন করছে। তাদের আক্রমণের শিকার যে শুধু যুদ্ধাক্রান্ত দেশের মানুষ হচ্ছে তা নয়, যে সব দেশে যুদ্ধাবস্থা নেই সেখানকার মানুষও রক্ষা পাচ্ছে না। এমনি পরিস্থিতিতে মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং ধর্মীয় পন্ডিতদের সমস্যার গভীরে গিয়ে এর মোকাবেলা করতে হবে। যারা কুরআন-হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত সরলমনা লোকদের মনে সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন করছে তাদের আমাদের অগ্রসর হয়ে চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
বিবিসি কর্তৃক প্রচারিত পথচারীর ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একজন সন্ত্রাসী রক্তাক্ত চাপাতি ও ছোরা হাতে বলছে, ‘ডেভিড ক্যামেরনের কারণে ব্রিটিশ সরকার আরব দেশগুলোতে সেনা পাঠিয়েছে। আমরা আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করছি এ লড়াই থামাব না। কারণ মুসলমানরা প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত।’ পথচারী নারীদের উদ্দেশে হামলাকারীরা বলে, ‘আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি আপনাদের এসব দেখতে হচ্ছে বলে। কিন্তু আমাদের দেশগুলোতে নারীরা একই দৃশ্য দেখছে।’ ঘাতকের এ বক্তব্য থেকে সন্ত্রাসীদের মাইন্ড-সেট বা মানসিকতা সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা করতে পারি। যারা ইসলামের কথা বলে সন্ত্রাসবাদ প্রচার করে তাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে, পাশ্চাত্য সমাজ ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে।
অমুসলমানদের সাথে এবং অমুসলিম সমাজে মুসলমানরা কখনো শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। এক শ্রেণীর মুর্খ পন্ডিত ভাসা ভাসা জ্ঞানের আলোকে গৃহীত এ ধরণের অতিসরলীকৃত সিদ্ধান্ত প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এ সব কথা যে একদম বাজে কথা তা কুরআন, হাদীস এবং ইসলামের ইতিহাস একটু অধ্যয়ন করলে যে কেউ অনুধাবন করতে পারবে। আমাদের জানা মতে, সকল ইসলামী পন্ডিত এ ভাবে মানুষ হত্যাকে জঘন্য এবং নিষিদ্ধ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কোন্ মুর্খদের কাছে সন্ত্রাসীরা সবক নেয় তা আমাদের খুঁজে বের করে তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
তবে প্রথমে আমাদের এ স্বীকৃতি দিতে হবে, মুসলিম কমিউনিটিতে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসের বীজ রয়েছে। উলউইচ হত্যাকান্ডের কথিত ঘাতক চিৎকার দিয়ে বিশ্ববাসীকে তা জানিয়ে দিয়েছে। নিরপরাধ ও নিরস্ত্র বৃটিশ সৈনিককে হত্যা করে সে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের অপমানিত করেছে। বৃটিশ সরকার বা এ দেশের আইন-শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা অবশ্যই সকল শক্তি দিয়ে চরমপন্থীদের মোকাবেলার চেষ্টা করবে।
ইমিগ্র্যান্ট এবং মুসলমানদেরও এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামের দোহাই দিয়ে কেউ চরমপন্থা বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করলে দেশের সুশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারি না। যদি বা কিন্তুর মারপ্যাচ বাদ দিয়ে এক কথায় চরমপন্থাকে ‘না’ বলতে হবে।
চরমপন্থীদের চিহ্নিত করার কাজে আমাদের কথিত ঘাতকের দেয়া কুরআনের রেফারেন্সকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে দেখতে হবে। সে বলেছে, ‘কুরআনে আছে, চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত।’ ফৌজদারী দন্ডবিধি প্রসঙ্গে কুরআনে তা উল্লেখিত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, কারো বিরুদ্ধে যদি এ অভিযোগ আসে যে সে কারো চোখ বা দাঁতের ক্ষতি করেছে তা হলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে আসামীর জন্যে সমপরিমাণ শাস্তির ব্যবস্থা করা। এর মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সরকারের আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার দেয়া হয়নি। কুরআন আরো বলে, যে একজন মানুষকে হত্যা করে সে যেন গোটা মানব জাতিকে হত্যা করে। তাই কোন অজুহাতে কাউকে হত্যা করার সুযোগ ইসলামে নেই, এটা জঘন্য একটি ফৌজদারী অপরাধ। কথিত ঘাতক বৃটিশ সরকারের বিদেশনীতি নিয়েও কথা বলেছে। সৈনিকরা বৃটিশ বিদেশনীতি প্রণয়ন করে না তা একজন সাধারণ মানুষও জানে। বৃটিশ বিদেশনীতির অপরাধে একজন সাধরণ সৈনিককে, যে কারো সাথে যুদ্ধরত বা যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, হত্যা করা কি কুরআনের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন নয়? কুরআন বলেছে, একজনের অপরাধের বোঝা অন্যজন বহন করবেনা। তা ছাড়া সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে বৃটিশ বিদেশনীতি পরিবর্তন করা যাবে বলে যারা মনে করে তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করে। বৃটেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ। বৃটিশ সরকারের কোন নীতির মধ্যে পরিবর্তন আনতে হলে বৃটিশ রাজনীতির সাথে অধিকতর সম্পৃক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক পদ্ধতিতে অংশ নেয়ার মাধ্যমে তা অর্জন করতে হবে, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে নয়।
চরমপন্থা বা সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করতে হলে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে। ফ্যাসিস্ট ইসলামপন্থী ,দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী যে পন্থীই হোক, তাদের মোকাবেলার এটাই পথ। মুসলমানদের বুঝতে হবে, গণতন্ত্র ইসলামের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কোন ধর্ম মেনে চলা বা না মেনে চলা ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এ নীতির সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই। কুরআনের মৌল নীতি হচ্ছে, ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর খাটানো যাবে না, কোন ধর্মমত গ্রহণ করতে বা না করতে কাউকে বাধ্য করা যাবেন না। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মৌল ধারণার মধ্যে রয়েছে পরমতসহিষ্ণুতা, মতামতের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা এবং শ্রেণী-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমানাধিকার। ইসলামী মূল্যবোধের সাথে এর কোন বিরোধ নেই। আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত, মার্কিন নেতৃত্বে পরিচালিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ ছিল একটা অবিবেচনা প্রসূত পদক্ষেপ এবং তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আফগানিস্তানে আল-কায়েদা পরাজিত হয়নি এবং তা এখন মালি, সোমালিয়া, ইয়ামেন ও সিরিয়ায় সম্প্রসারিত হয়েছে। সামরিক অভিযান, এমন কি ড্রোন হামলা করেও একে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সামরিক অভিযান এবং ড্রোন হামলা বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নতুন নতুন বিক্ষুব্ধ মানুষ সৃষ্টি করছে। এ সকল বিক্ষুব্ধ মানুষ মানব সমাজের জন্যে ফ্রাঙ্কেস্টাইন হিসেবে আবির্ভূত হবে। আমাদের সবাইকে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। মুসলমানদের নিজের উদ্যোগে চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে। সকল মানুষকে গণতান্ত্রিক কর্মতৎপরতায় অংশ গ্রহণের সুযোগকে সম্প্রসারিত করার জন্যে কাজ করতে হবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যে সকল নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে সে ব্যাপারে মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের সচেতন করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং ধর্মীয় চরমপন্থার পথ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
এখানে একটি পুরানো ঘটনার প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কারো কারো মনে থাকতে পারে, ২০০৪ সালে আমস্টারডামের রাস্তায় জনৈক মুসলমানের হাতে চিত্রপ্রযোজক থিও ভ্যানগগ নিহত হবার পর মরক্কো বংশদ্ভূত ন্যাদারল্যান্ডের অধিবাসী লেবারদলীয় এক মুসলিম রাজনীতিবিদ আহমদ আবু তালিব অত্যন্ত চমৎকার একটি বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি তখন বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বৈষম্যহীনতা নেদারল্যান্ড-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি। যারা দেশের মৌলিক এ মূল্যবোধের সাথে একমত নয় নেদারল্যান্ডের ‘ওপেন সোসাইটি’ বা খোলামেলা সমাজে তাদের স্থান নেই। যারা এ সকল মূল্যবোধের সাথে একাত্ম হতে পারেন না তাদের প্রতি আমার পরামর্শ, আপনারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন।’ তাঁর এ বক্তব্যের কারণে আহমদ আবু তালিবকে নেদারল্যান্ডের স্থানীয় সাদা বাসিন্দারা আপন করে নেয়নি। আর অনেক মুসলমান তাকে স্থানীয় বাসিন্দাদের এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু আহমদ আবু তালেবের ঐতিহাসিক এ বক্তব্যটি ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। উলউইচ হত্যাকান্ডের পর লন্ডনের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আজমল মাসরুর স্কাই টিভিতে প্রদত্ত ইন্টারভিউয়ে একই ধরণের সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। তিনি সন্ত্রাসী বা চরমপন্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আপনারা যদি বৃটেনকে এতই অপছন্দ করেন তা হলে আপনারা পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে এ দেশ ছেড়ে কেন চলে যাচ্ছেন না? আর আপনারা যদি সরকারের নীতি পছন্দ না করেন তা হলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেন এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এগিয়ে আসুন।’
আমাদের কারো অজানা নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহের অনেক মানুষ নিজ দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিলাতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বসবাস করছেন। আইনের শাসন, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, ন্যায়-বিচার ইত্যাদির বিচারে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বৃটেনের অবস্থান শীর্ষে। যারা ইসলামী রাষ্ট্র বা শরিয়া আইনের কথা বলে বিলাতের রাস্তায় শ্লোগান দেন তাদের বোঝা উচিত, শরিয়া আইনে যে সাম্য ও ন্যায় বিচারের কথা বলা হয়েছে তা তথাকথিত মুসলিম দেশগুলোর চেয়ে বৃটেনে আমরা অনেক বেশি উপভোগ করছি। বর্তমান ঘটনা থেকেই একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। উলউইচ হত্যাকান্ডের আসামীদের আটক করার আগে বৃটিশ পুলিশ গুলি করে তাদের আহত করেছে। কারণ, ঘাতকদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য ছিল। এ সময় গুলি করা ছাড়া পুলিশের সামনে অন্য কোন উপায় ছিল কি না তা অনুসন্ধান করে দেখার নির্দেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পুলিশ কমিশনকে দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পুলিশের গুলিতে এবং পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়ে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। তা নিয়ে সরকার বা পুলিশ মোটেই মাথা ঘামাচ্ছে না। বিভিন্ন মানুষকে রিমান্ডে নিয়ে বাংলাদেশের পুলিশ দিনের পর নির্যাতন করে পঙ্গু করছে বা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীরা পর্যন্ত এ ব্যাপারে টু শব্দ করছে না। শরিয়া আইনের ন্যায়-ইনসাফের কথা বলতে হলে আপনারা নিজেদের দেশ বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে গিয়ে বলুন। মানবাধিকার ও মানবতা সে সব দেশেই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। ঘৃণা ও সন্ত্রাসের প্রচার করে মুসলমানদের জন্যে নিরাপদ এবং শান্তিতে বসবাসের এ দেশকে বিনষ্ট করবেন না।
যারা চরমপন্থা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে এ দেশকে উত্তপ্ত করে তুলতে চায় তারা অবশ্যই মানবতার দুশমন। এ দেশের চরম দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী এমনিতেই মুসলমান এবং ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে নানা রকম উস্কানিমূলক কথাবার্তা প্রচার করে বৃটেনবাসীকে উত্যক্ত করছে। কিন্তু বহুজাতিক সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ উদার গণতান্ত্রিক বৃটিশ সমাজ কখনো তাদের প্ররোচনায় কর্ণপাত করেনি। বিলাতের সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ বহুজাতিক গণতান্ত্রিক চেতনার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ। অপরদিকে ইসলামের বাণী ঘৃণা বা বিদ্বেষের নয়, ভালোবাসার। ইসলামের পথ চরমপন্থা নয়, মধ্যমপন্থা। ইসলামের পথ সন্ত্রাস নয়, ডায়লগ। মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা পৃথিবীর যেখানে যায় সে দেশকেই তারা নিজেদের দেশ মনে করে। বৃটেনের মুসলমানরা এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের ইমিগ্র্যান্ট মুসলমানদের প্রায় সকলের মধ্যে এ মনোভাব রয়েছে। অধিকন্তু, তৃতীয় প্রজন্মের মুসলমানদের কাছে বৃটেন দ্বিতীয় স্বদেশ নয়, একমাত্র স্বদেশ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশকে তারা মা-বাবার দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। তৃতীয় প্রজন্মের ইমিগ্র্যান্টরা বিলাতের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণের মাধ্যমে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। তারা এ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে নিজেদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি হিসেবে দেখে। জীবন দিয়ে হলেও তারা এ দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে বদ্ধপরিকর।
সহমর্মিতা, ক্ষমা, সহনশীলতা ও ভালোবাসায় সমৃদ্ধ বাণী নিয়ে মুসলমানরা এ দেশে এসেছে। মুসলমানদের মধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ব্যক্তি বা গ্রুপের তৎপরতা বৃটিশ সমাজে বিভক্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হলে এর দায় শেষ পর্যন্ত মুসলমান এবং ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটির সকলকে বহন করতে হবে। আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে বা মুসলিম স্বার্থের কথা বলে যারা মানুষ খুন করে, সন্ত্রাস করে তারা ইসলাম এবং মুসলমানদের কলঙ্ক। তাই আমাদের এ ব্যাপারে ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে আমাদের সকল প্রকার সন্ত্রাস ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যারা বৃটিশ সমাজের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পছন্দ করেন না তারা কেন এ দেশে আসেন অথবা বাস করেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। আজমল মাসরুরের বক্তব্যের সাথে এক মত হয়ে আমরা তাদের বিনীত ভাবে বলবো, এ দেশে বাস করার জন্যে আপনাদের কেউ বাধ্য করছে না। বিএনপি বা ইডিএল মুসলমান বা ইমিগ্র্যান্টদের এ দেশ থেকে তাড়াতে চায়। বৃটিশ সরকার তাদের কথা না মেনে আপনাদের এ দেশে থাকতে দিয়েছে। আপনাদের এ দেশে থাকতে পছন্দ না হলে নিজ নিজ পছন্দের দেশে চলে যেতে পারেন। সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন বা আমদানী করে এ দেশের মাল্টিকালচারেল গণতান্ত্রিক পরিবেশকে উত্তপ্ত করবেন না। মনে রাখবেন, এ দেশে চরমপন্থীদের ঠাঁই নেই।
faridahmedreza@hotmail
লেখক বৃটেন প্রবাসী শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন