প্রবাসজীবনে আমি একা থাকি, একদম নিঃসঙ্গ থাকতে হয়। আমি কোলাহলপ্রিয়, আড্ডাবাজ, হৈ হুল্লোড়ে অভ্যস্ত কিন্তু এখানে এই একাকিত্ব আমার জন্য ভীষণ অসহনীয়। আমার আশেপাশে সব উঁচু উঁচু দালান, কাতারের হাতে গোনা কয়েকটি অভিজাত আবাসিক এরিয়ার মধ্যে এটিও একটি এলাকা।
ঢাকায় যেখানে আমাদের বাসা, সম্পূর্ণ আবাসিক এলাকা হলেও তা একদম থমথমে নীরব নয়। সারাদিন ফেরিওয়ালার ডাক, ফকিরের আহাজারী, রিকশার টুংটাং, এর ওর চেঁচামেঁচি সব মিলিয়ে শব্দমুখর প্রকৃতি।
একদিন সকালে এই দোহায় আমার মোবাইলে রিং বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার থেকে কেউ একজন ফোন করেছেন।
-হ্যালো
-রায়হান সাহেব বলছেন?
জ্বী বলছি, বলুন।
-আমি আপনার নাম্বার ··ভাইয়ের এর কাছ থেকে পেয়েছি, আপনি কি আমার ছোট মেয়েটিকে বাসায় এসে একটু পড়াতে পারবেন?
-আপনি কোথায় থাকেন?
-এই তো আপনার হোস্টেলের পাশেই, হেঁটে এলে পাঁচ মিনিটও লাগবে না।
-জ্বী আচ্ছা, আমি কাল জানাবো।
সংযোগ বিচ্ছিন্ন হল।
আমি কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পরিচিত পরিভাষায়- টিউশনি। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে কিছু যুক্তি ছিল। কারণ পড়ানোর সময়টুকু অন্তত একটি বাংলাদেশী পরিবারের সাথে থাকা হবে। রাতের ফুরফুরে বাতাসে কিছুক্ষণ হাঁটাচলাও করা হবে। আর একইসাথে সময়-সুযোগ হলে বাংলাদেশী খাবারও হয়তো খাওয়া হবে, এসব ভেবে মনটা আনন্দিত হলো। পরদিন ঐ ভদ্রলোকের সাথে কথা হলো। বিনিময়-বেতন কিংবা সম্মানী- এসবের কথা কিছুই ঠিক হয়নি। আমি ‘পদব্রেজে’ গিয়ে পড়ানো শুরু করলাম।
সুউচ্চ দালানের সুরম্য ফ্ল্যাট। আধুনিক সরঞ্জামে ঠাসা পরিবারের বাসা। নয় বছর বয়সী আমার ছাত্রী। বাংলা ভাল করে বুঝে না, বলতেও পারে না। অগত্যা ইংরেজী ভাষাই ‘ভরসাতরী’।
যতদূর জানা আর যতখানি দেখা, ঢাকা শহরে বাসায় পড়াতে গেলে ‘স্যার’ কিংবা ‘প্রাইভেট টিউটর’ অথবা ‘মাস্টার মশাই’কে প্রতিদিনই হালকা নাস্তা দেওয়া হয়। আমাদের বাসার রেওয়াজ অন্তত এমনই। পরিবার মধ্যবিত্ত হলেও অন্তত এক কাপ চা কিংবা এক গ্লাস শরবত। মাঝে মাঝে বাসায় ভালো সুস্বাদু খাবার রান্না হলে কিংবা কোন অতিথির আগমন হলে টিউটরকেও নিমন্ত্রণ জানানো হয়। রক্তের বাধঁনবিহীন একজন অপরিচিত ‘স্যার’ হয়ে উঠেন পরিবারের একান্ত আপনজন।
ঢাকা ছেড়ে এবার কাতারের কথা বলছি। যথারীতি আমি প্রতি রাতে পড়াতে যাই। ছাত্রী গোমড়া মুখে পড়তে আসে, আমার নানা হাসি-কৌতুকে সে খুশী মুখে পড়া শেষ করে। ওরা দুই বোন। ছোটটির বয়স পাঁচ। দু বোনই আমার আগমনি কলিংবেল শোনামাত্র প্রতিযোগিতা দিয়ে দরজা খুলে দেয়, আগে সালাম দেয়ার জন্য মারামারি লেগে যায়। আমি যখন চলে আসি, দরজায় দাড়িয়ে ‘বাই ··বাই’ বলতে থাকে- যতক্ষণ আমাকে দেখা যায়। মানুষকে আপন করে ফেলার আমার প্রকৃতিগত শক্তির এটি সামান্য বহিঃপ্রকাশ হয়তো। আমার নিত্য নতুন কৌশলের পড়ানো দেখে ওদের বাবাও খাতা-কলম নিয়ে বসেন। প্রয়োজনীয় উদাহরণগুলো তিনি নোট করে রাখেন। আমিও আমার সাধ্যমতো আনন্দময় পদ্ধতিতে তাদেরকে পড়াতে থাকলাম।
আমাদের এই হোস্টেলে রাতের খাবার অতি আধুনিক। এই ‘অতি’ আমার জন্য ‘ক্ষতি’। প্রায় প্রতিদিন রাতের খাবারের কিছু মেনু এ রকম- নুডলস, ম্যাকরনি, পিজা, নানা পদের স্যান্ডউইচ, ফ্রাই চিকেন, কাবাব, স্যুপ ইত্যাদি। ভাত তো দূরের কথা, কোন পদে একটু ঝোলেরও দেখা নেই যে রুটি-পাউরুটি দিয়ে ভিজিয়ে খাব। কওমী মাদরাসার ডাল-ভাতের সন্তান আমি। কত বছর বছর চুকচুক করে পাতলা ডাল পিয়েছি টিনের থালায়। এখানে এসব সামনে নিয়ে সেই অতীতের দৃশ্য মনে পড়ে যায়। একটু ডাল-ভর্তা-ভাতের জন্য আমার পেটের কাকুতি-মিনতি আর ক্ষুধাতুর মনে হাহাকার ওসব বার্গারের নীচে তলিয়ে যায়। আশেপাশে কোন বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টও নেই যে ওখান থেকে বাঙালিয়ানা সত্ত্বার এ চিরন্তন দাবী পরিশোধের ব্যবস্থা করা যায়।
এই ‘টিউশনি’ পাওয়ার পর থেকে আশায় আশায় থাকি, হয়তো মাঝে মাঝে সাদা ভাত আর ছোট মাছের কোন তরকারি অথবা কোন ভাজি আর ডাল এর ভোজন জুটবে। গৃহকর্তা হয়তো একদিন বলবেন, ‘আসেন, একটু ডাল-ভাত খেয়ে যান, গরীবের সামান্য আয়োজন।’ কিন্তু না, সময় গড়িয়ে যায়, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আর আসে না।
আমি যখন ছোট মেয়েটিকে পড়াতে বসি, ওর মা তখন এসে রান্নাঘরে ঢোকেন। পড়ার রুমের পাশেই রান্নাঘর। পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে আসে চামচের টুংটাং শব্দ, তেলে ভাজার শিশি শব্দ। গৃহকত্রির এমন ব্যস্ততার আওয়াজ শুনে আমি প্রথম দিকে ভাবতাম, হয়তো আমার জন্য নাস্তা তৈরী হচ্ছে। তিনি হয়তো ছোলাবুট, পিঁয়াজু, পিঠা, ঝালমুড়ী বা অন্যকিছু ভাজছেন। চা’টা হয়ে গেলেই ট্রেতে করে পাঠিয়ে দিবেন।
কিন্তু হায়! ঘড়ির কাঁটা ঘুরে ৬০ মিনিট এর ঘর পেরিয়ে যায়!! আমার স্বপ্ন-কল্পনাও শুকনো ডানায় উড়ে যায়। আমি উঠে দাঁড়াই, রুম থেকে বের হয়ে আসি, তাও কারোর ডাক শুনতে পাই না, কোন ঘটিবাটির দেখা পাই না। একটু চা কিংবা কফিও না। আমার হাসিমুখের হাসি ডুবে যায়, মলিন মুখে পা বাড়াই হোস্টেলের দিকে।
আবার ফিরে আসি হোস্টেলের কথায়। আমাদের ‘ক্যান্টিনে’ ট্রে উপচে পড়ে খাবারে। প্রত্যেকের জন্য একটির জায়গায় দুটি নয়, তিনটি-চারটি করে করে পরিবেশন করা হয়। আমি সেসব সামনে নিয়ে আনমনে চিবিয়ে যাই, ক্ষুধার্ত পেটে গিলে যাই। এসব খাবারে ঝালের ‘আহ!’ নেই, কিংবা টকের ‘উহ!’ নেই, ঝাল-মশলাবিহীন এসব খাবারে যমেরও অরুচি হতে পারে।
ভদ্রলোকের বাসায় তার মেয়েটিকে পড়াতে যাওয়া-আসার সময় ভাবি, এই নিঃসঙ্গ দোহায় কিছু বাংলাদেশী পরিবার আমাকে নিমন্ত্রণ জানায়। আমি জানি, বেশীর ভাগ পরিবারের কোন না কোন স্বার্থ থাকে আমাকে নিয়ে- এই যেমন তাদের কারো ভাই-ভাতিজা-ভাগিনা ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য তথ্য-পরামর্শ, কারো হয়তো কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের কোন সফটওয়্যার সমস্যা সমাধান, নয়তো আমি দেশে যাওয়ার সময় তাদের দু-তিন কেজি মালপত্র যেন নিয়ে যাই, এমন নানাবিধ প্রয়োজনে তারা আমাকে ডাকেন, খাতির করে আমন্ত্রণ করেন। খুব হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার আমাকে শুধুই ভালোবেসে আমন্ত্রণ করেন।
এসব জেনেও আমি হাসিমুখে ‘আরে আসবো না মানে, অবশ্যই আসবো’ বলে সায় দিই। নির্ধারিত সময়ে ওখানে গিয়ে হাজির হই। তাদের চাহিদা আর আমার পেটের ক্ষুধা মিলে একাকার হয়ে যায়। বলতে দ্বিধা নেই, কোন কোন পরিবারের রান্না অতি সুস্বাদু, রকমারী রান্নার কয়েক পদের লোভনীয় আয়োজন, আমি ‘রান্নাটা তো দারুণ হয়েছে··’, কিংবা ‘অনেকদিন পর এমন স্বাদের রান্না পেলাম ভাই’ বলে বলে প্রোগ্রাসে গিলে যাই ডাল-ভাত, ভাজি-ভর্তার লোকমাগুলো। যদিও আমার হোস্টেলের এক বেলার খাবারের খরচ দিয়ে এমন চার বেলার খাবার যোগাড় করা যাবে। আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন এই বাসাটির সামনে এসে পৌছি। কিন্তু এরা কেমন পরিবার! এত বিত্তবান হয়েও এরা এমন নিরস কেন! এক গ্লাস সাদা পানিও কোনদিন নিজেরা সাধেনি। একেই কি বাংলায় বলে- ছোটলোকি!
দিন গিয়ে সপ্তাহ পার হয়। একসময় মাস ফুরিয়ে যায়। মাসের শেষ তারিখ অতি সন্নিকটে। মনের কোণে অজানা শঙ্কা জেগে উঠে, আপ্যায়নবিহীন সমাদরশূন্য এ পরিবারটি আমার কষ্টার্জিত বেতনের কথা ভুলে যাবে না তো আবার?
······
না, ভয় নেই। বেতন পেয়েছিলাম। যা আশা করেছিলাম তার এক তৃতীয়াংশ। হাসিমুখেই বলেছিলাম, দেখুন! আমি আর আসতে পারছি না, আপনারা অন্য কাউকে খুঁজে নিন।’ ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন ফিরে আসার সময় ‘দুঃখিত’ বলার সৌজন্যের কথা। কারণ আমার অনেক অনেক প্রাপ্য তাদের কাছে বাকী রেখে এলাম। কী লাভ তাই মুখে কৃত্রিম ‘সরি’ বলার। প্রবাসজীবনের অসংখ্য অদ্ভুত, হাস্যকর এবং একইসাথে বেদনাময় স্মৃতিগুলোর সুদীর্ঘ তালিকায় এই পরিবারটি তাদের অবস্থান করে নিয়েছে। এটুকুই বা কম কী। কাতারে টিউশনি অধ্যায়ের এখানেই সূচনা, এখানেই সমাপ্তি।
শিক্ষার্থী, কাতার ইউনিভার্সিটি, দোহা, কাতার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন