সাপ্তাহিকী
|
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
|
|
নির্বাচিত সরকারের শেষ বৎসরের কাসুন্দি
26 May, 2013
রাজনৈতিক সংকটের ঘনঘটা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির আকাশকে মাঝে মাঝেই কালো মেঘে ছেঁয়ে ফেলে, প্রচন্ড গতিতে আঘাত হানার পূর্বাভাসও দেয় । আবার তা কেটে গেলেও পুনরায় আঘাত হানার সম্ভাবনা রেখে যায় । বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের মধ্যে একটা অদ্ভূত মিল অর্থাৎ সামঞ্জস্য বিদ্যমান । দেশের উপকূলীয় জনগন সহ দেশবাসী যেমনি প্রতি বৎসর কাল বৈশাখী ঝড় ও জলোচ্ছাসের আঘাত মোকাবেলা করতে হয় ঠিক তেমনি প্রতিটি সরকারের মেয়াদের শেষ বৎসরটিতে রাজনৈতিক তান্ডব জনগনের জীবনে নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে । রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাস অবিশ্বাসের বৈরী সম্পর্কের কারনে প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের শেষ বৎসরটি বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলনে উত্তাল থাকে ।
নব্বইয়ে স্বৈরাচার পতন পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচিত সরকারই তাদের মেয়াদের শেষ বৎসরটি রাজনৈতিক উত্তালতার মধ্যে পড়েছে এবং প্রতিবারই গণতান্ত্রিক ধারা টিকবে কি টিকবেনা এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে । এহেন পরিস্থিতিতে জনগন রাজনৈতিক সরকার ও প্রধান দলগুলোর প্রতি বিরূপ মানুষিকতা পোষন করে এবং সুযোগটি গ্রহন করে অনির্বাচিত সরকার, আর এর সর্বশেষ সংযোজন ১/১১ এর মঈন ফকরুদ্দিন ও ইয়াজউদ্দিনের সরকার ।
বর্তমান আওয়ামী লীগ নের্তৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ইতিমধ্যে মেয়াদকালের শেষ বৎসরটি কাটাচ্ছে । বিগত চার বৎসরে সরকারের যেমনি কিছু সফলতা আছে, তেমনি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করন ও লুটপাটের কারনে ব্যর্থতাও আছে । সরকারের শিক্ষা, কৃষি ও বর্তমান যোগাযোগ মন্ত্রীর সফলতাকে ম্লান করে দিয়েছে শেয়ার বাজার, পদ্মা সেতু, হল মার্ক কেলেংকারী ও সন্ত্রাস দমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীন কথাবার্তা ও হাস্যকর ঝাঁকুনী তত্ত্ব । এছাড়াও পূর্বাপর সরকার গুলোর ধারাবাহিক খামখেয়ালীপনা ও ব্যবসায়ীদের সীমাহীন লাভের আগুনে তাজরীনে ১১২ জন গার্মেন্টস্ শ্রমিক পুঁড়ে মরেছে এবং রানা প্লাজা ধ্বসে প্রায় ১১২৮ জন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে । এই ব্যাপক সংখ্যক নিন্ম আয়ের গার্মেন্টস্ কর্মীর মৃত্যুরোধ কল্পে মালিক শ্রেনীর পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষনকারী সরকারী দল ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠা দেখা যায় না । উপরন্ত দুর্ঘটনা ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে মিডিয়ায় প্রচার করলে বাজার নষ্টের ধুঁয়া তুলে চেপে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে বক্তব্য রাখেন । অথচ দুর্ভাগা এই শ্রমিকরা ঘুরে ফিরে এই দল দুইটিকেই ভোট দেয় বা দিতে হয় । যদিও শ্রমিকের ভোটে নির্বাচিত সরকারগুলি শ্রমিক নয় মালিকের স্বার্থ সংরক্ষনেই অধিক মনোযোগী ।
সরকার এসব দুর্ঘটনায় শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিবাদী আন্দোলনে ক্ষমতা হারানোর মত চাপ অনুভব না করলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও পরবর্তী সরকারের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনের চাপে পড়েছে । সরকার ঠিক ভাবে তাদের মেয়াদকাল শেষ করতে পারলে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বেশীর ভাগ অপরাধীর বিচারের রায়ের পর্ব শেষ হবে এবং কয়েকজনের রায় কার্যকরও হবে । তাই যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাতে ইসলামী বিচারকে ভন্ডুল করতে সরকার পতনে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করছে আর এক্ষেত্রে তাদের জোটের মিত্র বিএনপিও সহযোগিতা করছে ।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ঘটনা প্রবাহে এক পর্যায়ে গণজাগরণ ও হেফাজতের আবির্ভাব ঘটে । বিএনপি জামাতের সহযোগিতায় হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফার আন্দোলনের চাপে সরকারকে কোনঠাসা পর্যায়ে নিয়ে আসে । বিএনপির ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম এবং হেফাজতের মতিঝিলে অবস্থানে জামাত-শিবিরের ধ্বংসলীলা সরকার পতনের আশংকা তৈরী করে । হেফাজতের মতিঝিলের অবস্থানে খালেদা জিয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের অবস্থানের নির্দেশ দেন । বিএনপির নেতাকর্মীরা খালেদা নির্দেশনা মাফিক হেফাজতের পাশে দাঁড়ালে সরকার সত্যিই সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে পড়ত । বিএনপি-জামাত হেফাজতের ওপর ভর করে অভীষ্ট লক্ষ্যে সরকারকে নেয়া সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র । কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা রাতের বেলায় অবস্থান না নেয়ায় সরকার রাতেই পুলিশী আক্রমনে হেফাজত কর্মীদের মতিঝিল থেকে সরিয়ে দেয় । সরকার হেফাজতের মতিঝিল ষড়যন্ত্রকে গুড়িয়ে দিয়ে ওল্টো হেফাজতকেই কোনঠাসা অবস্থায় নিয়ে গেছেন । এর কারনে বিরোধী দলের আন্দোলনও ঝিমিয়ে পড়েছে । তাই সরকারের মধ্যে ফুরফুরে আমেজ ও স্বস্থি পরিলক্ষিত হচ্ছে ।
বিরোধী দলের এই ঝিমিয়ে পড়া অবস্থায় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সারাদেশে একমাস সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছেন । এই ঘোষনায় অনেকেই অবাক ও বিস্ময় প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছেন । গনতন্ত্র চর্চা ও গনতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সরকারের এই সিদ্ধান্ত কোন ভাবেই কাম্য নয় । কারো কারো মতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিরোধী দলের ঝিমিয়ে পড়া রাজনীতিকে চাঙ্গা করতে সহায়ক হবে এবং সরকার বিরোধী মত দমনে কতটা অগনতান্ত্রিক আচরণ করছে, তা ফুটে ওঠবে । তাই সরকারী দল ও সরকারী দলের জোট মিত্রদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করছেন । বিজ্ঞ সুশীল সমাজের মতে, গনতান্ত্রিক রাজনীতি বিকাশের স্বার্থে সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করাই বাঞ্চনীয় । নতুবা রাষ্ট্রে অগনতান্ত্রিক শক্তি উত্থানের সম্ভাবনা তৈরী হতে পারে ।
রাজনীতি সচেতন নাগরিকদের ভাবনা সরকার আপাত দৃষ্টিতে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা কেন্দ্রিক উত্তেজনা দমনে সক্ষম হলেও বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটির সফল সমাধান না হলে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে জামাতে ইসলামী সহিংসতা ও ষড়যন্ত্র মূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে আরেকটি ১/১১ এর মত পরিবেশ তৈরীতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে । যা দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির ধারাকে ব্যাহত করবে । তাই রাষ্ট্রের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় সরকারের উচিত বিরোধী দলের দাবিটির ন্যায্যতা অনুভব করে সংলাপে উদ্যোগী হয়ে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলা । যাতে পরবর্তী সরকারও তাদের শেষ বৎসরটিতে অনুরুপ আন্দোলনের মুখে না পড়ে এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখা যায় ।
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম ।
প্রবাসী, জাপান ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন