সাপ্তাহিকী
|
সাইফ বরকতুল্লাহ
|
|
নতুন বাংলাদেশের সন্ধানে
26 May, 2013
এক.
বাংলাদেশে এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন তার অভাবে এখন অসুস্থ রাজনীতিই বিষবৃক্ষ হয়ে ডালপালা মেলছে। স্বাধীনতার চার দশক পর আজও পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে বিভক্ত দেশের মানুষ। কিন্তু এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা মানতে চাইলেও, সত্যটি কিন্তু দিন দিন প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে। হত্যার রাজনীতি, গুমের রাজনীতি, দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজনীতি, স্বৈরাচারী রাজনীতি, মিথ্যার রাজনীতি, হরতালের রাজনীতি, ধ্বংস, জ্বালাও পোড়াও এসবের রাজনীতি, এগুলোই এখন বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক চরিত্রকে বর্ণনা করে।
দুই.
সমাজের সর্বস্তরে, মানুষ সাম্প্রতিক সময়ের ক্ষুব্ধ স্রোতধারা দেখে শঙ্কিত। আমাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন প্রবল ভাঙনের আওয়াজ। রাজনীতি এখন অশান্ত ও অস্থির। এ ক্ষেত্রে স্থিতি অনেক দিন ধরেই অনুপস্থিত। কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি ??
তিন.
জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আজ মনে করে, রাজনীতিতে সক্রিয় বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী নির্জলা ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত। এর মধ্যে যারা বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন, তারা আখের গোছাতে ব্যস্ত। রক্তরঞ্জিত রাজনৈতিক সংঘাত তাদের বিচলিত করে না। গ্রামে-জনপদে পড়ে থাকে সংখ্যাহীন লাশের কাতার। তারা প্রাণ দেয় ভয়াবহ রাজনৈতিক সংঘর্ষে। মৃত্যুর পর তাদের প্রাণহীন দেহে কোন দলের মার্কা পড়ে আছে তা নিরীহ-সাধারণ মানুষের বিবেচনায় স্থান পায় না, তারা শুধু ফেলে অবিরাম চোখের পানি। সংক্ষুব্ধ রাজনীতির মূলে রয়েছে এক বিভেদ ও বিভক্তি।
চার.
ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে কেবল রক্ত আর রক্ত ঝরছে। রাজধানী, গ্রাম, লাশ পড়ছেই। একের পর এক হাঙ্গামায় মরছে মানুষ। এই মিছিলে আছেন সাধারণ মানুষ, আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। হতাহত হচ্ছেন হাজারো মানুষ। ফেব্রুয়ারির শেষ দিন থেকে ৬ মে পর্যন্ত কয়েক শ মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। তাদের অধিকাংশ সাধারণ নাগরিক। তারা কোনো দল করেন না, তারা কোনো রাজনৈতিক স্বার্থের পেছনে ছোটেন না। অথচ তাদের প্রাণ দিতে হচ্ছে, তাদের শরীর থেকে ঝরছে রক্ত। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর মৃত্যুদ-ের রায়ের পর সৃষ্ট সহিংসতায় ৩ মার্চ পর্যন্ত চার দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ প্রাণ গেছে প্রায় দেড়’শ ব্যক্তির। এর মধ্যে ৭০ জনের বেশি সাধারণ মানুষ। সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত এলাকায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজতকর্মীদের সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ২০ জন, যার মধ্যে তিনজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, অন্য ১৭ জনই সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যে আছেন রিকশাচালক, টেম্পোচালক, বাসের সহকারী, ব্যবসায়ী, পোশাককর্মী, এসএসসির ফলপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী, এইচএসসি পড়ুয়া ছাত্র, ওয়ার্কশপের কর্মচারী। [ সূত্র : ০৭. ০৫. ২০১৩, নতুনবার্তা ডটকম ] আছে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন। তারা কেউ জীবিকার সন্ধানে বেরিয়েছিলেন, কেউ ব্যক্তিগত কাজে। কেন তারা মারা গেল এর কোন জবাব কোথায় পাব ?
পাঁচ.
বর্তমান সংঘাত ও শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে দেশের সামনে যেমন ঘোরতর অমানিশা দেখা দিয়েছে তেমনি দেখা দিয়েছে অর্থনীতি, বাণিজ্য বিনিয়োগে স্থবিরতা। চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য করে কারো জীবন যাপনের সুযোগ নেই। মধ্যপ্রাচ্য, মুসলিম দেশ, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কোন দেশের সাথেই এখন সরকারের সুসম্পর্ক নেই। সার্বিক দিক দিয়ে অনিশ্চয়তা ও গন্তব্যবিহীন যাত্রার কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ থমকে গেছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিই এখন স্থবির।
পাঁচ.
সব মিলিয়ে আমরা ভালো নেই। দিনের পর দিন চলছে সংঘাত। এ অবস্থা সামনের দিনগুলোতে কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যে পথে পা বাড়িয়েছে, সে পথ দুর্গম। সে পথ অগম্য। সে পথ ভয়ংকর উত্তপ্ত।
ছয়.
জনগণের চিন্তা চেতনা ধারণ না করা এবং দেশের বিশিষ্টজনদের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে বিদেশীদের প্রতি অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি। প্রভাবশালী দেশের ওপর নির্ভরশীলতাই দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দুই শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার। জিএসপি সুবিধা, শ্রমবাজারসহ নানাবিধ কারণে অনেক আগেই দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে কূটনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতাসীন দলের গোয়াতুর্মি আর বিরোধী দলের একগুঁয়েমিতে ‘নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা’ দেখায় দেয়ায় দেশের সাধারণ মানুষ ও বিশিষ্টজনরা দুই দলকে সংলাপে বসার প্রস্তাব দেয়। অনেকেই কিছু ফর্মূলা-রূপরেখা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তাদের প্রস্তাব ও রূপরেখা সরকার প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ভাবনায় পড়ে যায় প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিকমহল। তারা এতোদিন উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় কথা জানিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘাত বন্ধের চাপ দেয়। এ অবস্থায় প্রভাবশালী দেশগুলো সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধানে দুই পক্ষের ওপর ‘নতুন করে চাপ প্রয়োগ’ করছেন। জাতিসংঘ, আমেরিকা, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের’ দৌড়ঝাঁপ বেড়ে যাওয়ায় কার্যত রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন দুই নেত্রীর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাত.
এ অবস্থা উত্তরণের একটাই পথ সংলাপ বা আলোচনা। জনমানুষের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এ বিষয়ে সব পক্ষের সংযম একান্তই প্রযোজন। সবার সুবিবেচনা ও সুমতি দেশ ও জাতিকে কঠিন সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। তা না হলে গণতান্ত্রিক শাসনের কান্না ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। মানুষের স্বাভাবিক নিরাপত্তা প্রতিনিয়ত ভুলুন্ঠিত হবে। দেশে অপশাসনের সুযোগ অবারিত ও উন্মুক্ত হবে। তাই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের আত্মমর্যাদা রক্ষা ও দেশের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করে সুস্থ রাজনীতির পরশে দেশের মানুষের জীবন মানের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলেই নতুন বাংলাদেশের আলোয় আলোকিত হবে সাধারণ মানুষ।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও ব্লগার
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন