সাপ্তাহিকী
|
এ, কে, এম, মহীউদ্দীন
|
|
ষাণ্ডা-পাণ্ডাদের হাতে পড়া এই দেশ ও সমাজ বাঁচবে কিভাবে?
12 May, 2013
ষাণ্ডা-পাণ্ডাদের হাতে দেশ পড়লে কি হয় সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ একটা আগাম সতর্কবাণী মাত্র। সারা দেশটাই আজ বিভিন্ন ভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবার পথে।
ষাণ্ডা-পাণ্ডা কারা? শুধুই কি রানা একা বা তার হুকুমে যেক’জন চলে সেক’জন? রানার যিনি স্থানীয় সমঝদার ও মুরুব্বী সেই সংসদ সদস্য কি? সেই মুরুব্বীর যারা মুরুব্বী তারা কি? উপর থেকে নীচে পর্যন্ত সবাই কি এক সুতায় গাথা নয়? ষাণ্ডা-পাণ্ডা তাদের সবাই। কিছু চালাক মানুষ আছে নোংরা কাজ নিজের হাতে করেনা। অন্যদের দিয়ে করায়। ষাণ্ডা-পাণ্ডারাই তাদের হাত-পা। মুরুব্বীদের আছে মাথা ও জিহ্বা। ষাণ্ডা-পাণ্ডাদের আছে হাত-পায়ের বল ও ক্লান্তিহীন কর্মোদ্দীপনা। এদের ছাড়া মুরুব্বীদের জীবন অচল। মুরুব্বীদের দরকার সমাজের রানাদের, আবার রানাদের দরকার উচু অবস্থানের চতুর মুরব্বীদের। রানাদের গড়ে তোলার জন্য ভাল মানুষকেও মুরুব্বীরা নষ্ট করে দেয়। কারণ নিজেদের কুমতলব হাসিলের জন্য খারাপ কাজ করার উপযুক্ত মানুষ তাদের চাইই। সরাসরি কুকর্ম করা ষাণ্ডা-পান্ডাদের চেয়েও জঘন্য এই মুরব্বী শ্রেণীর দুর্বৃত্তগুলি।
একা রানার জন্য এতো বড়ো একটা বিপর্যয় আসেনি। তার মুরুব্বীরা তাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছে, তার সহযোগীরা তার সাথে এক হয়ে কাজ করেছে, তার অনুগত লোকজন তার কাজে আঞ্জাম দিয়েছে, সরকারি লোকজন আজ্ঞাবহ হয়ে তার খিদমত করেছে এবং দুর্ঘটনার পর তাকে পালাতেও সাহায্য করেছে। সবকিছুর জন্য সে একটা উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে। বলা যায় একটা সক্রিয় সম্মিলিত উদ্যোগের মধ্য দিয়েই এই গজব রচনা করা হয়েছে। শাস্তি হতে হলে তাই শুধু একা রানার নয়, এদের সবারই তা হওয়া উচিৎ। হয়তো রানার চেয়েও বেশি।
সাভারের এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগকে কি বিচ্ছিন্ন করা যায়? দলের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়েই তো সেদিন এতোগুলি দরিদ্র নারী ও পুরুষদের জোরজবরদস্তি করে ও ভয় দেখিয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ঐ ফাটল ধরা ভবনে ঢুকানো হয়। সাভারের জনগণ হরতাল প্রতাখ্যান ও প্রতিহত করেছে এটা দেখনোই তো প্রয়োজন ছিল দলের। এরই আঞ্জাম দিতে গিয়েছিল দলের একান্ত অনুগত, উচ্চাভিলাষী ও উৎসাহী উঠতি নেতা হিসেবে রানা। দলীয় প্রয়োজন ও নিজের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসের কাছে সমস্ত সুস্থ ও মানবিক বিবেচনা হার মেনেছে। ভবনটা এভাবে ভেঙ্গে না পড়লে ও তার পরিণতিতে এতো মানবিক দুর্দশা না ঘটলে রানার মুল্য ও মর্যাদা কি বৃদ্ধি পেতো না দলের কাছে? অতএব আওয়ামী লীগও এই হৃদয় বিদারক ঘটনার মুলে একটি প্রধান চরিত্র। অবর্ণনীয় এই দুঃখদুর্দশা ও ক্ষয়ক্ষতির দায় থেকে আওয়ামী লীগের মুক্ত হবার কোন উপায় নেই।
আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলেই মুরুব্বীদের অধীনস্থ ষাণ্ডা-পাণ্ডা আছে। কম আর বেশি। মিছিলে ও জনসভায় এদেরকেই সবচেয়ে সক্রিয় দেখা যায়। নির্বাচনের সময় এলেই দেখা যায় পাড়ার যতো কুলাঙ্গার নেমে পড়েছে কোন না কোন দলের পক্ষে প্রচারকাজে। এদের ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির চাকা ঘুরবেনা। অন্যান্য দলেও সামান্য কিছু ষাণ্ডা-পাণ্ডা হয়তো আছে। কিন্তু সেসব দলের সাথে থেকে তেমন লাভ হয়না বলে তারা সেগুলির প্রতি বিশেষ একটা আকৃষ্ট হয়না।
তবে ষাণ্ডা-পাণ্ডাদের আস্তানা হিসেবে আওয়ামী লীগকে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের মধ্যে যেমন ষাণ্ডামি ও পাণ্ডামি করার উপযুক্ত পরিবেশ মেলে তেমন আর কোথাও মেলেনা। দলটির এই ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। আওয়ামী লীগ যখনি ক্ষমতায় আসে তখনি সমাজের সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্মকারীদের চাঙ্গা হয়ে উঠতে দেখা যায়। এখন তো ষাণ্ডা-পাণ্ডাদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে আসল ষাণ্ডা-পাণ্ডা দলের মূল নেতারাই। সবার আগে এবং সবচেয়ে কঠোর শাস্তি তাদেরই প্রাপ্য। এ কথায় যদি কেউ আপত্তি তুলতে চায় তবে সেও একটা বড়ো সমস্যা দেশ ও সমাজের জন্য।
আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ আজ এই সব মুরুব্বী ও তাদের পোষা ষাণ্ডা-পাণ্ডাদের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে রানা প্লাজা কেন তারও চেয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ ও দুর্দশা আসতেই থাকবে আমাদের জীবনে। শুধু ইমারত ভেঙ্গে পড়বে না। সব কিছুই ভেঙ্গে পড়বে আমাদের ঘাড়ে। চালাকি, অর্থ, বাকপটুতা ও পেশীশক্তির আঁতাত ও সংমিশ্রণে বাংলাদেশ একটা জাহান্নামে পরিণত হয়ে যাবে। আলামত তার স্পষ্ট আজ।
দেখলাম তো মাত্র একটা মাত্র ভেঙ্গে পড়া ভুবনে উদ্ধারকাজ করতে গিয়ে কি নিদারুণ আনাড়িপনা ও দুর্গতি আমদের দায়িত্বশীলদের। ঘটনা ঘটেছে সকালে, কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও গুরুত্ব বুঝতেই তাদের দিন পার হয়ে গেছে। সরকার ব্যস্ত থেকেছে বিভিন্ন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে কমলাপুরে ও বঙ্গভবনে। উদ্ধারকাজ করতে গিয়ে দেখা যায় সরকারের সরঞ্জাম নেই, প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। লোকবল যা আছে তাদের আবার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নেই। ওষুধপত্র ও অন্যান্য দরকারি জিনিস নেই। সংসদে দাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী যে বাহাদুরির সাথে দাবী করেছিলেন দুই দিনেই কাজ শেষ হয়ে যাবে সেটা আজ পর্যন্ত সাত দিনে এসে ঠেকেছে এবং এখনও কাজ শেষ হয়নি। আসল জরুরি কাজ বাদ দিয়ে দেশের মধ্যে শুধু গণ্ডগোল পাকানো ও নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত থাকলে যে অবস্থা হয় তাই হয়েছে। ষাণ্ডা- পাণ্ডাদের হাতে দেশ থাকলে একটা বড়ো লাগবেনা মধ্যম মাপের ভূমিকম্প হলে আমাদের অবস্থা কেমন হতে পারে তার একটা সামান্য ধারনা পাওয়া গেল সভারে।
একটা জিনিসে অবশ্য ভুল বা অসুবিধা হয়নি। সেটা হচ্ছে মিথ্যা এবং আবোলতবোল বকায়। কমলাপুরে দাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন বিপদ বুঝতে পেরে ভবন থেকে সবাইকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং কিছু মানুষ ঢুকেছিল ভিতরে থাকা কিছু মুল্যবান জিনিস আনার জন্য। ডাহা মিথ্যা কথা। মুল্যবান জিনিসগুলি মালিকের না শ্রমিকের সেকথা অবশ্য তিনি বলেননি। ঐদিনই আবার সংসদে দাড়িয়ে হাতে একটা কাগজ দেখিয়ে তিনি ঘোষণা দেন যে সোহেল রানা আওয়ামী লীগের কেউ নয়। আরেকটা নির্জলা মিথ্যা কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বিরোধী দলের লোকেরা গেট ও খুঁটি ধরে নাড়াচাড়া করায় দালানটি ভেঙ্গে পড়েছে। প্রথম কথা ওখানে ছিল তো কেবল হরতাল ঠেকাতে যাওয়া আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকরাই। বিরোধী দলের কারও সাধ্য ছিলনা কাছে যাবার। আর খুঁটি ধরে নাড়াচাড়া করলেই যে দালান ভেঙে পড়ে সে দালান তৈরি হলো কিভাবে এবং তার মধ্যে এতোগুলি দোকানপাট ও তৈরি পোশাক কারখানা চালু হতে পারল কিভাবে? ষাণ্ডা- পাণ্ডাদের হাতে দেশ পড়েছে বলেই অসহনীয় দুঃখ ও বেদনার মধ্যেও এ ধরনের প্রলাপ শুনতে হচ্ছে আমাদের।
প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে আমরা বেরিয়ে আসব এদের হাত থেকে। কে আছে যে আমদের অন্তর্নিহিত অকল্যাণকর প্রবণতাগুলিকে প্রশ্রয় না দিয়ে ও পরিপুষ্ট না করে বরং তাদের বেধে ফেলতে ও দমন করতে পারবে এবং কল্যাণকর প্রবণতাগুলিকে জাগিয়ে তুলে ও শক্তিশালী করে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারবে? এতোদিনকার পরিচিত যেসব রাজনৈতিক মুখগুলিকে আমরা জানি তাদের কারো সাধ্য নেই একাজ করার। তারাই তো সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। কোণ সমাধান নয় তারা। নিজেরা কলুষময় থেকে অন্যদের কিভাবে কলুষমুক্ত করবে তারা এবং কিভাবে ন্যায় ও কল্যাণের নেতৃত্ব দেবে?
নৈতিক এই দুর্যোগের পরিবেশে হটাৎ করে সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। দেশের মানুষের মনে একটা আশা জেগেছে যে তারাই পারলে পারতে পারে। কারণ কোন কলুষ এখনো তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। আর অল্প এই ক’দিনেই তারা অসাধারণ নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ও যোগ্যতার যে স্বাক্ষর রেখেছে তার নজির বিরল। কিন্তু হেফাজতের নেতারা কি বুঝতে পারছে যে পথে তারা নেমেছে সে পথের শেষ কোথায়? তারা যা চায় তা কি আর কারো পূরণ করার সাধ্য আছে? তাদের দাবী পূরণ হয়েছে দেখতে চাইলে, তারা যে সমাজ ও পরিবেশ পেতে চায় তা পেতে হলে তাদেরকেই কাঁধে নিতে হবে দেশের ও সমাজের দায়িত্ব। তারা কি সেজন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত? তবে দেশের অধিকাংশ মানুষই তাদের গ্রহণ করে নিতে আজ প্রস্তুত বলেই মনে হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন