স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ও কওমী হুজুররা অর্থাৎ এখনকার হেফাজতে ইসলামের মত মৌলবাদী গোষ্ঠি সমূহ নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল, যা কারো অজানা নয় । স্বাধীনতার ৪২ বৎসর পর আবার ঐ মৌলবাদী গোষ্ঠি সমূহ স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে । এর জন্য ৪২ বৎসর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শাসকগোষ্ঠি কমবেশী দায়ী । সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ঢাকার নির্বাচিত জনপ্রিয় সাবেক মেয়র, বিএনপি ঢাকা মহানগরীর আহব্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান জনাব সাদেক হোসেন খোকা যে বক্তৃতা রেখেছেন টিভি ও পত্রিকায় কমবেশী সবাই দেখেছেন । সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা বলেন, ‘ফটিকছড়ির সংগ্রামী বন্ধুদের সংগ্রামী সালাম জানাই । তাঁরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, আগামী দিনে এই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ইতিহাসে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ।’ তিনি বলেন, প্রত্যেক গ্রাম, উপজেলাকে ‘ফটিকছড়ির মতো সাহসী’ হতে হবে । তিনি আরো বলেছেন-যেখানে ওদের পাবেন সেখানেই ওদের ধ্বংস করে দিতে হবে, ওদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমন চালাতে হবে ।
সংবাদপত্র ও টিভি ফুটেজের বদৌলতে সারাদেশবাসী দেখেছে কিভাবে রাস্তায় ব্যরিকেড দিয়ে গাড়ী বহরের গতিরোধ করে মসজিদের মাইকে ইমাম হত্যা, মাদ্রাসায় ভাংচুর ও হুজুরদের মারধরের মত মিথ্যা তথ্য দিয়ে যার যা আছে তা নিয়ে ইমাম, মসজিদ ও মাদ্রাসা রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানানোর বিষয়টা । এরপর যা ঘটেছে তা ছিল বর্বর ও লোমহর্ষক । জামাত শিবির ও হেফাজত কর্মীরা নিরস্ত্র মিছিলের গাড়ী বহর পুঁড়িয়ে দেয় এবং দুই জনকে রাস্তার ওপরে সাপ মারার মত কুপিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরেছে আর দুই জনকে স্কুল কক্ষে আত্মরক্ষায় লুকানো অবস্থায় ধরে আল্লাহ আকবর স্লোগান দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মারল, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সম্মিলিত ভাবে কোপানোর দৃশ্যটি ভয়ংকর ও বিভৎস্য । এই ধরনের হত্যাকান্ড কোন সুস্থ্য বিবেক সম্পন্ন মানুষ সমর্থন করতে পারে না ।
ফটিকছড়িতে জামাত-শিবির ও হেফাজতে ইসলামের দ্বারা সংঘটিত এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডটিতে বিএনপি নেতা কর্মিদের উপস্থিতি ছিল না, যা টিভি ফুটেজ ও সংবাদ পত্রের স্থির চিত্রে স্পষ্ট । কিন্তু ঐ বর্বর, পৈশাচিক ও লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের হোতাদের বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা সংগ্রামী সালাম জানিয়েছেন এবং নিজ কর্মীদের সাহসী হয়ে ঐ ধরনের সর্বাত্মক আক্রমনের আহ্বান জানিয়েছেন । সাদেক হোসেন খোকার বক্তব্যে খোকাকে চিনেন, জানেন এই ধরনের মানুষরা অবাক ও বিস্মিত হয়েছেন । হত্যা, খুন রাহাজানি কখনই রাজনীতিতে সমর্থনযোগ্য বিষয় হতে পারে না, অনুকরণ ও অনুসরণের প্রশ্নই ওঠে না । তাই সচেতন মহলে আলোচনার ঝড় ওঠেছে, যে ঘটনাকে সুস্থ্য বিবেকের নাগরিকরা ঘৃণা জানাচ্ছেন, সেই হত্যাকান্ডকে দায়িত্বশীল বর্ষিয়ান নেতা হিসেবে খোকা কিভাবে নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে কর্মীদের অনুপ্রাণিত হতে বলেন । প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম খোকা ভাই হয়ত উত্তেজনা বশতঃ বক্তব্যটি দিয়েছেন কিন্তু যখন দেখলাম বিএনপি অন্য সিনিয়র নেতা, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.খন্দকার মোশারফ হোসেন, স্থায়ী কমিটি সদস্য এমকে আনোয়ার, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া সহ মধ্যম সারির নেতারাও সাদেক হোসেন খোকার বক্তব্যকে সাপোর্ট করে প্রায় অনুরূপ বক্তব্য রাখছেন । আতংক ও শংকার বিষয় হচ্ছে, বিএনপি একটা গণভিত্তি সম্পন্ন গণতান্ত্রিক দল হিসেবে কিভাবে মৌলবাদীদের ঘৃণ্য হত্যাকান্ডকে সমর্থন করেন তাও আবার জামাত-শিবির ও হেফাজতের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকান্ডকে ।
মৌলবাদীদের ঘৃণ্য এই হত্যাকান্ড সম্পর্কে বিএনপির অবস্থানকে মাথায় রেখে খানিকটা অতীতে গেলে দেখতে পাবেন, জামাত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রায়ের পূর্বদিন মতিঝিল শাপলা চত্বরের সমাবেশে জামাত-শিবির আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছিল এবং শুধু গৃহযুদ্ধের হুমকিই নয় তদপরবর্তি থেকে অদ্যবধি গৃহযুদ্ধের মত ঘটনা অনবরত ঘটিয়ে যাচ্ছে । তাই অতীতের আন্দোলন সংগ্রামের সাথে এখনকার আন্দোলন সংগ্রামের মিলের চাইতে অমিলটাই বেশী ।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানীদের কাবু করতে রাস্তা ঘাট ওপরে ফেলা, পুলিশের ওপর আক্রমন, রেললাইন, ব্রীজ কালভার্ট উপড়ে ফেলা সহ সর্বাত্মক আক্রমন করেছিল । দেখুন, জামাত শিবির গৃহযুদ্ধের হুমকিই শুধু নয় হুমকি বাস্তবায়নের চেষ্টাও করে চলছে অবিরত । জামাত শিবির রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার নিমিত্তে হরতালের নামে পুলিশকে টার্গেট করে পুলিশ মারা, অস্ত্র কেড়ে নেয়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা, সড়ক যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয়া, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দির মঠে ভাংচুর করা, থানা সদরের অফিস আদালত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া, সবই করছে । এতেও আতংক অনুভব করিনি ।
ফটিকছড়ির হত্যাকান্ডের পর বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা সহ অন্য নেতারা যখন আন্দোলনের নামে সর্বাত্মক ধ্বংসাত্মক আক্রমন এবং হত্যাকান্ডকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে বক্তব্য রাখেন, তখন অবশ্যই সমাজে দুশ্চিন্তা ও আতংক ছড়ায় এবং মৌলবাদী রাজনীতির উত্থানকে নিশ্চিত করে । ফটিকছড়ির ঘটনায় বিরোধী দলের উস্কানী এবং সরকারের নমণীয়তায় সাহসী হয়ে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধ ও শাপলা চত্বরে সমাবেশের নামে সহিংসতা প্রদর্শন করে, শাপলা চত্বরের আশে পাশে মধ্য রাত পর্যন্ত ভাংচুর এবং আগুনে পুঁড়িয়ে ধ্বংস করে সরকারী বেসরকারী সম্পদ, রক্ষা পায়নি ফুটপাতের দোকান এবং কোরআনসহ অন্যান্য বই পত্রের দোকান । হেফাজতে ইসলামকে শাপলা চত্বর থেকে মুক্ত করতে প্রচুর জানমালের ক্ষতি হয় । বিএনপি কি না বুঝে জামাত শিবির ও হেফাজতে ইসলামের ফাঁদে পা দিয়ে মৌলবাদের উত্থানে ভূমিকা রাখছে, নাকি বুঝে-সুঝেই করছে । যেভাবে যে কারণেই করুক না কেন, জাতিকে ভবিষ্যতে অনেক বেশী মাশুল গুনতে হবে ।
এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে আস্তিক নাস্তিক দ্বন্দ্বে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা, আহলে সুন্নতের ১২ দফা ও ইসলামিক ফ্রন্টের ২১ দফা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন রেখা তৈরী করছে । প্রধান দল দুইটি নিজেদের মধ্যে নূন্যতম গণতান্ত্রিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা না করে পরষ্পর পরস্পরকে ঠেকানোর জন্য সংখ্যাগুরুদের ধর্মীয় দল গুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করছে । এতে মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করছে । এই কদিনের চর্চায় দেশবাসী দেখেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, মন্দির, মঠ সহ দোকানপাটে ভাংচুর লুটপাট ও জ্বালিয়ে পুঁড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে । এতে রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে । পাকিস্তান আফগানিস্তানের প্রতিদিনকার খবর জুড়ে থাকে লাশের মিছিল । এ লাশের মিছিল দেখেও আমরা যদি সতর্ক না হই, আমাদের দেশে অল্পতেই ছড়াবে কারণ বৌদ্ধ মৌলবাদ আছে মায়ানমারে, হিন্দু মৌলবাদ আছে ভারতে, মুসলিম মৌলবাদ আছে পাকিস্তান আফগানিস্তানে ।
সম্প্রীতি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারে ভারতের বিজেপি সহ আরো কিছু সাম্প্রদায়িক দল আমাদের বর্ডার পর্যন্ত মিছিল নিয়ে এসেছে, রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার আগে-পরে মায়ানমারেও মুসলমান আক্রান্ত হয়েছে । ধর্মের পবিত্র বিশ্বাসে আঘাত যত দূরে বা কাছেই ঘটুক না, তা ঐ ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে বিদ্যুৎ গতিতে সংক্রমিত হয়, আর ঐ রাষ্ট্রে যদি ধর্মীয় মৌলবাদের অনুকূলে রাজনীতির চর্চা থাকে তাহলে নিমিষেই ম্যাসাকার সংঘটিত হবে ।
কাল্পনিক অর্থে বলছি, আমরা বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচারের ক্ষেত্র রাখলাম, এতে মায়ানমারের বৌদ্ধ মৌলবাদ কি বসে থাকবে, ঠিক তেমনি হিন্দুদের ওপর অত্যাচারে ভারতের হিন্দু মৌলবাদ কি বসে থাকবে, নিশ্চয় কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মালম্বীর দেশই নীরব ভূমিকায় থাকবেনা । আমাদের দূর্বল অর্থনীতির দেশটিতে একবার যদি রাজনৈতিক মৌলবাদ ছড়িয়ে পড়ে বা প্রতিষ্ঠা পায়, তা সামাল দেয়া দূরুহ, দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে । কথায় বলে গরীবের বউ সবার ভাবী । আমরা যদি এখনকার অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না করি, ধর্মীয় উন্মাদনায় বাতাস দেই তাহলে সেই আগুনে আমরা ও ভবিষ্যত প্রজন্ম অবধারিত ভাবে জ্বলবে । অনাকাংখিত সাম্প্রদায়িক আগুনে জ্বালিয়ে পুঁড়িয়ে ছারখার করবে আমাদের অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মকে ।
রাজনৈতিক সংকটের এই মুহূর্তে দেশের সকল বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের ভূমিকা অপরিহার্য । দেশের ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক চর্চা, উন্নয়ন অগ্রগতির সম্ভাবনা ও বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে প্রধান দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্কোন্নয়ন না ঘটালে ক্রমান্বয়ে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটবে । যা রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্রকে ধ্বংস করবে । তাই নাগরিকদের ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাসকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে । অর্থাৎ ধর্ম হবে যার যার রাষ্ট্র হবে সবার, এই নীতিতে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করতে হবে ।
লেখকঃ প্রবাসী, জাপান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন