স্বজনহারাদের গগনবিদারী আহাজারী আর্তনাদে ভারী হয়ে আছে রানা প্লাজার ধ্বংস স্তূপের এলাকা জুড়ে । লাশের সন্ধানে স্বজনহারা মানুষরা ছুটছে এদিক ওদিক, স্বজন সনাক্তে মর্গের লাশের সারি তন্ন তন্ন করে খুঁজছে আর বিলাপ করছে । এ কেমন নির্মমতা, শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারেনি রাষ্ট্র, লাশটাও কি খুঁজে দিতে পারবেনা স্বজনদের । এ কোন সভ্য রাষ্ট্র তৈরী করছি আমরা, সুন্দরবনের বাঘের থাবা থেকে না হয় সরকার লাশ ফেরত আনতে ব্যর্থ হতে পারে । কিন্তু নিরীহ শ্রমিকের মৃত দেহের সংখ্যার ক্ষেত্রে গার্মেন্টস মালিকদের ব্যবসা ও ইজ্জত বাঁচাতে, সরকার কি হিংস্র বাঘের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন । রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব কি পন্য ও পুঁজির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছে । আর কতদিন শ্রমিক শ্রেনীর জীবন রাষ্ট্র ও পুঁজিপতিদের খামখেয়ালীর মাশুল গুনতে গিয়ে নষ্ট হবে ।
আধুনিক সভ্য পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রের নাগরিকরা লাশ চেয়ে মিছিল করতে হয়েছে কিনা জানিনা, বেসরকারী টিভির বদৌলতে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে লাশ চাই, লাশ চাই; দিতে হবে, দিয়ে দাও; ক্ষুব্ধ স্বজনদের পীড়াদায়ক এই স্লোগান শুনতে হয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে । একদিকে স্বজনরা সাভারের রানা প্লাজা থেকে হাসপাতাল, আবার হাসপাতাল থেকে মর্গে যেমনি হন্য হন্য হয়ে স্বজন খুঁজছেন, অন্যদিকে উদ্ধারকর্মীরাও ধ্বংসস্তূপের মাঝে সন্ধান করছেন হতভাগা শ্রমিকদের ।
উদ্ধারকর্মীরা পঞ্চম দিনে লাশের মিছিলে প্রাণের সন্ধান পায় । এতে সবার মাঝে অন্যরকম এক আবেগ অনুভূতি জন্ম নেয়, নিমিষেই উদ্ধারকর্মীরা মনের মাঝে পণ বাঁধেন পোষাক কর্মীটিকে জীবন্ত উদ্ধারে, এই বাঁচার সৌভাগ্যের হাতছানি দেয়া নারী পোষাক শ্রমিকটির নাম সাহানা । সাহানা বাঁচবে, এই প্রত্যাশায় ঘন্টার পর ঘন্টা উদ্ধারকর্মী ও দূর্বল ক্লান্ত সাহানা মিলে যুদ্ধ করেন ইট, রড, সিমেন্টের সভ্যতার সাথে । এই খবরে উপস্থিত মিডিয়াকর্মীদের একজন জীবনবাজী রেখে সুরঙ্গ পথে নেমে পড়েন, সাহানার সাথে কথা বলেন, সাহানার কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশের উৎকন্ঠিত উদ্বিগ্ন মানুষের মাঝে । শত শত লাশের মাঝে সাহানার আঁকুতি ছুঁয়ে যায় সবার হৃদয়, সাহানা আর্তনাদ করে বলছিল, তার দুধের শিশুটি না খেয়ে আছে, এইত বাংলার চিরায়ত মহিয়সী মা সাহানা, সাহানা তার শিশুটিকে দুধ খাওয়ানোর চিন্তায় উৎকন্ঠিত । তাই উদ্ধারকর্মীদের বারবার অনুরোধ করছিলেন, তার সন্তানটিকে নিয়ে আসতে, শিশুটি দুধের ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে, ওকে দুধ খাইয়ে দিয়ে দিবেন, উদ্ধারকর্মীরা অনবরত সাহানাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল এই আর একটু আপনি বেরিয়ে বাসায় গিয়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারবেন । উদ্ধারকর্মীদের প্রাণান্ত চেষ্টার এক পর্যায়ে হঠাৎ আগুন ধরে যায়, লেলিহান আগুন ও ধোঁয়ার কুন্ডলী কেঁড়ে নেয় সব । সাহানা চলে যায় না ফেরার দেশে, শিশুকে দুধ খাওয়ানো হল না সাহানার, নিজেও যুক্ত হলেন শত শত মৃত সহকর্মীর সারিতে । উদ্ধারকর্মীদের একজন সাহানাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই অর্ধ দগ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালে শর্য্যাশায়ী । সাহানার খবরে উদ্ধারকর্মীসহ উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি । উদ্ধারকর্মীদের একজন স্বজন হারানোদের মত স্বশব্দে হাউমাউ করে কান্না করছিলেন । কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, কেন কাছাকাছি গিয়েও অল্পের জন্য সব শেষ হয়ে গেল । কেন বাঁচাতে পারলেন না সাহানাকে ।
ধ্বংস যজ্ঞের দশম দিন আজ, দশম দিনে জীবিতের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে । এখন উদ্ধারকৃত লাশ গুলো পচে গলে একাকার হয়ে গেছে, দুঃর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারিদিকে, দেহ থেকে মাথা আলাদা, বিচ্ছিন্ন হাত পায়ের গলিত লাশ গুলো সনাক্ত ও উদ্ধার কর্ম দূরূহ হয়ে পড়েছে, চিনার উপায় হিসেবে পোষাক, জুতা ও মোবাইল এসবই এখন শেষ সম্বল ।
অন্যদিকে দুই পা, এক হাত, এক পা, দুই হাত কাটা, স্থায়ী পঙ্গুত্ব, অকেজো, কর্ম ক্ষমতা হারানো শিউলী, ঝর্না,মরিয়ম, রোজিনা, লতিফ, উজ্জ্বল, রফিকুল, শাপলারা হাসপাতালের বেডে ব্যথ্যা বেদনা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় নির্বাক । ওদের অসহায় চাহনি গুলো নির্ভরতা খুঁজতে চায় সরকার, দেশ ও বিজিএমইর মালিকদের নিকট । ভেবে উত্তর পাই না, ওদের বাকী জীবনটা কিভাবে কাটবে । নাকি অন্ধকার ও অভিশপ্ত নরক যন্ত্রণা নিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে বাকী জীবনটা । সরকার, মালিক ও বিভিন্ন সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানের যৎসামান্য প্রতিশ্রুতি গুলো শেষ পর্যন্ত অসহায় মানুষ গুলোর কাছে পৌঁছবে কি ? পৌঁছলেও এতে বাকী জীবনটা চলবে কি ?
এবারকার মে দিবসের মিছিলে ওরা যেতে পারেনি, হাসপাতালের বেডে শুয়ে মে দিবসের স্লোগান শুনতে হয়েছে, দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই কর; এক হও লড়াই কর, দুনিয়ার মজদুর । পঙ্গু শ্রমিকরা আর অধিকার আদায়ের মিছিলে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলতে পারবেনা । অধিকার আদায়ের স্বপ্ন নিয়ে মে আসে মে যায়, বাংলার শ্রমিকরা কতটুকু পায়- শ্রমের মর্যাদা, কর্মস্থলে নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা, কর্মোপযোগী পরিবেশ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা । বাংলাদেশের গার্মেন্টস্ বিশ্ব বাজারে প্রথম স্থান অর্জন করলেও এই পেশার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে দিচ্ছে না মালিক ও মালিক পক্ষের রাষ্ট্রযন্ত্র । তাই পন্যের মূল্য ও পুজির মূল্য থাকলেও শ্রমিকের জীবনের মূল্য নাই । এই কয়েক বছরে স্পাকট্রাম, সাকিরা, তাজরীন ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে একের পর এক লাশের মিছিল চলছে, এই সেইদিন তাজরীনে ১১২ জন জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যু বরন করলেও মালিক বাহাদুরের কেশাগ্রও ষ্পর্শ করেনি রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাই এই কদিনের ব্যবধানে রানা প্লাজায় আরো ব্যাপক লাশের মিছিল । মানুষ-মানবতা ও শিল্পের ভাবমূর্তি বাঁচাতে আর দেরী নয়, শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা দিতে হবে, শ্রম ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং আইন অমান্যকারী মালিকের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে । এতেই লাশের মিছিল কমতে পারে, থামতে পারে ।
লেখকঃ প্রবাসী, জাপান ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন