ব্লগিং এখন আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে বেশ তীব্রভাবেই নাড়া দিয়েছে, দিচ্ছে এবং দেবে। ব্লগাররা নিজস্ব ব্লগে, কিংবা বিভিন্ন সামাজিক ব্লগে মডারেটরের নিয়ন্ত্রণে অথবা নিজস্ব বিবেচনায় নানা বিষয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। নির্দিষ্ট ব্লগে লেখা ছাড়াও ফেসবুক, টুইটারের মতো মাইক্রো ব্লগেও এখন এন্তার লেখা চলছে। তাতে লাইক, ডিজলাইক, কমেন্ট, পাল্টা কমেন্ট পড়ছে। ডিজিটাল স্ক্রিনের সীমিত চৌহদ্দি পেরিয়ে এই ব্লগভাব যে বাংলাদেশের রাজনীতি আর রাষ্ট্রকে বিপুলভাবে নাড়া দেবে, সহিংসতা, প্রাণঘাত আর রাজনৈতিক বিভাজনের সৃষ্টি করবে, তার কি পূর্ব ধারণা আমাদের ছিল? যে স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গিতে, মুক্তমনে, স্বেচ্ছা দায়িত্বে ব্লগে, ফেসবুকে আমরা যেমন ইচ্ছে তেমন লিখতে চাইÑ তার জন্য কি এই সমাজ তৈরি হয়েছে? রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কি এই নয়াস্ক্রিন জমানার জন্য তৈরি?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রবণতার গতিপ্রকৃতি খুব সংযুক্ত।
২.
এই সংযুক্তি বিশ্লেষণ করার আগে আমরা কিছু কিছু ঘটনার নমুনা নিতে পারি।
এক, রামুর সহিংসতা। ফেসবুক কেন্দ্রিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ব্যাপক সহিংসতা। ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করা। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক বলয়ের সম্মিলিত সহযোগে এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটানো। শেষমেশ প্রকৃত অপরাধীদের বিচার না হওয়া। পুরো ঘটনাকে রাজনৈতিক লাভালাভের চোখ দিয়ে দেখা।
দুই, ব্লগাররা ব্লগে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করছে, এই দাবিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করা। ব্লগার রাজীবের হত্যা। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা সৃষ্টি। রাজনৈতিক উত্তেজনা। সহিংসতা।
তিন, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। ব্লগের লেখা প্রচার করেছে। ইত্যাদি নানাবিধ অভিযোগে এই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক গ্রেপ্তার, ১৩ দিনের রিমান্ডে। পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ।
৩.
১০ এপ্রিল ২০১৩ বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি স্থানীয় বিদেশি দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতদের সামনে এক ডিপ্লোম্যাটিক ব্রিফিং দেন। এই ব্রিফিংয়ে তিনি দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ, জাগরণ মঞ্চের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের সংঘর্ষ, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি, ফেসবুক-ব্লগে ধর্ম অবমাননা, ব্লগারদের গ্রেপ্তার, বিভিন্ন সংবাদপত্রে ধর্মবিদ্বেষী প্রচারণা, দেশব্যাপী পুলিশের হাতে মানুষ নিহতের ঘটনা, আস্তিক-নাস্তিক লড়াই, বিবিধ বিষয়ে সরকারের কর্ম, দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করেন। অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ যে সাংঘর্ষিক এবং লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এক দুর্বিষহ সময় পার করছে তা স্বীকার করে ডা. দীপু মনি তার লিখিত সুদীর্ঘ ব্রিফিং শেষ করেন এই বলে-
Excellencies, friends,
The next general elections will be a critical threshold for Bangladesh's journey onwards. It is often said that the nation is divided along some ideological fault lines that remain difficult to bridge. While there may be some truth in it, I believe that the nation is now faced with two clear options ahead of it: one is the build on the conclusions that we had reached as a nation at our birth in 1971 and forge ahead on the course of progress and prosperity that is our destiny, and the other is to dig deeper the battle lines around the fundamental questions of our statehood and plunge the nation into a state of chaos and polarization for narrow political gains. If we choose the latter, I do not think history will forgive us ever. Let our people decide which option they prefer.
[এক্সিলেনসিস, বন্ধুগণ,
বাংলাদেশের সামনের দিনের অগ্রযাত্রায় পরবর্তী সংসদ নির্বাচন খুবই জটিল একটি অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জাতি কিছু আদর্শিক ত্রুটিময় লাইনে বিভক্ত। এই বিভক্তির সমাপ্তি টানা খুবই কঠিন। এটাও সত্য, কিছু প্রশ্নে জাতি দুটি পরিষ্কার অপশনের মুখে পড়েছে। এক, ১৯৭১-এর চেতনায় সামনে এগুনো; দুই, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে বিভক্তি রেখা টেনে জাতিকে সংঘর্ষের মুখে ঠেলে দেয়া। যদি আমরা দ্বিতীয় পথটিকে বেছে নেই, আমি মনে করি না ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে। এখন জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন পথে তারা হাঁটবেন।]
৪.
একটা স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে কেন এমন কথা বলছেন? কেন তিনি বলছেন, Let our people decide which option they prefer।
তাহলে, জনগণের এই ‘অপশন’ বাছার পথটা কী? নির্বাচন, না, রাস্তার সহিংসতা?
নির্বাচন হলে, কোন্ উপায়ে নির্বাচন? সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন, নাকি একদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন! দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে, তার প্রতিক্রিয়াই বা কী হবে? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষা ধার করে বলি, The next general election will be a critical threshold for Bangladesh's journey on words.
তাহলে, দেশ এরকম ক্রিটিক্যাল থ্রেশহোল্ড লেভেলে (জটিল চূড়ান্তসীমায়) পৌঁছল কেন? সরকার তাহলে কী করল? সংঘাত আর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মুখে পড়লই বা কেন দেশ? কেন, রাজনৈতিকভাবে সরকার এই সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হলো? এবং সেই ব্যর্থতাকে সকল দ্বিধা-লাজ ছেড়ে বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে বলতে হলো?
এই অনেক প্রশ্নের কারণ খোঁজার আগে আরও কিছু প্রতিক্রিয়ার রেশ দেখা যেতে পারে।
৫.
দেশে এন্তার হরতাল হচ্ছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, এই হরতালের মুখ্য কারণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নয়। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, ‘১৯৭৫-১৯৯০ সময়ে দেশে যে হরতাল হয়েছে তার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক ইস্যু ছিল ৯৩%, অর্থনৈতিক ইস্যু ছিল ৭%। ১৯৯১-২০০০ সময়ে সংঘটিত হরতালের কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক ইস্যু ছিল ৪ শতাংশ, রাজনৈতিক কারণ ছিল ৯৬ শতাংশ। কথিত গণতান্ত্রিক ডিজিটাল জমানায় ২০০০-২০১৩ সময়ে তার হেরফের ঘটেনি। এই এক যুগে হরতাল হবার মূল কারণ রাজনৈতিক (৯৪%), গৌন কারণ অর্থনৈতিক (৬%)।
অর্থাৎ আমরা ক্রমশ যে হরতাল সংস্কৃতির দিকে যাচ্ছি তার মৌলিক কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক। সরকার ও বিরোধী দলের ক্ষমতার মসনদ দখলের লড়াই, সুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার অভাব হরতালকে উস্কে দিচ্ছে। দুর্নীতিপরায়ণ ও দলদাস প্রশাসনের কারণে ভেঙেপড়া প্রাতিষ্ঠানিকতা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এতটাই ঠুনকো করেছে যে, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন কিভাবে হবে কিংবা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কী হবে না তার সমাধান করতেই রাজনীতি ‘হরতাল’ নির্ভর হয়ে পড়েছে।
সিপিডির তথ্যমতে, হরতালের প্রকৃতি, চেহারাও বদলাচ্ছে। ছুটির দিনেও এখন হরতাল হচ্ছে। এমনকি শুক্রবারও হরতাল দিতে দ্বিধা করছে না হরতালকারীরা। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ ঠেকাতে সরকারি স্পনসরেও নজিরবিহীন হরতাল হচ্ছে। হরতাল এখন কেন্দ্রীভূত নয়, তার বিকেন্দ্রীকরণও ঘটেছে। জেলা, উপজেলা পর্যায়েও হরদম হরতাল হচ্ছে। হরতালের ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। ২০১৩ সালে কাক্সিক্ষত জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ধরা হলেও বলা হচ্ছে তা দাঁড়াবে ৫.৮ শতাংশে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের হিসাবে এখন প্রতিদিনের হরতালে ন্যূনতম ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৬০০-২০০০ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ০.২ শতাংশ।
রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে হরতাল হচ্ছে আবার হরতাল থেকেও রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর হিসাবমতে ১-৩১ মার্চ ২০১৩ সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেই মানুষ মরেছে ১৪২ জন।
৬.
এখন এরকম ব্যাপকতর রাজনৈতিক অস্থিরতার মূলে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে কী? এরকম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কি বাংলাদেশ দেখেনি?Ñ হ্যাঁ, দেখেছে। তবে, এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটি নতুন বিষয়। এক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার; দুই, ব্লগিং ও মাইক্রো ব্লগিংয়ে মানুষের মুক্তমত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যে রাজনৈতিক লড়াই, আপসকামিতা তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে ডিজিটাল দুনিয়া। বিশেষত ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়ার মতামতকারীরা। পারস্পরিক তথ্যপ্রবাহ, পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ক্রমশ ঘরের কোণে স্ক্রিনের সামনে পড়ে থাকা মানুষের স্বাধীন মতামত প্রকাশের যে সুযোগ দিয়েছে, প্রতিবাদের ভাষা জানানোর যে পথ খুলেছে, তারই হাত ধরে তৈরি হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের আপসকামিতার বিরুদ্ধে গণজাগরণে সমবেত হয়ে এক ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন করেছে। মাইক্রো ব্লগিংয়ের এই ধারা ক্রমশ প্রচলিত রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আবার প্রচলিত রাজনীতি ঘরের কোণে পড়ে থাকা ক্ষুব্ধ মানুষের রাস্তার প্রতিবাদকে ধর্ম দিয়ে, আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে জড়িয়ে হামলা করেছে। যারা রাজনীতির কুটিল তত্ত্বে কোনোদিন চোখ রাখে নাই, তারা এই হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে নতুন ক্রোধে ডিজিটাল স্ক্রিনে আরও প্রতিবাদ হেনেছে, মুক্তমনে। প্রচলিত রাজনীতি সেই মুক্ত প্রতিবাদকে আরও হিংস্রভাবে আক্রমণ করেছে ‘ধর্ম’ আর ‘সাম্প্রদায়িকতার’ পুরনো অস্ত্রে। অনভিজ্ঞ একদল আবেগী মানুষ, সততা আর বিশ্বাসে যে যুদ্ধে নিজেকে ঠেলে দিয়েছিল মুক্তমনে তারা একদিন আবিষ্কার করল তাদের বিপক্ষেও দাঁড়িয়ে গেছে একদল মানুষ রাজনীতিরই নামে। তাদের পেছনে যারা কলকাঠি নেড়েছে, তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যারা প্রতিপক্ষ সেজেছে দু’দলই রাজনীতির ক্ষুদ্র লাভ খুঁজেছে কেবল। এই রাজনীতির হাত ধরে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে। রাজধানীর কিংবা জেলা শহরের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত তরুণদের ডিজিটাল দুনিয়ার বাইরে যে বিপুল জনগোষ্ঠী আছে, তাদের তারুণ্য আর রাজনীতি যে ঝলসে উঠেছে, সংখ্যাধিক্যে আর রাজনৈতিক অস্ত্রে তারাও যে কম যায় না, তার প্রমাণ মিলেছে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে। কাজেই, পুরো দেশ এখন দুই শিবিরে বিভক্ত এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাবে পরস্পরের মুখোমুখি।
৭.
আস্তিক, নাস্তিক বিতর্ক বাড়ছে। ধর্ম ক্রমশ সামনে চলে আসছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী মদিনা সনদে দেশ চালানোর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের নিকেশে ক্রমশ ধর্মমুখী হচ্ছে। মুক্তমনা ব্লগগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে। কে কি লিখছে, কেন লিখছে, এ লেখা কার বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রয়োজনমাফিক শাস্তির দাবি উঠছে। পক্ষ-বিপক্ষ শিবির প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা সরকারি চাপে বন্ধ হতে চলেছে। এখন দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হাসানত আবদুল হাইয়ের লেখা গল্প নিয়েও আপত্তি ও বিতর্কের ঝড় উঠেছে ব্লগে, ফেসবুকে। ব্লগারদের তালিকা সরকারের বিশেষ সংস্থার হাতে যাচ্ছে। বেশ ক’জন ব্লগার গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে আছে।
লেখকের স্বাধীনতা, ফ্রিডম অব স্পিচ নিয়ে প্রগতিবাদের ঝাণ্ডা তোলা অনেকেই এ বিতর্কে অংশ নিচ্ছে। সব মিলিয়েই ব্লগ আর ব্লগিং ও সামাজিক নেটওয়ার্ক আমাদের রাজনীতি ও সমাজকে এক দারুণতর চাপের মুখে ফেলেছে।
৮.
ব্লগে অনেক সৃজনশীল, সৃষ্টিধর্মী, বিজ্ঞানময়, যুক্তিসঙ্গত, জ্ঞানমুখী লেখাও প্রকাশিত হয়ে থাকে। ব্লগ বা মাইক্রো ব্লগের এসব লেখা মানসজগৎকে উন্নত করে। আমাদের চেতনা ও বোধকে উজ্জীবিত করে। সমাজের অগ্রগতির ধারাকে ত্বরান্বিত করে। জ্ঞানচর্চা ও সামাজিক অগ্রগতির এই সাধারণ ধারার বিপরীতে সামান্যসংখ্যক মানুষের নেতিবাচক ধর্মবিদ্বেষী কিংবা প্রতিহিংসামূলক লেখাকে ভিত্তি করে সমগ্র ব্লগিং কমিউনিটিকে নাস্তিক বলা, নষ্ট বলা আমাদের দৈন্যতারই বহিঃপ্রকাশ। এটি আমাদের মূলধারার রাজনীতি বিশেষত ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির একটি কূটকৌশলও বটে। গত ক’মাসে ফেসবুক, টুইটার বা ব্লগে যে লেখালেখি বা মতামত প্রকাশিত হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা তাদের ছাত্রসংগঠনের কোনো শক্তিমান অংশগ্রহণ নেই। কেননা এই অগ্রগামী জগতের সঙ্গে তারা পরিচিত নন। জ্ঞান, যুক্তি, তথ্য, ছবি প্রকাশ করে নিজের চেতনার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরার যোগ্যতা আমাদের মূলধারার রাজনীতি এখনও অর্জন করে নাই। ফলে পশ্চাদগামী চিন্তার মানুষ যা করে, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে নাস্তিক, ধর্মবিদ্বেষী অভিধা দিয়ে রীতিহীন যুদ্ধে তাদের পরাজিত করতে চায়।
এটি একটি যোগ্যতার প্রশ্নও বটে। গণজাগরণ মঞ্চের জনদাবির বিপরীতে ছাত্রদলের পক্ষে তো কোনো যৌক্তিক ব্লগিং চোখে পড়েনি। ছাত্রলীগের নেতিবাচক রাজনীতির বিপক্ষে তো সেই ছাত্রসংগঠনের পক্ষে কোনো যৌক্তিক লেখা দৃষ্টিগোচর হয়নি। বরং এদিক দিয়ে জামায়াত-শিবির তাদের পক্ষে সত্য-মিথ্যা নানান প্রচারণায় অংশ নিয়েছে এই ডিজিটাল স্ক্রিন জগতে।
মনে রাখতে হবে প্রযুক্তির এই অগ্রগতিকে জ্ঞানহীন মাস্তানি দিয়ে ঠেকানো যাবে না। আগামী নির্বাচনে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান প্রচারণা চলবে। নানা তথ্য, প্রকাশিত হবে। সকল দলের নানান অপকর্মের কথা, দলিল, অডিও, ভিডিও উপস্থাপিত হবে। আমাদের মুখ্য রাজনৈতিক দলগুলো তার মোকাবিলা করবেন কি ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে?
৯.
একজন নবাগত সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদে তার দেয়া প্রথম বক্তব্যে বলেছেন, আমাদের রাজনীতিকে আরও ইনোভেটিভ হতে হবে। পুরনো রাজনীতি দিয়ে নতুন দুনিয়া শাসন করা যাবে না। কেননা সারা দুনিয়ায় পরিবর্তন চলছে।
ব্লগে হেড অব স্টেটকে সমালোচনা করার দায়ে মিয়ানমারে ২০ বছর জেল দেয়া হয় ব্লগার নে ফেনে লাটকে (ঘধু চযড়হব খধঃঃ)। সেই হেড অব স্টেট জেনারেল থান শোয়ে এখন মুক্ত বার্মার পথে হাঁটছেন। মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক ধর্মকে অবমাননা ও মোবারককে হেয় করার দায়ে ব্লগার কারামন আমেরকে (কধৎধসববহ অসবৎ) তিন বছর জেল দেয়। সেই স্বৈরশাসন টিকেনি। এমনকি ২০১১ সালে মিসরের আরব অভ্যুত্থানের পরে ব্লগার মিকেল নাবিল (গধরশবষ ঘধনরষ) নিজস্ব ব্লগে লিখে সামরিক শাসনকে হেয় করার দায়ে তিন বছরের জেলে দণ্ডিত হন। এসব ইতিহাস প্রমাণ করেছে শাস্তি বা দণ্ড দিয়ে মুক্ত জগৎকে রুদ্ধ করা যায় না। বরং যে তারুণ্য নতুন কথা শোনাতে চায়, সৃজনশীল রাজনীতির পথে হাঁটার দাবি তোলে, প্রচলিত রাজনীতিকে তার কথা শুনতে হবে। কেননা, রুদ্ধ করার অন্ধ নীতি প্রলয় ঠেকানো বন্ধ করে না। আবার, যারা ব্লগে লিখেই সমাজ পরিবর্তনের কাজ করছেন বলে ভাবছেন, তাদেরও সমাজটাকে বুঝতে হবে। সমাজের অধিকাংশ মানুষকে নিজের পাশে পেতে গেলে তাদের হয়ে উঠতে হবে। অথবা তাদেরকে শিক্ষা, সুবিধা, আলোক দিয়ে দীপ্ত করে তুলতে হবে। প্রতিহত, নির্মূল, বিনাশ ভাষা ব্যবহারে বিপ্লব হয় না। বরং তা সমাজে সহিংসতা ছড়ায়। ফলে রাষ্ট্রের ন্যায্যতার মানদণ্ড ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্র তার ন্যায্যতার মানদণ্ড ভাঙলে ব্লগ, প্রশাসন, দলদাসকর্মী কিছু দিয়ে ক্ষমতা ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সেই অন্যায্যতায় আমজনতার রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ভেঙে পড়ে। সবকিছু ভেঙে পড়লে সেই ভূমিকম্প কাউকেই আর নিরাপত্তা দেয় না। রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে জনকল্যাণ সাধিত হয় না।
(সুত্র, সাপ্তাহিক, ২০/০৪/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন