সাপ্তাহিকী
|
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
|
|
কবি বলেছে যারা চুপ করে থাকে, কবি তাদের ঘৃণা করে
20 Apr, 2013
রমনা বটমুলে ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুনের কন্ঠে, শান্ত, ক্ষীণ লয়ে অথচ প্রাণ শক্তিতে ভরপুর ও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মত আবেগে ও শ্লেষের মিশ্রণে ধ্বনিত হল-কবি বলেছে যারা চুপ করে থাকে, কবি তাদের ঘৃণা করে । ক্ষীণ লয়ের সামান্য দুটি বাক্য আমাকে প্রচন্ড ভাবে ঝাঁকুনি দিল, এই কদিনের ক্রমাগত হুংকারের প্রেক্ষিতে আমার নীরব অবস্থানে । হুংকার প্রদানকারী সংঘবদ্ধ কওমী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকরা দাবি করলেন ১৩ দফার বাহিরে থাকলে কেউ ক্ষমতায় থাকতেও পারবেনা, আসতেও পারবেনা । ১৩ দফা পড়েছেন দেখেছেন এমন জনগোষ্ঠীর সবাই কমবেশী একমত দাবি গুলো যুদ্ধার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনা পরিপন্থী । হুজুরদের হুংকারে এতদিন নীরবে দগ্ধ হচ্ছিলাম, ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত দেশটি ৪২ বৎসরের ব্যবধানে কি স্বাধীনতার যৌক্তিকতা হারিয়েছে নাকি অন্য কোন ষড়যন্ত্র । শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের দাবিনামার পক্ষ বিপক্ষ একাত্তরেও ছিল এখনও আছে; এই সব হচ্ছে আমাদের সমাজের অন্তঃনিহিত বাস্তবতা । একাত্তরের মিমাংশিত সত্য কি আজ মিথ্যা প্রমাণের কথা বলছে, নাকি কেউ উস্কে দিয়ে ফায়েদা হাসিলের অংক কষছে । এই সব এলোমেলো ভাবনা, বুঝতে না পারা, ভিতরে সাহস অনুভব না করা, ভাড়াটে জনতার ভাবনা, তৌহিদী কাফেলা, অবহেলিত কওমী মাদ্রাসার গরীব শ্রেণী গোষ্ঠীর বঞ্চনার প্রতিবাদ, ধর্মীয় রাজনীতির বিভ্রান্তকর ব্যাখ্যায় ধর্ম প্রেমিকদের পবিত্র প্রতিবাদ, জামাত শিবির কর্তৃক টাকার খেলায় যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার কৌশল, বিএনপি কর্তৃক সরকার পতনের কৌশল; এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না জানিয়ে একাকী ভাবনায় ছিলাম নীরবে নিভৃত্যে ।
সনজীদা খাতুন উচ্চারিত পংতি দুটি আমার নীরবতা অর্থাৎ চুপ করে থাকার আত্ম পীড়নের দগ্ধতা উস্কে দিলেন শত সহস্র গুন শক্তিতে । আমার মধ্যে হাজারো প্রশ্নের ঢেউ তুলল, রবীন্দ্র নজরুল দেশাত্ম বোধক গানের মূর্ছনা আবৃতি ও উপস্থাপকের অন্যান্য বাণীকে মৃয়মান করে দিল । এ কেমন আত্মপীড়ন, অন্য সবকে ছাপিয়ে কবির ছোট্ট দুটি কথা আমাকে আমার মধ্যে থাকতে দিল না, উপভোগ করতে দিলনা রমনা বটমুলের বৈশাখী আয়োজনকে । নববর্ষ কেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে থেকে ধ্বনিত হচ্ছে- বৈশাখ বয়ে আনবে অমঙ্গলের বিরুদ্ধে মঙ্গল বার্তা, অশুভের বিরুদ্ধে শুভ সূচনা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রাণের শক্তি । গড়ে ওঠবে জরা-জীর্ণতা, গ্লাণি-দীনহীনতাকে দূর করার দৃপ্ত প্রত্যয় । এতসব প্রত্যয় অভিব্যক্তিকে ছাপিয়ে প্রতি মুহূর্তে হৃদয়ে অনুরণিত হচ্ছিল কবি বলেছে যারা চুপ করে থাকে, কবি তাদের ঘৃণা করে ।
নববর্ষের আনন্দে নিজেকে মানাতে না পেরে বিষাদ বিষণ্ণ মনে ভাবতে ভাবতে পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হবে ভেবে টিএসসি দিকে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম একসময়ের রাজনীতি করা বন্ধু সবুজরা কি করছে । বৈশাখের আনন্দে এই বিষাদ বিষণ্ণতার জন্য রাজনীতিই দায়ী । এর মাঝে কানে ভেসে আসল তেজোদীপ্ত জয় বাংলা স্লোগান, চোখে পড়ল বিশাল জনসমুদ্র, লোকে লোকারণ্য; বৈশাখী পোষাকে রাজনীতির স্লোগান; নারী পুরুষ ছোট বড় সবাই স্লোগানে মুখরিত । এই সেই আমি, যে ছাত্র জীবনে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতাম । আজ আমিই রাজনীতির স্লোগানে যৌক্তিকতা খুঁজে পেলাম, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের লক্ষ লক্ষ জনতার মাঝে আমিও স্বজোরে স্লোগান ধরলাম । কেমন জানি নিজেকে দায়িত্বশীল দায়িত্বশীল ভাবতে শুরু করলাম । সবার সাথে আমিও সরব হলাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হারিয়ে যেতে দেব না । মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, রাজাকারের ফাঁসি চাই; মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই; তুমি কে, আমি কে, বাঙ্গালী বাঙ্গালী; হেফাজতের ১৩ দফা, এ বাংলায় হবে না; এ বাংলায় হবে না, হেফাজতের ১৩ দফা ।
স্লোগানে স্লোগানে আমার মধ্যে ভর করা বিষণ্ণতা কেটে গেল । নিজেকে চুপ করে থাকাদের দল থেকে আলাদা করতে পেরে বৈশাখের আনন্দ অনুভব করলাম, তবে ভিন্ন বাস্তবতায়, ভিন্ন উপলব্দিতে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানে; উপভোগ করলাম এক ভিন্নতর আনন্দ, দায়িত্ব পালনের আনন্দ, দেশ ও দেশের চেতনা রক্ষার আনন্দ, পবিত্র দায়িত্ব পালনের আনন্দ; চুপ করে না থাকার আনন্দ, কবির ঘৃণা থেকে মুক্তির আনন্দ ।
লেখকঃ প্রবাসী, জাপান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন