সমগ্র বাংলাদেশ অবস্থিত ৬৮ টি কারাগারই নানান সমস্যায় জর্জরিত। সরকার কারাগার ও কারাবন্দীদের জীবন মান উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণে সর্বদায় কেন যেন উদাসীন। ব্রিটিশ আমলে তৈরী অধিকাংশ কারাগারের সেল ও ওয়ার্ডগুলো খুব ছোট ছোট,পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল এবং বাতাস চলাচলের অপর্যাপ্ততা লক্ষ করা যায়।
অধিকাংশ কারাগারে সারা বছর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশী বন্দীদের গাদাগাদি করে থাকতে হয়। তাছাড়া,নিম্নমানের খাবার সরবরাহ,পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার অভাব,অপরাধ প্রবণতা,বিভিন্ন ধরণের রোগ-জীবানো বিস্তার,সহবন্দীদের দ্বারা হয়রানি ইত্যাদি বিষয়গুলো বাংলাদেশের কারা ব্যবস্থাপনাকে ভঙ্গুর করে তুলেছে।
কারাগারগুলোতে নারী কারাবন্দীরা আরো বেশিমাত্রায় অসুবিধার সম্মূখীন হয়। নারী কারাবন্দীদের জন্য শুধুমাত্র পৃথক সেলের অপর্যাপ্ততায় নয়,পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থারও শোচনীয় অবস্থা লক্ষ করা যায়। তাছাড়া, নারী কারাবন্দীসহ মায়েদের সাথে অবস্থানরত শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সঠিক পরিমানে খাদ্য ও চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতাসহ শিশুদের জন্য বিশেষ কোন সুবিধাদি এসব কারাগারে একেবারেই নেই।
কারাবিধির ১২৯ ধারা কারাবন্দীদের ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দের কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তবে অতিরিক্ত কারাবন্দীর অবস্থান যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশিমপুর মহিলা কারাগারসহ সমগ্র দেশের কারাগারগুলোতে ১৮১৪ জন মহিলা কারাবন্দী অবস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ২২৩১ জন নারী কারাবন্দী অবস্থান করছে। যার মধ্যে ৬২১ জন সাজাপ্রাপ্ত এবং অবশিষ্ঠরা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে।
তাছাড়া,অধিকাংশ নারী কারাবন্দীদের সাথে রয়েছে তাদের শিশু সন্তান,যার সংখ্যা এ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত নয়। নারী কারাবন্দীদের সাথে অবস্থানরত শিশু সন্তানদের সংখ্যা যোগ করলে তা বর্তমান সংখ্যার চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কারাগারে নারী কারাবন্দীদের তাদের শিশু সন্তানের সাথে একত্রে গাদাগাদি করে ঘুমাতে হয়। অনেক সময় পালাক্রমে ঘুমাতে হয়। এমনকি কিছু কিছু সময় ঘুমানোর সুযোগও মেলে না। ফলে এমন অমানবিক বাসস্থানের পরিস্থিতি শুধুমাত্র নারী কারাবন্দীদের নয়,তাদের সাথে অবস্থানরত শিশু সন্তানের বেড়ে উঠার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কারাবিধি অনুযায়ী একজন কারাবন্দী প্রতিদিন ১৩৩.২৮ গ্রাম সবজি,৭২.৯০ গ্রাম মাছ বা ৭৭.৯০ গ্রাম মাংস এবং ১৪৫.৮০ গ্রাম ডাল পাওয়ার অধিকারী হলেও কতিপয় অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেক কম পরিমান খাবার সরবরাহ করে,যা তাদের প্রতিদিনের চাহিদা মেটানোর জন্য খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া,যে খাবার সরবরাহ করা হয় তা খুবই নিম্নমানের।
যদিও কারাবিধি অনুযায়ী কারাবন্দীদের কারাগারের বাইর থেকে খাদ্য সরবরাহ করা নিষিদ্ধ,তারপরও কতিপয় অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজসে অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তা করা হয়। এমনকি অবৈধ অর্থ প্রদান করলে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাল খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়।
কারাগারগুলোতে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয় না বললেই চলে।যেটুকু প্রদান করা হয় তা শুধু নামেমাত্র আর প্রাথমিক পর্যায়ের। প্রয়োজনীয় ঔষধের অপর্যাপ্ত সরবরাহ,সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের অভাব,কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দূর্নীতি কারাগারের স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটিয়েছে। অধিকাংশ অসুস্থ কারাবন্দীর চিকিৎসা সেবা পেতে খুব ঝামেলা পোহাতে হলেও বিত্তশালীরা অসুস্থ না হওয়া সত্বেও খুব সহজেই কারা হাসপাতালের ওয়ার্ডে অবস্থান করার সুযোগ পায়।
কারাবিধির ৯৪ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক কারাগারে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা দেখা যায় না। যা খুবই উদ্বেগজনক। তাছাড়া,গর্ভবতী কারাবন্দীদের মাসে দু’বার করে শারীরিক পরীক্ষা করার কথা কারা বিধিতে থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।
জীবাণুমুক্ত খাবার পানি কারাগারসমূহে বন্দী মহিলা কারাবন্দীদের জন্য যেন অলিক স্বপ্ন। অন্যান্য কারাবন্দীদের ন্যায় তাদেরও পাইপ লাইনে সরবরাহকৃত সাধারণ পানি পান করতে হয়। যে পানি সাধারণত প্রাত:কার্য শেষে ব্যবহার করা হয়। তদুপরি,স্যানিটারী ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাও স্বাস্থ্য সম্মত নয়।
তাছাড়া, নারী কারাবন্দীদের জন্য পৃথক ট্য়লেটের অপর্যাপ্ততার কারণে দীর্ঘ লাইন দিয়ে প্রাতঃকার্য সম্পন্ন করতে হয়। সর্বোপরি,টয়লেটগুলো প্রতিদিন নামেমাত্র পরিষ্কার করা হলেও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অধিকাংশ সময় অস্বাস্থ্যকর ও ব্যবহার অনুপযোগী থেকে যায়।
লেখক: মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও কলামিস্ট; প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ; ইমেল:
[email protected]
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন