সাপ্তাহিকী
|
শেখ আখতার উল ইসলাম
|
|
অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে চলেছে স্বদেশ
13 Apr, 2013
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে আজ দূর্যোগের ঘনঘটা। দেশ জুড়ে হরতাল, অবরোধ, ঘুম, খুন, মারা মারি, কাটাকাটি, ভাংচুর আজ নিত্ত-নৈমিত্তিক ঘটনা। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত্বায়নের কাছে দেশ আজ অবরুদ্ধ- মানুষ আজ জিম্মি। দেশের মানুষের সামনে আজ নেই কোন আশার আলো, নেই ভরসার কোন আলোকবর্তিকা। আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে দেশ আজ বিভাজিত। অন্ধকারের এক কালো বিড়াল বিস্তৃর্ণ এ অঞ্চলকে আজ লন্ড -ভন্ড করে তুলেছে। এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে দ্রুত ধাবমান আজ বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ যার জন্ম হয়েছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। এক দীর্ঘ সংগ্রাম আর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে। যে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল রাম, রহিম, জন, পল। যে যুদ্ধে ইজ্জত দিয়েছিল গীতা, সীতা, সখিনা, জরিনা। বাংলাদেশের এমন কোন গ্রাম নেই যে গ্রামে শহীদ মিনার নেই, নেই শহীদের কবর কিংবা বীরঙ্গনার আর্তনাদ। বাংলাদেশের এমন কোন এলাকা নেই, যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংস যজ্ঞের চিহ্ন নেই। বাংলাদেশের এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল শামস কিংবা জামাত-শিবিরের তান্ডব হয়নি। সৌভাগ্য এ দেশের মানুষের যে লাওস, কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনামের মত সুদীর্ঘ কোন যুদ্ধ তাদের করতে হয়নি। ভাগ্যবান বাঙ্গালী জাতি সে যুদ্ধে পেয়েছিল এক অসাধারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সূদৃঢ় এক জাতীয় ঐক্য আর মহান আল্লাহর আশীর্বাদ। যার ফলে আধুনিক মারনাস্ত্রে সু-সজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ খালি হাতে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে পরাজিত করে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল স্বাধীন- সার্বভৌম একটি দেশ, বাংলাদেশ। বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ আজ ও তাই বিশ্বের বিস্ময়, ইতিহাসের গবেষণার বিষয়বস্তু।
বাংলাদেশ যে রাষ্ট্রের জন্মের পিছনে রয়েছে জাতীয় ঐক্যের সুদৃঢ় এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। যেমন রয়েছে এক সফল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ইতিহাস। তেমনি রয়েছে চক্রান্ত-ষঢ়যন্ত্র আর মোনাফেকী-বেঈমানীর এক কলঙ্ক জনক ইতিহাস। রয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক বিভ্রান্ত বাঙ্গালী নাম ধারী কুলাঙ্গারের দুঃখজনক নারকীয় তান্ডবের ইতিহাস। যারা আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। ধর্মের নামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী রূপে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছিল। যারা পাক হানাদার বাহিনীকে পথ চিনিয়ে দিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। যারা জাতীকে মেধাশূন্য করার জন্য জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকা তৈরী করে তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। যারা আমাদের মা-বোনকে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। তারা ধর্মের নামে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অখন্ডতা রক্ষার নামে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে অপবিত্র করেছিল। পাকিস্তান রক্ষার নামে নাপাক বাহিনীকে সহায়তা করে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছিল।
দূর্ভাগ্যজনক হলে ও সত্য যে ইতিহাসের কলঙ্কজনক এই অধ্যায়ের নরাধমেরা কিন্তু বিজয়ের পর ক্ষমা না চেয়েই ক্ষমা পেয়ে যায়। কিন্তু তারা ক্ষমা করেনি স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় বীর আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে। আর তাই আঁতুড় ঘরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে বিনিষ্ট করে দিতে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পরই তারা প্রথমেই আঘাত হানে স্বাধীনতার সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ঘাটিতে। তাদের আক্রমনে লন্ড-ভন্ড হয়ে যায় স্বাধীনতার সোনালী স্বপ্ন। নিষ্ঠুর-নির্মম ভাবে নিহত হন জাতির জনক, স্বাধীনতার মহান স্থপতিগণ। রক্তে লেখা সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি- বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে তারা প্রথমেই ছুড়ে ফেলে দেয়। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা মরিয়া হয়ে উঠে। বাংলাদেশকে পূণরায় তারা পাকিস্তানের পথে ধাবিত করে।
স্বাধীনতার পরাজিত শকুনেরা নতুন কৌশল শুরু করে, চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দাবার গুটি রূপে তারা বেছে নেয় স্বাধীনতা যুদ্ধের এক সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াকে। কাটা দিয়ে কাটা তোলার নীতিতে তারা এক মুক্তিযোদ্ধাকে অপর মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। নিষ্ঠুর নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশার্রফ, কর্ণেল হুদা, হায়দার সহ অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। জিয়াকে দিয়ে ফাসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করায় স্বাধীনতা যুদ্ধে পা হারানো পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহেরকে। তার পর দাবার গুটি জিয়াকে ও তারা ছুড়ে ফেলে দেয়। নিষ্ঠুর নির্মম ভাবে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তারা হত্যা করায় জিয়াকে। আবার জিয়ার হত্যাকারী বানিয়ে ঘাতক পাঠিয়ে তারা হত্যা করায় সবচেয়ে মেধাবী সেক্টর কমান্ডার মঞ্জুরকে। জিয়ার হত্যাকারী সাজিয়ে ফাসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করায় বার জন মেধাবী তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারকে। এবার দাবার আসল গুটি পাকিস্তান ফেরত হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে তারা মাঠে নামায়। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ শহীদের রক্তে লেখা সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম সংযোজন করে স্বাধীনতার মূল চেতনাকে বিনষ্ট করে পাকিস্তানের পথে ফিরিয়ে নিয়ে যায় -বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশ পলি মাটির দেশ, বাংলাদেশ জোয়ার ভাটার দেশ। এ দেশের মাটি ও মানুষ বড় সহজ সরল। ষড় ঋতুর প্রভাবে বর্ষায় তা গলে গিয়ে নরম কাদায় পরিণত হয় আবার গ্রীষ্মের দাব দাহে কঠিন শক্ত হয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। জোয়ারে জেগে উঠে দুকূল প্লাবিত করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আবার ভাটার টানে শুকিয়ে গিয়ে মরা নদীর ন্যায় পড়ে থাকে। বাংলার মাটি প্রকৃতি আর মানুষের কারণেই কোন অর্জনকেই বাঙ্গালী জাতি বেশী দিন ধরে রাখতে পারে না। আর তাই একাত্তরের স্বাধীনতা পচাত্তরেই পথ হারায় আবার নব্বইয়ে জেগে উঠে মানুষ। গণঅভ্যূত্থানে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। তিন জোটের রূপ রেখায় বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার বাসনায় মানুষ জাতীয় দুই বীরের উত্তারাধিকারের হাতে নিজেদের সপে দেয়। কিন্তু দূর্ভাগা এ জাতির সকল আশা ভরসাকে ব্যর্থ করে দিয়ে উত্তরাধিকারের দাবীতে ক্ষমতায় আসীন দুই নেত্রীর কাঁধে আবার ও ভর করে স্বাধীনতার পরাজিত শকুন। একুল থেকে ওকুলে চড়ে দোল খেতে খেতে দুধ কলা খেয়ে দুই নেত্রীর আঁচলের তলে হৃষ্ট-পুষ্ট হয়ে বেড়ে উঠে স্বাধীনতার পরাজিত শকুন। যে শকুন আজ আবার স্বাধীনতার পতাকাকেই খামচে ধরেছে।
বাংলাদেশের সামনে আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতার পরাজিত শকুনেরা আজ মরল আঘাত হানছে। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। অতীতের ন্যায় পুণরায় পবিত্র ধর্ম কেই তারা হাতিয়ার করে নিয়েছে। আস্তিক- নাস্তিক বিতর্কে জাতিকে তারা আজ বিভাজিত করে ফেলেছে। বাংলার সহজ সরল ধর্ম প্রাণ মানুষের মনে ধর্মীয় উন্মাদনা জাগিয়ে তুলে পঞ্চান্ন হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশকে আজ তারা লন্ড ভন্ড করে চলেছে। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা কোন কিছুই তাদের তান্ডব থেকে রক্ষা পায়নি। তারা শহীদ মিনার ভেঙ্গেছে, জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে। হিন্দু ভাইদের উপর আক্রমন করে তাদের ঘর বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা জাতীয় দুই বীরের লাশকে মূখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়ে তাদের দুর্বল -দেউলীয়া নেতৃত্বের মাঝে ক্সমতার অন্ধ- মোহ-তৃষ্ণা জাগিয়ে দিয়েছে। পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ আর ঘৃণা জাগিয়ে তুলে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। যে আগুনে আজ দাউ দাউ করে জ্বলছে বাংলাদেশ। এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে আজ ধাবমান বাংলাদেশ। দেশ ও জাতীর চরম এই ক্রান্তি লগ্নে আজ সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় সংলাপ। প্রয়োজন ইস্পাত কঠিন এক সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন