সাপ্তাহিকী
|
এস এম মুকুল
|
|
কি দেখার কথা কী দেখছি
13 Apr, 2013
হরতালে একদিনে ১৬০০ কোটি টাকা ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। একদিনের হরতালে দেশের অর্থনীতিতে যে ক্ষতি সাধিত হয় তার পরিমাণ ২০ কোটি মার্কিন ডলার। ১৫ দিনের হরতালে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তা দিয়ে একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। আসুন আমরা হরতাল না করার অঙ্গীকার করি। আর হরতালে যে ক্ষতি হয় দেশের সকল ব্যবসায়ীরা মিলে সেই টাকা দিয়ে দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করি।
দেশে রাজনীতির যেন ভরাডুবি চলছে। রাজনীতিতে বিবেক, বুদ্ধি আর মানবতাবোধের লেশ মাত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জনগণকে বলির পাঠা বানিয়ে, জনগণের নামে, দেশপ্রেমের নামে রাজনীতির যে নমূনা দেখা যাচ্ছে - এর পরিণতি কাউকে ছাড় দিবে বলে মনে হয়না। দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারের নাম করে হরতাল অতীতেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়তোবা হবে। কিন্তু বর্তমানে হরতালের যে ভয়ঙ্কর, বীভৎস চিত্ররূপ জনগণ প্রত্যক্ষ করছে তার পরিণতিও জাতির কাঁধে ভর করবে। হরতালে এমন ভংঙ্কর, নির্মম বিধ্বংসী উল্লাস অতীতে দেখা যায়নি। চলন্ত যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ এসব যেন মানবতা বিরোধী অপরাধের নতুন আদল।
জনগণের নামে রাজনীতি করে, জণগণের সম্পদ নষ্ট করা, জনগণকে পুড়িয়ে মারা, জনগণের মাঝে আতঙ্ক ছড়ানো কোনো রাজনৈতিক সভ্যতা হতে পারেনা। অবাধে গাছ কাটা, রেলের বগিতে আগুন দেওয়া, পেট্রোল বোম মেরে বাস, গাড়ী পুড়িয়ে দেয়া ধর্ম রক্ষার নাম রাজনীতির সভ্যতা হতে পারেনা। দেশের জনগণ এত বোকা নয়। তরুণ সমাজ এখন সদা জাগ্রত। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে প্রতিরোধ অবশ্যম্ভাবী।
হরতালকে বলা হয় গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের ভাষা। আসুন এবার হরতাল সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিই। হরতাল একটি গুজরাটি শব্দ। গুজরাটিতে বলা হয় হাড়তাল যা সর্বাত্মক ধর্মঘটের প্রকাশক। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। হরতাল হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত আন্দোলনের নাম বিশেষণ।
হরতালের লাভ-ক্ষতি কি? হরতালের কোনো লাভ কি আছে? হরতাল করে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজালে সরকার বা বিরোধী দল কারোরই দৃশ্যমান লাভ নেই। যেটা আছে সেটা হলো দেশকে পিছিয়ে নেয়ার পথ তৈরি করা। হরতালকে সরকারের ক্ষতি বলে ধরে নিলে বোকামি হবে। কারণ বিরোধী দল যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তাদের কেউ নিজেদের ডাকা হরতালের জের অবশ্যই টানতে হবে। আসুন জেনে নিই হরতালের দেশের কতটা ক্ষতি হচ্ছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র এক তথ্য প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হরতালে একদিনে ১৬০০ কোটি টাকা ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বলা হয়েছে একদিনের হরতালে দেশের অর্থনীতিতে যে ক্ষতি সাধিত হয় তার পরিমাণ ২০ কোটি মার্কিন ডলার। ১৫ দিনের হরতালে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তা দিয়ে একটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। আসুন আমরা হরতাল না করার অঙ্গীকার করি। আর হরতালে যে ক্ষতি হয় দেশের সকল ব্যবসায়ীরা মিলে সেই টাকা দিয়ে দেশের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়ক ভুমিকা পালন করি।
এবার জানব কেন হরতাল করা হয়। নির্দিষ্ট কোনো দাবি আদায় করা বা এর গুরুত্ব বোঝাতে হরতাল আহ্বান করা হয়। শান্তিপূর্ণ হরতালের মূল কার্যক্রম হতে পারে প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন এবং সমাবেশ। আমাদের দেশে হরতাল আইনসিদ্ধ অধিকার হলেও হরতালের নামে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা আইনসিদ্ধ কাজ নয়।
হরতাল আহ্বান করা একটি রাজনৈতিক অধিকার। আবার হরতাল পালন করা বা না করাটাও নাগরিক অধিকার। অপরপক্ষে হরতালে জানমালের নিরাপত্তা পাওয়া সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকারকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। দেখার বিষয় হলো হরতাল কি জনস্বার্থে ডাকা হচ্ছে? হরতালে কি জনসমর্থন আছে? বিরোধী দলগুলো হরতাল শেষে বলে- জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে হরতাল সফল হয়েছে। আবার সরকার বলে জনগণ হরতালতে প্রত্যাখ্যান করেছে। জনগণকে নিয়ে প্রকাশ্যে এই নোংরামি রাজনীতি করতে তাদের নূন্যতম লজ্জাবোধটুকুও লক্ষ করা যায়না!
যে রাজনীতি জনগণের কষ্টের কারণ হয় সেই রাজনীতি কখনো দেশে শান্তি বয়ে আনতে পারে না। রাজনীতিবিদরা কি ভাবেন গাড়িতে যখন আগুন লাগানো তখন কার সম্পদ নষ্ট হয়? ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হলে কার ক্ষতি হয়? এইসব ক্ষতি শুধুই ব্যক্তিগত ক্ষতি? ভাবতে অবাক লাগে- কার গাড়ী কে পোড়ায়! রাজনীতিবিদদেরকে বলতে চাই হরতালের মানে যদি গাড়ী পোড়ানো বা সম্পদ নস্ট করা হয়ে থাকে তাহলে আপনারা একদল অপর দলের নেতাকর্মীদেরও গাড়ী বাড়ি পোড়ান। জনগণ বসে বসে দেখবে। নিজেরা নিজেদেরকে শেষ করেন। একে অপরকে ধ্বংস করেন, তবু দেশকে নিয়ে, দেশের জনগণকে নিয়ে রাজনীতির খেলা খেলবেন না। যারা নির্বিচারে দেশের ক্ষতি করে তারা কোন মুখে দেশের কল্যাণের রাজনীতির কথা বলে?
হরতালে বোমাবাজি, গাড়ি-বাড়ি-দোকানপাট পোড়ানো, পুলিশের ওপর চড়াও হওয়া- রাজনীতিতে এসব আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু বিগত হরতালে কয়েকটি ঘটনা বর্বরতা ও নির্মমতার রেকর্ড ছাড়িয়েছে। লালমনিরহাটে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিকেটাররা হামলা চালিয়ে ভবন ও আসবাব ভাঙচুর করেছে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লাঞ্ছিত করেছে, এমনকি কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মারপিট করেছে। চট্টগ্রামে পিকেটারদের নিক্ষিপ্ত হাতবোমার আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছে এক স্কুলছাত্রী। যশোরে পিকেটারদের ধাওয়ায় পণ্যবোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারালে জীবন গেছে তিন শ্রমিকের। ধাওয়া খেয়ে সিএনজি উল্টে অন্তসত্তা মহিলা আহত হয়েছে। যাত্রী সেজে চলন্ত বাসে পেট্রোল দিয়ে আগুন দেয়া হয়েছে। চলন্ত বাসে ঢিল ছোড়া হচ্ছে। আগুন ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে! যাত্রীদের নামার সুযোগ দেয়া হচ্ছেনা। গরীব সিএনজি বা রিক্সা চালককে মারপিট করে তার উপার্জনের চালিকা শক্তি বাহনটিকে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এই নৃশংসতার নাম কি হরতাল পালন? রাজনীতির এ কেমন বীভৎস চেহারা আমরা দেখছি? স্বাধীনতার ৪২ বছরে- কী দেখার কথা কী দেখছি?
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, হরতাল বা রাজনৈতিক সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে পরিবহন খাত। সব আক্রোশ যেন এইসব নির্জীব যানবাহনের উপর। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে দেখা গেছে- গত পাঁচ মাসে আগুনে পোড়ানো হয়েছে প্রায় ৪০০ যানবাহন। নির্বিচারে ভাংচুর করা হয়েছে আরো প্রায় ৩০০০ যানবাহন। তাদের হিসাব অনুযায়ী শুধু যানবাহন পোড়ানোর ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকার বেশি। কমলাপুরে রেলের বগিতে আগুন দেয়া সহ রেলে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৯৫টি। যারমধ্যে ৭৬টি ঘটনায় সম্পদ ও রাজস্ব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। হরতালে রক্ষা পায়নি এম্বুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, পুলিশ, দমকল বাহিনীর যানবাহন। এসব কি ধরণের বর্বর সহিংস রাজনীতি!
দেশের সম্পদ ধ্বংস করে, দেশের জনগণের সম্পদ বিনস্ট করে, জনগণের যানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এ কোন ধরণের দেশপ্রেমের রাজনীতি করছেন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো! এটা কেমন ধরণের জনগণের কল্যাণের রাজনীতির নমূনা! হরতালে মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন, পিকেটিং হতেই পারে। তবে বিভৎসতা কেন? যাত্রী পরিবহনে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মেরে জনগণকে পুঁজি করে রাজনীতির পরিণাম ভালো হবেনা। কথায় কথায় জণগণ আর দেশের কল্যাণের নামে রাজনীতির কথা বলে অকাতরে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ আর নাশকতাকে জনগণ সমর্থন করেনা। বিরোধি দল হরতাল ডেকে যানমালের ক্ষতি করে সরকারের ওপর দায় চাপানোর ধোকাবাজির রাজনীতি করবে এসব জনগণ সমর্থন দেয়না। আবার সরকারের পেটুয়াবাহিনী পুলিশ ও ছাত্রলীগ যত্রতত্র হামলা, ধরপাকড় করবে এসবও জনগণ সমর্থন করেনা। পাখির মতো মানুষকে গুলি করে হত্যা করা জনগণের সমর্থনযোগ্য নয়। আবার জামাত শিবির ধর্মীয় দুর্বলতাকে পুঁজি করে যে ন্যাক্কারজনক হামলা, লুটপাট এবং দেশের সম্পদের ক্ষতি করছে এসবকে কখনোই জনগণ সমর্থন করেনা।
জামাত শিবিরের উগ্র রাজনৈতিক অপতৎপরতা বরং জনগণের মনে ধিক্কার ও ঘৃণাকেই জাগ্রত করছে। একই দেশের মানুষ হয়ে, এক ধর্মের অনুসারী হয়ে জামাত শিবিরের দেশপ্রেমহীন অপরাজনীতি এদেশের মানুষ ঘৃণাভরে পরিত্যায্য ঘোষণা করবে। প্রশ্ন হলো এসব কিছুই করা হচ্ছে জনগণের দোহায় দিয়ে। বিরোধী দল বলছে জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে হরতালকে সমর্থন করে সফল করেছে। পক্ষান্তরে সরকারী দল বলছে জনগণ হরতালকে সমর্থন করেনি। দেশের নিরীহ জনগণকে মাঝখানে বলির পাঠা বানিয়ে মিথ্যাচারের এই রাজনীতি পরিহার করার সময় এসেছে।
জামায়াত-শিবির এবার রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা আটছে বলে তথ্য পেয়েছে র্যাব। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে গত নভেম্বর থেকেই পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে আসছে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। রাজধানীসহ সারাদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রে জামায়াত-শিবিরের হামলা ও নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জামাত শিবিরের এই রাজনীতির প্রতি জনগণের ঘৃণা এখন ক্ষোভের ফণা তুলছে। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে গোটা জাতি একমত। এই বিচার নিয়ে আর দ্বিধা-বিভক্তির অবকাশ নেই। এই বিচারকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য জামাত শিবির যা করছে তা কার্যত তাদের রাজনৈতিক আদর্শহীনতাকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। ধর্ম রক্ষার কথা বলে তারা নিজেরাই ধর্ম-বিরোধী, মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ করছে। দেশে আইনের শাসনকে অবজ্ঞা করছে। এই দেশে বাস করে, এই মায়ের কোলে থেকে- এই দেশের আলো-ছায়া উপভোগ করে তারা দেশের সাথে বেইমানি করছে। তারা যেন মায়ের সাথে বেইমানি করছে। তা না হলে কয়েকজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচাবার জন্য তারা নির্মম নাশকতা চালাতে পারত না।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর অধঃপতনে নিমজ্জিত হচ্ছে। হরতালকারী দলের নেতারা গার্মেন্টস হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা দিলেও রেহাই পাননি গার্মেন্টসকর্মীরা। হরতালের নামে গার্মেন্টকর্মীদের বহনকারী বাসেও হামলা হয়েছে। হরতালের আগের রাতে নির্বিচারে গাড়ী পুড়িয়ে, ভাংচুর করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। চলমান এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেও হরতাল হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত বিনির্মাণের পথে রাজনীতিকে এখন বাধা হিসেবে ধরে নিবে আমাদের প্রজন্ম। সেই প্রজন্মের কাছে কোন মুখে ভোট চাইবেন রাজনীতিবিদরা।
শুরু হতে যাচ্ছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এবারো কি হরতাল ডাকবে? নাকি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের কথা বিবেচনা করে পরীক্ষার সময় হরতাল না রাখার মতো সুবিবেচনা দেখাবে বিরোধী দলগুলো? পরীক্ষার্থীদের জিম্মি করে, স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মারপিট করে, বোমা হামলায় শিক্ষার্থীর দৃষ্টিশক্তি কেড়ে, ট্রাকশ্রমিক-দোকান কর্মচারীর মতো খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে দেশে কোন ধরণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় রাজনীতিবিদরা। সে রাজনীতির ভবিষ্যত কি?
সাধারণ জনগণের মনে প্রশ্ন- হরতালের নামে কেন এই নৈরাজ্য? যাত্রীসহ একটি বাসে যারা আগুন লাগিয়ে দেয় তারা কি মানুষ? দেশের সম্পদ যারা নষ্ট করে তারা কি দেশপ্রেমিক? রাজনীতি যদি দেশের জন্য হয়, দেশপ্রেমের জন্য হয় অথবা জনগণের জন্য হয় তাহলে দেশ ও জনগণের বিপক্ষে যায় এমন কর্মকান্ড বন্ধ করুন। দেশকে ভালবাসুন, মায়ের মতো।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন