‘এয়ারপোর্ট দেখলেই একটা দেশ দেখা হয়ে যায়’ আব্বু বলতেন। এ নিয়ে তার সঙ্গে ঠাট্টা করেছি। একবার বললাম, ‘আব্বু, আমি তো তুরস্ক ঘুরে আসলাম।’ তিনি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কবে?’ আমার উত্তর, ‘লন্ডন থেকে মেজমামার কাছে বেইজিং যাওয়ার পথে ইস্তাম্বুল হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি বল না এয়ারপোর্ট দেখলেই দেশ দেখা হয়? তার মানে আমিও তুরস্ক দেখেছি...হা হা হা।’ প্রায় এক যুগ আগের ঘটনা। এতদিন পর ঠাট্টাটা ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যত বেড়েছে তত বুঝেছি, বিমানবন্দর যে কোনো দেশের আয়নার মতো। রাষ্ট্রীয় দর্শনের অনেকটাই বোঝা যায় বিমানবন্দরের পরিকল্পনা ও সেবার মান দেখে। যেমন সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে নেমেই বুঝতে পারি যে, ভীষণ সুচিন্তিতভাবে এর নির্মাণ করা হয়েছে। ডিউটি ফ্রি শপ, ডিজাইনার সামগ্রীর দোকানপাট, বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি তো যে কোনো ভালো বিমানবন্দরেই থাকে; চাঙ্গিতেও প্রচুর পরিমাণে আছে। সেটা ব্যাপার না। আমাকে মুগ্ধ করে এখানকার বাগানগুলো। চারটি টার্মিনালজুড়ে সূর্যমুখী, অর্কিড, ফার্ন, ক্যাকটাস, বাঁশ, প্রজাপতি, হেলিকোনিয়া এবং সুগন্ধি ফুল নিয়ে নয়টি বাগান। বেশ কয়েকবার সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ যাত্রা বিরতির জন্য থামতে হয়েছে। যে কোনো বাগানে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটানো দারুণ অভিজ্ঞতা; ভ্রমণে ক্লান্ত যে কোনো যাত্রীর জন্য তা খুব প্রশান্তিদায়ক। সিঙ্গাপুরের আরেক নাম ‘গার্ডেন সিটি’। এ নগর রাষ্ট্রের পুরো পরিকল্পনার মাঝেই নাগরিক জীবনে সবুজকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ আছে। বাগানগুলো কি তারই প্রতিফলন নয়?
ভীষণ ভালো লাগে বিমানবন্দরের বর্জ্য রিসাইক্লিং এর ব্যবস্থা দেখলে। একে কেন্দ্র করে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির বিষয়টি ও প্রশংসনীয়। সিঙ্গাপুরের আবাসিক এলাকাগুলো নিয়ে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। এক দম্পতির সাক্ষাৎকার মনে দাগ কেটেছে। তারা প্রায় পঞ্চাশ হাজার ডলার খরচ করে নিজেদের ফ্ল্যাট নতুন করে সাজিয়েছেন। কারণ? তারা একে পরিবেশবান্ধব করতে চেয়েছিলেন, ফলে এমন সব প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন যাতে বিদ্যুতের যথেষ্ট পরিমাণে সাশ্রয় হয়। তাদের একজন ব্যাখ্যা করেন, ‘আমাদের খরচ একটু বেশি হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমরা এটা করেছি’। আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউ অসম্ভব দূরদৃষ্টি নিয়ে দেশ গড়েছেন। সেখানকার নাগরিকরা আজ বিশ্বের কথা ভাবছে। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা তাড়িত সময়ে সঙ্কীর্ণ ও স্বল্পমেয়াদি চিন্তা-ভাবনাই সাধারণ হয়ে উঠেছে। সেখানে কিছু মানুষ যে গোটা মানবজাতি নিয়ে চিন্তিত তা জানলেই তাদের প্রতি শ্রদ্ধা হয়।
চাঙ্গি বিমানবন্দরে নিচু বেসিন দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। বোঝাই যায়, শিশুদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে। সামনের ছোট আয়নায় রঙ্গিন ফুল ও প্রজাপতি। কতটা চিন্তাশীলতা আছে এর মাঝে! একটা অংশে শিশুদের খেলার স্থান- সেখানেও রং ও নকশার সৃষ্টিশীল ব্যবহার চোখে পড়ে। শিশুরা যাতে বিমানবন্দরে থাকার সময়েও বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা পায় তার জন্য কি চমৎকার প্রচেষ্টা!
প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, শিশুদের জন্য প্রয়োজনে ট্রলি পাওয়া যায়। টেলিভশন, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট, গেমস ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে আছে টার্মিনালগুলোতে। একস্থানে ঐতিহ্যবাহী ছাপচিত্র চর্চার ব্যবস্থা। মাঝে মাঝে শিল্প প্রদর্শনী, সঙ্গীতানুষ্ঠানও হয়। বিমানবন্দরে থাকার সময়টুকু যাতে বিভিন্ন বয়সের ও নানা ধরনের ব্যক্তি আরাম ও আনন্দের সঙ্গে কাটাতে পারে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। কর্মীরা দক্ষ ও আন্তরিক। যে পরিকল্পনা, কর্মোদ্যম, ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার কারণে সিঙ্গাপুর নামক দেশটির বিস্ময়কর উত্থান বিমানবন্দর যেন তারই এক প্রতিরূপ। বোঝাই যায়, এই দেশের দৃষ্টি ভবিষ্যতের দিকে।
২
স্টিভেন স্পিলবার্গ ‘টার্মিনাল’এ নিপুণতার সঙ্গে দেখিয়েছেন, বিমানবন্দর কিভাবে একটা দেশের ক্ষুদ্র সংস্করণ হয়ে উঠতে পারে। এই চলচ্চিত্রে বিমানবন্দরের কর্মীদের জীবনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম মূর্ত হয়ে ওঠে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা বোঝা যায় সেখানে আটকেপরা এক যাত্রীর প্রতি আচরণে, যাকে কেন্দ্র করে কাহিনী।
৯/১১ এর আড়াই সপ্তাহ পর আমেরিকা যাওয়ার স্মৃতি আজীবন মনে থাকবে। কেন? তাহলে গল্পটা বলা যাক। লন্ডন থেকে ডেট্রয়েট হয়ে বস্টন যাব। ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের পালা শেষ করে লাগেজের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। বিশাল সব কুকুর নিয়ে অনেক নিরাপত্তা রক্ষী ঘোরাঘুরি করছিল। ভীতিকর ও দমবন্ধ করা পরিবেশ। পুরো দেশে আবার সন্ত্রাসী আক্রমণ নিয়ে যে উদ্বেগ বিরাজ করছিল তা বুঝে গেলাম বিমানবন্দরের বাইরে পা দেয়ার আগেই। তখন থেকেই আমেরিকা ও পশ্চিমের নানা দেশে নির্দিষ্ট নামের যাত্রীদের হয়রানি এখন সবার জানা-সে অভিজ্ঞতাও হয়েছে। সে বিষয়ে আর নাই বা লিখলাম।
৩
পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোর্সবি বিমানবন্দরে প্রথমবারের একটা মধুর স্মৃতি আজীবন মনে থাকবে। যাত্রীরা ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পথে কয়েকজন শিল্পী স্থানীয় পোশাক পরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছিল। মনে হচ্ছিল, এত চমৎকার ‘স্বাগতম’ কোনো দেশের বিমানবন্দরে পাইনি। বেশিরভাগ ইমিগ্রেশনেই তো এমন ব্যবহার যে, যারা সে দেশে যেতে চাচ্ছে তাদের ‘সন্দেহ’ করতে হবে। পরেও কয়েকবার এরকম গান শোনার সুযোগ হয়েছে। বেশ ভালো লাগত উষ্ণতার ছোঁয়া। দেশটিতে কয়েক বছর থেকেছি। অনেক সঙ্কট আর সীমাবদ্ধতা আছে; তবে মানবিক আবেগের প্রাচুর্যে বার বার সিক্ত হতাম বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতার মতোই।
৪
পাপুয়া নিউগিনিতে থাকার সময় কয়েক মাস পরপরই অস্ট্রেলিয়ার কেইর্ন্স-এ যেতে হয়েছে। বিমানবন্দরে নেমেই মনে হতো, প্রকৃতির কাছাকাছি চলে এসেছি। বিমান থেকে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পথে দেয়ালে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ নিয়ে শিল্পকর্ম দেখা যায়। বিভিন্ন আকার ও রঙের প্রবাল, মাছ ও সামুদ্রিক জীব দেখলে চোখ জুড়ায়। বিমানবন্দরের চরিত্রটাই যেন বলে দেয়, উত্তর কুইন্সল্যান্ডের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনÑ গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ যার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
তবে অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ বিমানবন্দরে কাস্টমস-এর কড়াকড়ি দেখলে বোঝা যায় যে, এই দেশ ‘সীমান্ত রক্ষায়’ খুবই উদ্বিগ্ন! ইউনিফর্ম পরা কর্মীরা গম্ভীর মুখে বিশাল সব কুকুর নিয়ে ঘোরাঘুরি করেÑ কেমন যেন অস্বস্তি হয়।
৫
ইমিগ্রেশন কর্মীদের ব্যবহারে সমাজে বিদ্যমান প্রেজুডিস ও নানা বৈষম্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুইডিশ বন্ধু ম্যাগনাস এক গল্প শুনিয়েছিল-‘তখন আমার বয়স ১৬-১৭ বছর। হঠাৎ করে এক বন্ধু চুল বড় রাখতে শুরু করে। এরপর থেকে এয়ারপোর্টে তাকে অতিরিক্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে’। যেন কোনো কিশোরের বড় চুল থাকা মানেই তার মাঝে ‘অস্বাভাবিক’ কিছু আছে, যে জন্য তাকে সন্দেহ করা যুক্তিযুক্ত?
লন্ডনে পড়ার সময় আমার এক ব্রাজিলিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বন্ধু ছিল। নাম জো। মাত্র কয়েক বছর বয়স থেকেই সে ইংল্যান্ডে বাস করে। গায়ের রঙ বাদামি। সে বলেছিল, ‘লন্ডনে বিমানবন্দরে আমাকে অনেক প্রশ্ন করা হয়, যদিও আমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। আমার কিছু শ্বেতাঙ্গ ব্রাজিলিয়ান আত্মীয় যখন বেড়াতে আসে তখন কিন্তু কোনো ঝামেলা হয় না।’
কিছুদিন আগে আমার এক নারী সহকর্মী অফিসের কাজে ব্যাংককে একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসার জিজ্ঞাসা করল, ‘বেড়াতে যাচ্ছেন?’
‘না, মিটিংয়ে যাচ্ছি।’ তিনি উত্তর দিলেন।
তার পাল্টা প্রশ্ন, ‘আপনি কি একা যাচ্ছেন?’
প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছিলেন, কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রেখে উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, একা যাচ্ছি।’
এতেও যেন অফিসারটি আশ্বস্ত হচ্ছিল না। সে বলল, ‘একটু আগে একটা গ্রুপ গেল, আপনি তাদের সঙ্গে যাচ্ছেন না?’
দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর, ‘না।’
আমার কোনো পুরুষ সহকর্মীকে এ হেনস্থা করার সাহস কি ইমিগ্রেশনের কর্মী কোনোদিন পেত? বাংলাদেশে ধর্ম, আইন, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি নারীকে সমান মানুষের মর্যাদা দেয় না। বিমানবন্দরের ঘটনাটা কি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার অধস্তন অবস্থাটাই তুলে ধরে না?
ঢাকা বিমানবন্দরে বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি কর্মীদের দুর্ব্যবহার প্রায়ই দেখি। কিছু করতে পারি না বলে অক্ষম ক্রোধ হয়। বছর কয়েক আগে কুয়ালালামপুর যাচ্ছিলাম; শুনলাম যে ওভার বুকিং হয়েছে। চেক-ইন কাউন্টারের সামনে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে। এয়ারলাইনের কর্মীরা বেছে বেছে কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে বোর্ডিং পাস দিচ্ছিল। সারির সামনের দিকে থাকা শ্রমিকরা অগ্রাধিকার পেল না। প্রাধান্য দেয়া হলো বাহ্যিকভাবে দেখে যাদের সমাজের উঁচুতলার মনে হয়, তাদের। সাধারণ চেহারার ও পোশাকের ওপর মানুষই কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করে দেশে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠায়। আর উচ্চ আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেকের কোনো উৎপাদনমূলক ভূমিকা নেই, বরং কেউ কেউ বিদেশে টাকা পাচার করে আমাদের দেউলিয়া করে দিচ্ছে। তাদের প্রতি বিমানবন্দরের কর্মীদের আচরণ কি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের চেহারাটাই তুলে ধরে না, যে দেশের নীতিমালা সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের পক্ষে নয়? আর কত বছর লাগবে জনমুখী রাষ্ট্র গড়তে? কবে আমরা শিখব মানুষকে তার অবদানের জন্য যোগ্য সম্মান দিতে?
৬
এশিয়ার বেশ কিছু বিমানবন্দরে বাংলাদেশিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত দেখা যায়। ভাবি, দেশ থেকে এত দূরে এসে এত কষ্ট করার মানে কি? এটাই বোধহয় আবার প্রমাণিত হয় যে, আমাদের দেশে শ্রমের মর্যাদা নেই। এই ধরনের কাজ দেশে করা ওই শ্রমিকের পক্ষে অসম্ভব- সমাজের ভয়ে। এই মানসিকতা থেকে আমরা কবে মুক্ত হব?
বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করতে গিয়েও নানা অভিজ্ঞতা হয়- যার বেশিরভাগই খুব সুখকর নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন ব্যবহার যে, বাংলাদেশের একজন নাগরিক সেদেশে ঢুকতে পারলে আর যেতে চাইবে না! যেমন সিঙ্গাপুর-এ আট ঘণ্টার বেশি যাত্রাবিরতি হলে শহর ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বাংলাদেশিরা ভিসা ছাড়া এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে পারে না। সারা বিশ্ব ভ্রমণের প্রমাণ কারোর পাসপোর্টে থাকলেও হবে না। এখানে কিন্তু সব বাংলাদেশিই সমান, তার বিদেশে কাজ করার দরকার বা সে নিজে বিদেশিদের কাজ দিতে পারে Ñবাস্তবতা যাই হোক না কেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক শিক্ষক দুঃখ নিয়ে একটা গল্প বলেছিলেন। সৌদি আরবের কোনো এক বিমানবন্দরে তাকে ভিসা নিয়ে কিছু সমস্যায় পরতে হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল যে তিনি ডাক্তার, আর তাই সেই দেশে থেকে যেতে পারেন। তার নামের আগে ড. যে আসলে ডক্টরেট এবং তিনি নিজের দেশে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন সেটা ব্যাখ্যা করতে হয় তাকে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ অনেক কিছু অর্জন করলেও জাতি হিসেবে আমরা যদি সামনের দিকে না এগোই তাহলে বহির্বিশ্বে সম্মান পাওয়া যাবে কি? যে কোনো বাংলাদেশি কি বিমানবন্দরে সেটা তীব্র বেদনা দিয়ে অনুভব করেন না?
৭
সবকিছুর পরও বিমান ঢাকার মাটি ছুঁলে মনটা ভরে ওঠে। বাংলাদেশে ফেরার সময় সবচেয়ে যে বিষয়টা ভালো লাগে তা এই যে, ইমিগ্রেশন কার্ডে আমাকে কোনো কারণ লিখতে হয় না, যেহেতু এই দেশের উপর আমার অধিকার আছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও কিন্তু আমি এভাবে যেতে পারব না। তারা ভিসা দেয়ার আগে একশোটা প্রশ্ন জানতে চাইবে Ñব্যাংকে থাকা টাকার পরিমাণ থেকে শুরু করে কি কি অসুখ আছে তা পর্যন্ত, প্রমাণ করতে হবে যে আমি সেই রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হব না। বিমানবন্দরেও নানা উত্তর দিতে হয়। যেমনÑ কতদিন থাকব, কেন এসেছি ইত্যাদি। নিজের দেশ যে ঔদার্যে দু’হাত বাড়িয়ে আমাদের গ্রহণ করে আমরা কি তার যোগ্য প্রতিদান দেই? ‘নম নম নম বাংলাদেশ মম চির মনোরম চির মধুর/বুকে নিরবধি বহে শতনদী চরণে জলধি বাজে নূপুর/এই দেশেরও মাটি জল ও ফুল-ফলে যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে/এই মায়ের বুকে হেসে খেলে সুখে ঘুমাবো এই বুকে স্বপ্নাতুর/নম নম নম বাংলাদেশ মম চির মনোরম চির মধুর...’
৮
প্রিয়জনদের বিদায়ের বেদনা আর আবার তাদের ফিরে পাওয়ার আনন্দ-প্রতিদিন কত অসংখ্য মানুষ পৃথিবীর বিমানবন্দরগুলোতে জীবননাট্যের এই চিরন্তন আবেগে ভাসছে! এর পাশাপাশি মানবিক উষ্ণতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এখানে। তা নিয়ে একটা গল্প শোনানো যাক। অনেক দিন আগে জোহানেসবার্গ বিমানবন্দরে চুপচাপ বসেছিলাম। কারণ? নাইরোবি যাওয়ার ফ্লাইট মিস করেছি। পরদিন সকালের আগে যাওয়া যাবে না। শহরে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ আছে; বিমানবন্দরে যে কোনো সমস্যা হবে না, তা বলা যায় না। স্থানীয় এক নারী আমাকে প্রশ্ন করলেন যে কি হয়েছে। তিনি এক আত্মীয়কে বিদায় জানাতে এসেছিলেন। আমার অবস্থা জেনে বললেন যে চাইলে আমি তার বাসায় রাত কাটাতে পারি, তিনি সকালে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কেউ যে এমন করতে পারে তা প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি যাইনি, ভাবলাম রাতটা কোনোমতে কেটে যাবে। কিন্তু এখনো তাঁর এই সহৃদয় ব্যবহারের কথা ভাবলে মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। ‘মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর’ মতো মানুষ এখনো আছে, এমনকি বিমানবন্দরেও তাদের দেখা মেলেÑ তাহলে আর মানবজাতির ওপর বিশ্বাস হারাই কি করে?
(সুত্র, সাপ্তাহিক, ২১/০৩/২০১৩)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন