নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকারের অন্যতম লংঘন এবং একটি দেশের উন্নয়নে বড় বাঁধা। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা খুবই উদ্বেকজনক। বিগত বছরগুলোতে নারীর প্রতি সহিংসতার ব্যপকতা অবলোকন করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, মানবাধিকার সংগঠনসহ বিবেক সম্পন্ন জনগনের প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ ও দাবীর মুখে রাষ্ট্র বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে। তাছাড়া, নারীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানী, গৃহকর্মীদের সুরক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ছাত্রীদের শারীরিক নির্যাতন বন্ধসহ অন্যান্য সহিংসতা প্রতিরোধে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক রিট দায়েরের মাধ্যমে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে বেশ কিছু নীতিমালা প্রণয়নের দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ গত ১৪ মে ২০০৯ তারিখে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা সম্বলিত রায় প্রদান করেন। এই রায়ের আলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০ প্রনীত হয়েছে। তাছেড়া, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১১, হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়ে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা বিষয়ে দায়েরকৃত রিটের রায় প্রদান করেন এবং ১৩ জানুয়ারি ২০১১ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক শাস্তি প্রদান প্রতিরোধে নির্দেশনা দিয়ে রায় প্রদান করেন। এছাড়াও সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ গত ১২ মে ২০১১ তারিখে ফতোয়া সংক্রান্ত একটি যুগান্তরী রায় প্রদান করেন।
যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আদালতের প্রদত্ত রায় মোতাবেক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে অভিযোগ বক্স থাকতে হবে এবং অভিযোগ গ্রহনের জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করতে হবে যার বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী। এমনকি সম্ভব হলে এ কমিটির প্রধান হবেন একজন নারী। তাছাড়া, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান তার প্রতিষ্ঠানে সংঘঠিত যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করার জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।সর্বোপরি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা থাকতে হবে। গৃহকর্মীদের সুরক্ষা বিষয়ক হাইকোর্টের প্রদত্ত রায় অনুযায়ী ১২ বছরের নীচে কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না। তাছাড়া, গৃহশ্রমিকদের নিবন্ধন করাসহ যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হাইকোর্ট নির্দেশনা প্রদান করেছে।
কিন্তু দেখা যায় যে, আদালতের প্রদত্ত নির্দেশনা ও নীতিমালাগুলো শুধু নথির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, বাস্তবে তেমন কোনো প্রয়োগ নেই। বাস্তবায়নের জন্য নেই কোনো মনিটরিং কমিটি। এমন পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদালতের রায় বাস্তবায়ন না হবার ফলে বাংলাদেশ দেখেছে নাটোরের শিক্ষক মিজানুর রহমানের নৃশংস্য হত্যাকান্ড, মধুখালীর চাপারানী হত্যাকান্ড, হেনার আত্নহত্যা এবং সন্তানসহ মায়ের ট্রেনের নীচে ঝাপিয়ে পড়ার মত ঘটনা।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন এর বিষয়ে প্রস্তাবিত খসড়া টিকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনে পরিণত করা প্রয়োজন। এছাড়া ভিক্টিম স্বাক্ষী সুরক্ষা আইন এর বিষয়ে প্রস্তাবিত খসড়া টিকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনে পরিণত করে দ্রত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাছাড়া, ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার ও ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (OCC) এর সেবা তৃনমূল পর্যায়ে সম্প্রসারণ করার পাশাপাশি সমাজ সেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর সেবার মান ও সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এছাড়াও, মহামান্য আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা ২০১০ খসড়া’র আলোকে একটি পূর্নাঙ্গ আইন প্রণয়ন করে কার্যক্র প্রয়োগ প্রয়োজন। একইসাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে Corporal Punishment নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের দেও্য়া রায়, ফতোয়ার নামে বিচার বহির্ভূত শাস্তি প্রদান বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক রায় এবং পর্ণগ্রাফি প্রতিরোধ আইনটি সহ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ এর কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
সর্বোপরি, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রনীত প্রচলিত আইনগুলোর কার্যকর প্রয়োগ, সুষ্ঠ বাস্তবায়ন এবং নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জনগনের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা আবশ্যক। পাশাপাশি আমাদের সকলের সহযোগিতা নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে গুরত্ত্বপূর্ন অবদান রাখতে সক্ষম।
লেখক:মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিক; প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ; ইমেল:
[email protected], ব্লগ: www.shahanur.blogspot.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন