সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
ইতিহাসের সবচে বড় শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহন করে নাঃ
23 Mar, 2013
ছেলেকে ইতিহাস পড়াচ্ছিলাম, সুলতানি আমল-মোগল আমল হয়ে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত, ক্লাশ থ্রী সোস্যাল সাইন্স বইয়ে এক চ্যাপ্টারে গল্পের আকারে লিখা। মাঝখানে পেলাম বিখ্যাত শায়েস্তা খা সময়ের টাকায় আট মন চাল পাবার গল্প। সাথে তাকে ৪০ টাকা কেজি হিসাবে তখনকার এক টাকার চাল কিনতে এখন কত লাগে সেটার হিসাব করালাম, দেখা গেল আট মন চাল কিনতে এখন লাগে ১২,৮০০ টাকা। তাকে বললাম ঐ সময়ে যেতে পারলে খুব ভাল হতো, সব ছিল খুব সস্তা। কিন্তু সে দ্রুতই উত্তর দিল তখন তো খুব যুদ্ধ হতো, ঐ সময় সে যেতে চায় না।
সবকিছু বুঝতে চাওয়া তার স্বাভাব, এজন্য প্রচুর প্রশ্ন করে সে আমাকে। তার শিশু-সুলভ প্রশ্নগুলি আমিও চেষ্টা করি সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু ইদানিং তার কিছু প্রশ্ন নিয়ে খুব বিব্রত হতে হচ্ছে। কয়দিন আগে সে জানতে চাইল, পুলিশ কি সব সময় সরকারী দলে থাকে? প্রশ্নটা কঠিন। রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল (তথা সরকারী দল) ভিন্ন ভিন্ন স্বত্তা সেটা বুঝবার ক্ষমতা কি তার হবে? যারা ক্ষমতায় থাকে, রাজনীতির অভিজ্ঞতা লব্ধ হয়ে যারা কেশ পাকিয়েছেন তারাই এর পার্থক্য বুঝে বলে মনে হয় না, আর আট বছরের বাচ্চা এটা কিভাবে বুঝবে? আরেক দিন সে জানতে চাইল, হরতাল কেন দেয়? আমরা স্কুলে যেতে পারিনা, সেটা কি ওরা বুঝে না? আরেকদিন জিজ্ঞেস করল হরতালে বাস চালানো মানা তাইলে বাস বন্ধ করে রাখলেই হয়, আগুল লাগিয়ে দেয় কেন? তাহলে তো হরতালের পরেও আর ঐ বাস চলতে পারবে না, তখন মানুষ কিভাবে যাবে? এ ধরনের প্রশ্ন থেকে তাকে থামানোর একটাই উপায়- ধমক দেয়া, কারন উত্তরটা আমারও জানা নাই। আমিও তাই করি, ধমক দেই, এত প্রশ্ন না করে পড়াশুনা কর, বড় হলে সব বুঝতে পারবে।
আসলে ওদের জন্ম যখন বাংলাদেশ বুঝতে তো হবেই। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের আন্দোলন ছিল রক্তাক্ত কিন্তু প্রত্যশা ছিল স্বৈরাচারের পতনের পর গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে শান্তি ও উন্নতির সুবাতাস বইবে। যমুনার উপর বংগবন্ধু সেতু চালু হবার সময় ভেবেছিলাম আর কোন দিন হাইওয়েতে ট্রাফিক জ্যাম হবে না, কিন্তু নিয়তির খেল, প্রত্যেক বছর ঈদে বাড়ি যাবার সময় জ্যাম পাওয়া যায়। তেমনি এরশাদ পতনের পর মনে হয়েছিল আর হয়তো কোন দিন হরতাল দেখতে হবে না, আমাদের বাচ্চারা হরতালের গল্প শুনবে শুধুমাত্র, দেখতে হবে না কিভাবে সাধারন মানুষকে বলি দেয়া হয় স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতার রাজনীতিতে। আমর আশা করেছিলাম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আমারা শুধু সামনেই এগিয়ে যাব, আমাদের অগ্রগতি দেখে এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রবে। কিন্তু আমাদের সে আশা পুরণ হয়নি। গণতান্ত্রিক সরকারের লেবেলে আমরা প্রতিনিয়ত দেখেছি হরতাল, সংসদ বর্জন, মানুষ হত্য আর লাশের রাজনীতি। আমারা কোন জাতীয় ইস্যুতে দুই দলকে এক হতে দেখিনি (অবশ্য সাংসদদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি আর শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনা ছাড়া)। আজকে যে শিশু তারা যখন বাবা হবে, তাদের সন্তান কেও হয়ত শিখাতে হবে কিভাবে হরতাল-অবরোধ মোকাবিলা করে বেচে থাকতে হয়। আমাদের এই দেশে ঘুর্ণিঝড়, সাইক্লোন, বন্যা যেমন অনিবার্য, তেমনি অনিবার্য রাজনৈতিক সংঘাত-হরতাল-অবরোধ, দোষারোপ আর লাশের রাজনীতি। অদ্ভুত এক বিভাজিত জাতি আমরা, যেখানে যুক্তির চেয়ে আবেগ বড়, সামনে যাবার চেয়ে যেন পিছনের দিকে যাওয়ায় যেন আকাংখিত!!
একজন সুস্থ মানুষ সাধারনত ভাবে না যে সে অসুস্থ্য হতে পারে কিম্বা একদিন মারা যাবে। কাছের আত্মীয় কিম্বা বন্ধুকে কবর দিয়ে এসেই আমরা চলে যাই ব্যাবসায়িক মিটিং-এ।আরো সম্পদ কামাই করবার চেষ্টায় রত থাকি। আরেকজনকে অসুস্থ হতে দেখি কিম্বা মারা যেতে দেখি, সাময়িক একটা দুঃখবোধ হয়ত হয় কিন্তু নিজকে ঐ জায়গায় বসিয়ে চিন্তা করবার মত সময় হয় না। ব্যাবসা-মিটিং-কাস্টমার-টাকা আমাদের তা ভুলিয়ে রাখে।
তেমনি ক্ষমতা যে একবার পায় সেও ভাবতে পারেনা যে তার ক্ষমতা কোন দিন শেষ হবে। নমরুদ-ফেরাউন তো ক্ষমতার জোরে নিজকে খোদা বলে ঘোষনা দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা অপদস্থ হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাদের রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে। মোগল বাদশা হুমায়ন তারই নিযুক্ত বাংলার গভর্নর শের খানের কাছে পরাজিত হয়ে বছরের পর বছর পথে পথে ঘুরেছেন, সর্বদা শত্রুর তাড়ার মুখে মৃত্যুর ছায়া সাথে করে কখনো বনে-জংগলে কিম্বা বিরান ভুমিতে লুকিয়ে, কখনও কারো আশ্রয়ে আশ্রিতের মত লুকিয়ে দিন পার করেছেন (তিনি অবশ্য পরে রাজত্ব পুণরুদ্ধার করেছিলেন)। বৃটিশরা দুনিয়াজোড়া রাজত্ব পেতেছিল, বলা হতো বৃটিশ সাম্রাজ্যে সুর্য অস্ত যায়না। সেই কলোনি গুটিয়ে তারা আবার প্যাভিলিওনে ফিরে গেছেন। ছলে বলে ক্ষমতা নিয়েও মীর জাফর তা ভোগ করতে পারেন নি বরং বিশ্বাসঘাতকার সমার্থক হয়ে ঘৃণার পাত্র হয়ে আজও বাংলার ঘরে ঘরে বেচে আছেন। সহস্র-অযুত মানুষের ওপর সীমাহীন অত্যাচার করেও কমুনিষ্টরা তাদের স্বপ্নের সোভিয়েত ইউনিয়নকে টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
উপরের সবগুলি ঘটনায় ইতিহাসের অংশ। কিন্তু ক্ষমতার মোহ মানুষকে ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়। যিনি বিরোধী দলে থাকতে কেয়ারটেকার সরকারের জন্য আন্দোলন করেন তিনিই ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করেন। যিনি নিজকে জনগনের নেত্রী মনে করেন, জনগন কে ক্ষমতার উতস বলে মুখের ফেনা তুলে ফেলেন তাকেই দেখি পুলিশ লেলিয়ে বিরোধী মত দমন করতে। যিনি ক্ষমতায় থাকলে বিরোধী দল কেন সংসদে আসেনা বলে অভিযোগ করেন তিনি বিরোধী দলে গেলে টানা সংসদ বর্জন করেন। আজকে যারা পুলিশকে ফ্রাঙ্কেস্টাইন বানাচ্ছেন, এই দৈত্য একদিন তাদের ঘাড়ই ভাংবে, ইতিহাস কিন্তু সে কথায় বলে। তারপরও আমারা পুলিশ কে দৈত্য বানাচ্ছি, বিচারবিভাগে নগ্ন হস্তক্ষেপ করে এর ইন্টিগ্রিটি নষ্ট করছি। নিজের দলের জনসভায় বিশাল উপস্থিতি দেখে ভুলে যাচ্ছি এই দেশের মানুষ ষোল কোটি। কোন দলের লাখ জনের সমাবেশ কিম্বা ফেসবুকের কয়েক হাজার লাইক এদেশের আপামর জনগনের প্রতিনিধিত্ব করে না।
এই নতুন শতাব্দীতে এসে আমরা নতুন পথের দিশা চাই। বিভাজন নয়, ঐক্য চাই। গণতান্ত্রিকতার চর্চা চাই। পরিবারতন্ত্র থেকে বের হয়ে এসে জন কল্যাণমুখী নেতৃত্ব চাই। দারিদ্র থেকে মুক্তি চাই। সর্বোপরি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত বাংলাদেশ রেখে যেতে চাই। সেটা সম্ভব যদি আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি।
কিন্তু সেদিন কি আসবে? স্বপ্ন দেখতেও আজকাল বড় ভয় লাগে। কারণ ইতিহাসের বড় শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহন করে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন