সাপ্তাহিকী
|
মোহাম্মদ সফিউল আলম
|
|
কাল রাতে আমি অনেক কেঁদেছিলাম
09 Mar, 2013
কান্নাকাটি বরাবরই আমার অপছন্দনীয় ছিলো। আমি সব সময়ই ভাবতাম কান্না হচ্ছে দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। পুরুষ মানুষ কাঁদবে কেন? কোন কারণেই সহজে আমার কান্না আসতো না। বরং কান্নার প্রতি আমার মনে কেমন যেন একটা ঘেন্না ঘেন্না ভাব সর্বদাই বজায় ছিলো। কেউ কেউ সামান্য ব্যাপারেই কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। এ রকম অবস্থা দেখলে বরং আমার কেবলই হাসি পায়। উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় আমরা দু’বন্ধু কলেজ হোস্টেলে থাকতাম। এক দিন খবর এলো, আমার বন্ধুর ভাল-লাগা মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। খবর শুনে বন্ধুটি আমাকে জড়িয়ে ধরে সেদিন অনেক কেঁদেছিলো। ওর কান্না থামাতে গিয়ে আমারতো গলদঘর্ম অবস্থা। সামান্য একটি মেয়ের বিয়ের খবর শুনে সতের বছরের এক তরুণকে এভাবে অসহায়ের মত কাঁদতে দেখে আমার শুধুই হাসি পাচ্ছিলো। সেদিন আমি অনেক কষ্টে হাসি সম্বরণ করেছিলাম।
কিন্তু কাল রাতে আমি অনেক কেঁদেছিলাম।
কাল ছিলো ওর আলো ঝলমলে মেহেদি রাত। আর আমার পৃথিবীতে অনিবার্য এক কাল বৈশাখীর অমাবস্যা রজনী। ওর সাথে পরিচয় হয়েছিলো তিন বছর আগে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিনের ক্লাশে। আমাদের প্রথম ক্লাশের শিক্ষক নিজের পরিচয় দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নাম-পরিচয় জেনে নিচ্ছিলেন। পরিচয় পর্বের কোন এক শুভক্ষণে আমাদের চোখাচোখি হয়েছিলো। সেই থেকে শুরু। তারপর থেকে গত তিন বছরে নিজেকে ওর জন্য একেবারে অপরিহার্য করে তুলেছিলাম। আমাদের সম্পর্ক ছিল নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে। আমরা হয়ে উঠেছিলাম একে অপরের হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ। ভাব বিনিময় আর কথা বলার অনিবার্য সঙ্গী। সুখ-দুঃখ শেয়ার করার বিশ্বস্ত আপনজন। কিন্তু বড় কোন সম্পদের অধিকারী হবার পর তা রক্ষা করার যোগ্যতা যদি মালিকের না থাকে তাহলে সে সম্পদ একদিন হাত ছাড়া হয়ে যায়। ওকে নিজের করে ধরে রাখতে না পারার জন্যও আমার নিজের অযোগ্যতাই দায়ী। যাঁর সাথে ওর বিয়ে হচ্ছে তিনি ধনীর দুলাল, বেসরকারী ব্যাংকের মোটা বেতনের কর্মকর্তা। আর আমিতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, মাত্র অর্থনীতিতে অনার্স থার্ড ইয়ারে অধ্যয়নরত এক বেকার যুবক। পড়ালেখার খরচ যোগানোর জন্য যাকে নিয়মিত টিউশনি করতে হয়। ওর মত ধনীর দুলালী সুন্দরীকে আজীবনের জন্য নিজের করে ধরে রাখার যোগ্যতা আমার কোথায়?
ও ছিল আমার প্রত্যাশা, প্রেরণা আর সমস্ত ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। আমার সারাদিনের বিনোদন। ওকে ঘিরে আমি সাজিয়েছিলাম আমার ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো। অথচ এখন থেকে ওর সাথে আমার সমস্ত যোগাযোগ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। আমার সাজানো স্বপ্নগুলো এলোমেলো হয়ে যাবে। ব্যাপারটা ভাবতেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ভেতরের সব কিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হয়? আনন্দের দিনগুলোকে মাটি করে দিয়ে কেন এত কান্নার আয়োজন হয়? আমারতো কোন দিন এত কান্না পায় নি। আজ কেন দুনিয়া ভেঙ্গে কান্না পাচ্ছে ? মাঝে মাঝে ইচ্ছে হচ্ছে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সকল যন্ত্রণার অবসান করি। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারের দায়িত্বশীল বড় ছেলের এত আবেগ প্রবণতা শোভা পায় না। আমার আত্মহত্যার সাথে মৃত্যু হবে আরো অনেকের। মৃত্যু হবে মধ্যবিত্তের অনেক স্বপ্নের, অনেক প্রত্যাশার। তাছাড়া আত্মহত্যাকেতো আমি সব সময়ই ঘৃণার চোখে দেখেছি। আত্মহত্যার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন সমাধান নেই। কোন বিজয় নেই। আত্মহত্যাতো চরম আত্ম অবমাননা। আত্মহত্যা করার জন্যতো আমাকে সৃষ্টি করা হয় নি। আমার সৃষ্টিতো আত্ম বিকাশের জন্য। কিন্তু মাথার ভেতরের ভাবনার ঝড়টা কোনভাবেই থামছে না। কত কথাই না মনে পড়ছে! কত স্মৃতিই না ভেসে উঠছে মনের পর্দায়! এই ছাদে শুয়ে শুয়ে কত রাত কাটিয়েছি। জোছনার বন্যায় ভেসেছি। তারাদের মিটি মিটি হাসি দেখেছি। আকাশের বিশালতায় নয়ন জুড়িয়েছি। উপভোগ করেছি আঁধারের রূপ। অথচ আজ কোথাও কোন সৌন্দর্য নেই। কোন আকর্ষণ নেই। তারাগুলো যেন আজ একেকটা ভয়ংকর অগ্নিপিন্ড। চারিদিকে বীভৎস আঁধার। আকাশটা আজ শুধুই বিশাল শূণ্যতায় ভরা, সুবিশাল হাহাকারে ঘেরা। যতই বুঝতে পারছি সেই আনন্দের মুহুর্তগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না ততই কান্নার বেগ প্রবল হচ্ছে। চোখ ফেটে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে বুকের ভেতরের দুঃখগুলো। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। মুহুর্তেই অনুভব করলাম, কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লবণাক্ত জলের ধারা। আমি কান্নার কাছে নিজেকে সমর্পন করলাম। অঝোরে কাঁদলাম অনেক্ষণ। কাঁদলে নাকি দুঃখের উপসম হয়। ঘন কালো মেঘগুলো বৃষ্টির ধারায় ঝরে গিয়ে যেভাবে আকাশটাকে পরিষ্কার করে সেভাবে মনের উপর চেপে থাকা দুঃখের পাথরটি গলে গলে অশ্রুর ফোঁটায় ফোঁটায় যদি বেরিয়ে যায়, যাক না। তাতে যদি মনটা হালকা হয়! চরম আনন্দের সময়ওতো কারো কারো চোখ ছল ছল হয়ে উঠে। কাংখিত বিজয় কিংবা পরম পাওয়ার আনন্দ সমস্ত সীমানা ছাড়িয়ে প্রকাশিত হয় চোখের জলের ভাষায়। কান্নাতো এক শক্তিশালী ভাষা। যার রয়েছে বহুমুখী প্রকাশ ক্ষমতা। কান্নার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় আনন্দ-বেদনা-প্রতিবাদ-প্রয়োজন-প্রত্যাশা-ভালবাসা। কান্নাতো মানুষের আজন্ম সঙ্গী। কান্না মানব শিশুর প্রথম ভাষা। জন্ম মাত্রই কান্নার সুতীব্র চিৎকারে নবজাতক পৃ্থিবীতে নিজের আগমন বার্তা ঘোষণা করে। আর আমি আজ চোখের জলের নীরব ভাষায় বিদায় জানাব আমার প্রিয়তমাকে। বড় প্রেম নাকি শুধু কাছে টানে না, অনেক সময় দূরেও ঠেলে দেয়। শরৎ বাবুর সেই বিখ্যাত কথাটাই আজ আমার জীবনে রূঢ় বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রেমতো সত্যিই বড় প্রেম ছিলো। যা আমাদেরকে একে অপরের খুব কাছে এনেছিলো। আবার দূরেও ঠেলে দিলো। তাইতো দু’জনার দু’টি পথ দু’টি দিকে বেঁকে গেলো।।
আমরাতো ইচ্ছে করলে পালিয়ে বিয়ে করতে পারতাম। কিন্তু ওভাবে ক’দিন ওকে নিজের করে ধরে রাখতে পারতাম......? আমরা কোথায় গিয়ে উঠতাম......? কি হতো আমার স্বপ্নের, আমার প্রত্যাশার......? মধ্যবিত্তের জীবনে ওসব নাটকীয় চিন্তা একেবারেই বেমানান। তাতে বরং দু’জনের জীবনই বিভীষিকাময় হয়ে উঠতো। যে কান্ড করলে নিজের এবং প্রিয় মানুষটির চরম ক্ষতি হয় তাতে ভালবাসার অপমান হয়। যাতে উভয়েরই কল্যাণ নিহিত সেটাই ভালবাসাকে মহিমাম্বিত কিরে। নিজের বিবেকের সাথে অনেক বোঝাপড়া হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। নিজের ভিতরেই চলেছে ঝড়। কাউকে কিছু বুঝতে দেই নি। দিনের পর দিন আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভেবেছি। নিজেকে নিজেই বুঝিয়েছি – ও আমার জীবনাকাশের ধুমকেতু। উদিত হয়েছিলো, আমি পেয়েছিলাম। দূরাকাশে মিশে গেলো, আমি হারালাম। তাই আমার আজকের এই কান্নার আয়োজন। যা অনিবার্য তাকে মেনে নেয়াই শ্রেয়। অশ্রুর ফোঁটায় ফোঁটায় আমাকে খুঁজে নিতে হবে অন্য রকম সান্ত্বনা। অন্যের কান্নাকাটি নিয়ে নিজে কত হাসিঠাট্টা করেছি। কত জনকে ব্যঙ্গ করেছি। আজ আমার চোখের জলের আয়োজন করে প্রকৃতি হয়তো তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে। দ্রুতগামী যে ট্রেনকে থামানো অসম্ভব তার সামনে দাঁড়ানো চরম বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। বরং ট্রেনটির শুভযাত্রা কামনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমি সেটাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনিবার্য এক পথিকের পথের কাঁটা না হয়ে চোখের জলে ওর যাত্রাপথ মসৃন করাই নিজের নিয়তি বলে মেনে নিলাম।
কাল রাতে আমি অনেক কেঁদেছিলাম।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন