সাপ্তাহিকী
|
এস এম মুকুল
|
|
অফুরন্ত সম্ভাবনার বাংলাদেশ : আমরাও পারব
02 Mar, 2013
অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। কী নেই আমাদের। বাংলাদেশের মাটির নিচে লুকিয়ে আছে সম্পদের বিশাল ভা-ার। তেল, গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, তামা, লোহা, গন্ধক, নুড়িপাথর, শক্ত পাথর, বালি এসব অফুরন্ত সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলেই হলো। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ থেকে ক্রমেই শিল্পনির্ভর দেশে পরিণত হচ্ছে। দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ছাড়াও গড়ে উঠছে অসংখ্য বৃহৎ শিল্প। গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ২২ লাখ শ্রমিকসহ অন্তত দুই কোটি লোকের। পর্যটন শিল্পে রয়েছে বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনা। আমাদের আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। আছে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য, স্থাপনা, ঐতিহ্যজড়িত পর্যটন স্পট রয়েছে দেশজুড়ে। পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে অনেক শিল্প, অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। জনশক্তি রপ্তানি আরেক সম্ভাবনাময় খাত। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৫০ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষ খুব শান্তিপ্রিয়। তারা কাজ করে একটু শান্তিতে থাকতে চায়। কাজেই আমাদের সম্ভাবনার ক্ষেত্র তো অনেক বড়। দেশের মোট জলাশয় ৪৪.৪ লাখ মেট্রিক টন। প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয় চাঁচড়া মৎস্যপল্লীতে। দেশের ১ কোটি ২০ লাখ লোক মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। দেশে ইলিশের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২ লাখ টন। ইলিশের বার্ষিক বাজারমূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। ইলিশ আহরণে ৪-৫ লাখ জেলে পূর্ণ ও খ-কালীন এবং ২০-২৫ লাখ লোক বিপণন ও অন্যান্য কাজে জড়িত। বিকশিত হচ্ছে আবাসন শিল্প। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ লোকের। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশ ক্রমে রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিশ্ব বাজারে স্থান করে নিয়েছে ওষুধ শিল্প। গত ১০ বছরে এই শিল্প থেকে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫ গুণ। আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় ৬৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ।
আমাদের দেশ থেকে স্বাধীনতার পর মানুষের চুল, তামাক খাবার হুক্কা, পশুর হাড়, পশুর বর্জ্য, তেঁতুলের বীচির মতো অনেক অপ্রচলিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হতো। এখনো অনেক নতুন নতুন অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রচলিত পণ্যের সঙ্গে ব্যাপকভাবে অপ্রচলিত পণ্যের সংখ্যা বাড়ছে। চা, চামড়া, সিরামিক থেকে শুরু করে মাছ, শুঁটকি, সবজি, পেয়ারা, চাল, টুপি, নকশিকাঁথা, বাঁশ-বেত শিল্পের তৈরি পণ্য, মৃৎশিল্প রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমান যুগ কম্পিউটারের যুগ। বিশ্বব্যাপী এখাতে বছরে যে সম্ভাবনা রয়েছে তা আমাদের এক বছরের বাজেটের চেয়েও অনেক বেশি। প্রতি বছর এখাতে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর প্রায় ৫৫ মিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার এবং ডাটা এন্ট্রি কাজ এশিয়ার দেশগুলোর সাহায্যে করে থাকে। বাংলাদেশ সবেমাত্র সফটওয়্যার, ডাটা এন্ট্রি বাজারে প্রবেশ করছে। এত গেল সম্পদের সম্ভাবনার কথা। এবার বলি আমাদের মেধাশক্তি আর উদ্যোক্তাদের সাফল্যের কথা। রেলগাড়ির আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম উদ্ভাবন করেছে দশম শ্রেণীর ছাত্র শাহাবুদ্দিন ভূঁইয়া সামি। সামির এই ইলেক্ট্রিক সিস্টেমে ট্রেন তার নিজস্ব গতিতে নির্দিষ্ট স্টেশনে থামবে। রেলগেট বা ক্রসিংগুলোতে কোনো সিগন্যাল ম্যান লাগবে না, রেলগেট বা ক্রসিংয়ের কাছাকাছি ট্রেন আসতেই বাজবে অ্যালার্ম। সাইকেল মেকানিক সোলেমান তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্রের উদ্ভাবক! কম পয়সায় পুরনো সোলার প্লেট কিনে সূর্যের আলোয় অবিরাম তাপ ধারণ করে বিদ্যুৎ তৈরির সূত্র উদ্ভাবন করেন তিনি। দেশীয় প্রযুক্তিতে ড্রামের পাত্রে জারকিন ডুবিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি হয় তাপবিদ্যুৎ। তিনি ৫০০ থেকে ৫ হাজার ওয়াট বিদ্যুৎ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আইপিএস বানাতে পারেন। যশোরের হান্টু একক প্রচেষ্টায় আবিষ্কার করেছেন মাছের নার্সারি, পুকুরে সাশ্রয়ী খরচে অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র। এই যন্ত্রে প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে ৯২ শতাংশ কম সময়ে এবং ৮৫ শতাংশ কম ডিজেল বা বিদ্যুৎ খরচ বাঁচিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ সম্ভব। বায়ু সঞ্চালক এ যন্ত্রটি যশোরের চাঁচড়ার সোনালি মৎস্য হ্যাচারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের সেনাবাহিনীর পরিচালনাধীন বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি ডুয়েল ফুয়েল ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেছে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে ২০ ভাগ ডিজেল মিশিয়ে ইঞ্জিনটি চালানো যাবে। এই পদ্ধতি ৬৫ ভাগ জ্বালানি সাশ্রয় হবে। গোপালগঞ্জ জেলার মেকানিক সিমসন সাহা শিমু উদ্ভাবন করলেন প্যাডেল চালিত পানি সেচ মেশিন। এই প্রযুক্তিতে ডিজেল বা বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। বাইসাইকেলের মতো প্যাডেল ঘুরানোর মাধ্যমে খাল, নদী থেকে ইরি-বোরো জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব। এতে ডিজেল ও বিদ্যুৎ খরচের টাকা বাঁচবে, বায়ু বা শব্দ দূষণের কোনো সম্ভাবনাও নেই। পল্লী চিকিৎসক আবুবকর সিদ্দিক উদ্ভাবন করলেন ওয়াটার ওয়েট পাওয়ার মেশিন। জ্বালানি বিদ্যুৎ ছাড়াই এই মেশিনের সাহায্যে সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমবে। এ যন্ত্রটি স্যালো মেশিন থেকে ৩৪০ আরপিএম বেশি। এ কারণে যন্ত্রের মাধ্যমে পানি উঠবে বেশি। নিরক্ষর কৃষক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ওরফে কেনু মিস্ত্রি কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য স্বল্পমূল্যে ৩২টি কৃষি যন্ত্র আবিষ্কার করে কৃষকদের মাঝে আশার সঞ্চার করেছেন। তার তৈরি যন্ত্র দিয়ে কম সময়ে অধিক পরিমাণ জমিতে সহজে কাজ করা যায়। কেনু মিস্ত্রি প্রতিবেশি কৃষকদের মাঝে প্রায় চার হাজার যন্ত্র তৈরি করে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। আরো আছে কত খবর। আমাদের নিরক্ষর কৃষক হরিপদ কাপালি আবিষ্কার করলেন অধিক কম সময়ে ফলনযোগ্য হরিধান। আবিষ্কার উদ্ভাবনে অনেক এগিয়ে আমাদের তরুণরা। আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে- টেলি কন্ট্রোল ওভার জিওগ্রাফিক, ভয়েস অ্যাক্টিভেট ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস, ভয়েস অ্যান্ড ভিজ্যুয়াল কমান্ড কন্ট্রোল রোবট, হোম সিকিউরিটি সিস্টেম, টিভি ওভার ল্যান, সিমুলেশন অব ৮০৮৫ অ্যাসেম্বলি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোগ্রামিং কিট, পানির অপচয়রোধে প্রিপেইড মিটার, দূর নিয়ন্ত্রক রেগুলেটর, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবিষ্কার করেছে বুদ্ধিমান রোবট, ঢাকা আমেরিকান আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা আবিষ্কার করেছে যুদ্ধ রোবট। শরীয়তপুরের কৃষকের ছেলে উদ্ধাবন করল গ্যাসচালিত পাওয়ার পাম্প। এ ধরনের আবিষ্কার উদ্ভাবনের খবর প্রায়ই প্রচারিত হচ্ছে। আমরা এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবিষ্কার আর সাফল্যের আনন্দে উদ্বেলিত হই। এসবই যেন মেধাবি বাংলাদেশের প্রতিচিত্র।
এসব উদ্ভাবকদের মাঝেই আছে আশা জাগানিয়া সম্ভাবনা। ভাবতে অবাক লাগে, কত বিচিত্র চিন্তাকে ফলপ্রসূ করে তুলছে আমাদের প্রত্যয়ী মেধাবীরা। নিজেদের চেষ্টায় সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নিরলস কাজ করছেন তারা। মেধা, সাহস আর চেষ্টাই তাদের একমাত্র শক্তি। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এসব মেধাবীদের যোগ্যস্থানে যেতে দিচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সমন্বয় থাকলে এসব মেধাকে কাজে লাগিয়ে ছোট ছোট উদ্যোগের সাফল্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত সোনার বাংলাদেশ। এতে কোনো বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন নেই। দিকনির্দেশনা আর সহযোগিতা পেলে দেশের মানুষই গড়বে দেশ। এখন প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্বের। সম্পদ আর মেধার সম্ভাবনাকে কাজে লাগালেই আমাদের আরো সাফল্য আসবে। ছোট বড় ব্যবসায়ের ক্ষেত্র বাড়ানোর পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্পের প্রতি যুবকদের আকৃষ্ট করতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, দিকনির্দেশনা, মনিটরিং এবং ব্যাংক লোন সুবিধা দেয়াটাও জরুরি। একইসঙ্গে দেশের শিল্প-উদ্যোক্তাদের শিল্প সম্প্রসারণের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। দিতে হবে সহায়ক পরিবেশ এবং ব্যাংকিং সুবিধা। তাহলেই দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দেশীয় সম্ভাবনাময় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এতে সরকারের ওপর থেকে কর্মসংস্থানের চাপ কমবে। রাজস্ব আয় বাড়বে। সুতরাং আমাদের আছে সুযোগ, আছে সম্ভাবনা। এখনই এই সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে আমরাও পারব সমৃদ্ধি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।
এস এম মুকুল: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন