সাপ্তাহিকী
|
শেখ আখতার উল ইসলাম
|
|
জাগ্রত বিবেকে মূখরিত শাহবাগ স্কয়ার
23 Feb, 2013
মানবতা বিরোধি অপরাধে যুদ্ধাপরাধির ফাসি এবং ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে সম্প্রতি রাজধানীর শাহবাগ স্কয়ার জাগরণ মঞ্চে এক অসাধারন সমাবেশ চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় অনুরূপ সমাবেশ থেকে একই দাবী আবার ও আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল বাংলাদেশ এখনও হারিয়ে যায়নি। একজন আইনজীবী হিসাবে বিচারের রায় নিয়ে এই মূহুর্তে আমি কথা বলতে চাইনা কেননা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীলের সূযোগ রয়েছে এবং চুড়ান্ত ভাবে বিষয়টি এখন ও মিমাংসিত হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে দেশের রাজনীতির আকাশে দুর্যোগের ঘনঘঠায় আমি কিছুটা আশঙ্কিত। আর আমার আশঙ্কার মূল কারন কয়েকদিন পূর্বে মতিঝিলের জামাতের সমাবেশ থেকে নায়েবে আমীরের গৃহযুদ্ধের ঘোষনা? যে সমাবেশের প্রহরায় নিয়োজিতদের জামাত ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। আমার আশঙ্কার অন্যতম কারন কিছুদিন পূর্বে আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থানকারী রাষ্ট্রের প্রতিনিধির জামাতের সাথে সমোজতার আহ্বান? আমি উদ্বিগ্ন বাংলাদেশকে নিয়ে কি আবার নতুন কোন খেলা শুরু হতে যাচ্ছে? আমি উৎকন্ঠিত বর্তমান দুর্বিত্তায়িত ক্ষমতার রাজনীতি আতাত, চক্রান্ত আর ষঢ়যন্ত্রের জাল বিস্থার করে হীন স্বার্থ উদ্ধারে তৎপরতায় মেতে উঠে কি না? আমার বিশ্বাস জাগ্রত বিবেকে মূখরিত শাহবাগ স্ড়্গোয়ার এর জাগরণ মঞ্চ অচিরেই আমাকে এবং আমার মত দূর্বল চিত্তের অধিকারীদের আশ্বস্ত করবে। কেননা ঘর পোড়া গরু সিদূরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।
বাংলাদেশ- যার জন্ম হয়েছিল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, পাকিস্তান নামক এক অস্বাভাবিক ধর্ম রাষ্ট্রের বুক চিরে। দীর্ঘ দুই শত বৎসর শাসন-শোষন-নিপীড়ন-নির্যাতন শেষে বেণীয়া ইংরেজরা যখন বুঝতে পারল যে ভারতবর্ষকে আর শাসন করা সম্ভব নয়, তখন দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে তারা দ্বি-খন্ডিত করে দিয়ে যায় ১৯৪৭ সালে। চক্রান্ত আর ষঢ়যন্ত্রের ফাদে হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সভ্যতা আর সাংস্ড়্গৃতি দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়ে। ভাই এ ভাই এ হিংসা-বিদ্ধেষ আর হানা হানি শুরু হয়ে যায়। সমগ্র ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। ধর্ম রাষ্ট্র কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকে থাকতে পারেনি। তবে গঙ্গা, কাবেরী, পদ্মা, মেঘনা আর যমুনায় রক্তের বন্যা বয়ে যায়। ইতিহাস তার জ্বলন্ত স্বাক্ষী। তার পর বায়ান্ন থেকে উনসত্তুর স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন। উরসত্তুরের গণ অভ্যূত্বান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে লক্ষ কোটি প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় আজকের- বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালোরাত্রিতে ঘুমন্ত অসহায় মানুষের উপর যখন পাকিস্তানী হায়েনার দল ঝাপিয়ে পড়েছিল, মানুষের আর্তনাদে আল্লা’র আরশ পর্যন্ত সেদিন যখন কেপে উঠেছিল। মসজিদ, মন্দির গীর্জায় আশ্রয় নিয়ে ও মানুষ যখন হায়েনার হিংস্র ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। কার্ফু জারী করে, ঘরে ঘরে তাল্লাশী করে মা-বোনদের ধরে এনে তারা যখন নির্যাতন করেছিল। খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর লুঠতরাজ করে তারা যখন এক নারকীয় -ভীবৎস- তান্ডবলীলা সৃষ্টি করেছিল। চক্রান্ত-ষঢ়যন্ত্রকারী মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক বাঙ্গালী কুলাঙ্গার, নরপশু ধর্মের নামে মানবতাবিরোধি এসকল অপরাধে পাক হানাদার বাহিনীকে তখন ও সহায়তা করেছিল। নরাধম পশুদের আক্রমনে আর অসহায় , নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের আর্তনাদে সে দিন তাদের উপর আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছিল। ফলে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে তাদের চরম পরাজয় ঘঠে। আল্লাহর আশির্বাদেই অস্বাভাবিক ধর্ম রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবরের উপর জন্ম নেয় স্বাধীন- সার্বভৌম- অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ।
খুন, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজ আর মানবতাবিরোধি অপরাধী ও তাদের সহায়তাকারী নরপশুদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সনেই প্রণীত হয় দালাল আইন। দালাল আইনে বিচার ও শুরু হয়, এমনকি কয়েকজনের সাজা-শাস্থি ও হয়। সে সময় দালালদের অনেকেই দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেচে যায়। আর যারা পালাতে পারেনি তাদের ধরে এনে জেলে বন্ধি করা হয়। এমনকি জনতার রোষানলে পড়ে তাদের অনেকেই মারা ও পড়ে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন ধ্বংশ যজ্ঞ থেকে উঠে আসতে প্রাণ পণে কাজ করছে। এমনি মূহুর্তে হিংসা বিদ্ধেষ ভূলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ পূণঃগঠনে সকলকে অংশ গ্রহণের সুযোগ দিতে দালাল আইনে কিছু সংস্ড়্গার সাধন করা হয়। হত্যা, খুন, ধর্ষন, লুঠতরাজ ও বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগের মত গুরুতর অপরাধের জন্য কোন সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করা হয়নি। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আইনটি প্রত্যাহার করে নেন। ফলে এ সকল অপরাধিরা ছাড়া পেয়ে যায় এবং রাজনীতিতে পূণর্বাসিত হয়ে চক্রান্তকারীরা আবার ধর্মীয় রাজনীতি শুরু করে। বাংলাদেশ পূণরায় পাকিস্তানের পথে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তারা তৎপরতা শুরু করে। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তার পর থেকেই হারিয়ে যায়।
২।
স্বাধীনতার পরাজিত শত্রু আর তাদের দেশী-বিদেশী সহযোগী চক্রান্ত আর ষঢ়যন্ত্রকারীরা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টের পর থেকে এ ভাবেই বাংলাদেশকে পূণরায় পাকিস্তানের পথে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু মহান স্রষ্টা অল্লাহ বলেছেন- “ তাহারা ষঢ়যন্ত্র করে আর অল্লাহ ও কৌশল করেন, আর আল্লাহই কৌশলীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট।” (সূরা-আনফাল, আয়াত-৩০) এবং অবশেষে আল্লাহর কৌশলই বিজয়ী হয়। বায়ান্ন, চোয়ান্ন, একাত্তর আর নব্বই এর বিজয়ী যুদ্ধারা আবার ও সাফল্য ফিরে পায়। ২০০৮ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর এক ঐতিহাসিক গণরায় নিয়ে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী দল পূণরায় রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধির বিচার আর বাহাত্তরের সংবিধান পূনরুদ্ধারের ম্যান্ডেট নিয়ে নিরঙ্কুষ সংখ্যা গরিষ্টতায় ক্ষমতায় ফিরে আসে স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয় যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের বিল। আর মানবতাবিরোধি-যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের জন্য গঠিত হয় অন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল। দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর পর জাতি পাপ মুক্ত হওয়ার আশার আলো দেখে। কিন্তু রাজনীতির দুর্বিত্তায়ন, চক্রান্ত আর ষঢ়যন্ত্রের নীল নকশায় সে আলো আজ আবার নিবে যেতে বসেছে।
মানবতাবিরোধি অপরাধের জন্য গঠিত ট্রাইবুন্যাল থেকে প্রথম অপরাধী হিসাবে পলাতক আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের মৃত্যু দন্ড ঘোষনা করা হয়। তার পর দ্বিতীয় অপরাধি আব্দুল কাদের ওরফে কসাই কাদের এর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষনা করার পরই রায় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। জামাত রায় ঘোষনার তারিখ থেকেই হরতাল, অবরোধ ও ভাঙ্গচুর শুরু করে। অপরদিকে কসাই কাদের সহ অপরাপর যুদ্ধাপরাধির ফাসির দাবীতে ও ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে সাধারন মানুষের ব্যানারে তরুণ প্রজন্ম আন্দোলন শুরু করে। সর্বশেষ শাহবাগ স্ড়্গয়ারে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েতে থেকে যুদ্ধাপরাধিদের ফাসি এবং ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষনার দাবী নতুন করে আজ মানুষের সামনে আলোকবর্তীকা রূপে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে নানা ষঢ়যন্ত্র ও শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে আন্দোলনকারীরা কি তাদের আন্দোলনের গতি পথ ঠিক রেখে চুড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে? নাকী দুর্বিত্তায়িত ক্ষমতার রাজনীতির চোরাবালীতে হারিয়ে যাবে তাদের আন্দোলন?
বাংলাদেশের সামনে আজ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। পরিবর্তনের লক্ষ্যে গোটাজাতি ঐক্যবদ্ধ ভাবে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আজ প্রস্তুত। শাহবাগ স্ড়্গয়ার আবার একাত্তরের চেতনায় জেগে উঠেছে। গর্জে উঠেছে বাংলাদেশ। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে ক্ষমতায় আজ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। মহান জাতীয় সংসদ এই মূহুর্তে সচল ও চলমান। ইতিহাসের এই মহেন্দ্র ক্ষণে জনগণের ম্যান্ডেট আর অদালতের নির্দেশ এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে পঞদশ সংশোধনী অবিলম্বে বাতিল করে বাহাত্তরের সংবিধানে পূণরায় ফিরে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। জামাত কে বাতিল করে ধর্মীয় রাজনীতি সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ ঘোষনা করার এখনই সময়। আইনের নিরপেক্ষ ও কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করে বিচারের রায় কার্যকরী করা এখনই সম্্ভব । যুদ্ধাপরাধ আর ধর্মীয় চেতনাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দিয়ে পবিত্র ধর্মকে অপরাজনীতির হাত থেকে রক্ষা করার এখনই উপযুক্ত সময়। কেননা যুদ্ধ অপরাধ মানবাতার বিরুদ্ধে অপরাধ- যুদ্ধ অপরাধ ধর্মের বিরুদ্ধে অপরাধ। জনগণের মাঝে সে সত্য আজ তুলে ধরতে হবে। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা হত্যা, ধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নি সংযোগ করেছে। যারা আমাদের মা-বোনের ইজ্জত হরন করেছে- তারা মুসলমান নয় তারা কাফেরের চেয়ে ও ভয়ঙ্কর এবং তাদের স্থান নিকৃষ্টতম জাহান্নাম। পবিত্র কোরা’ন শরিফের সুরা নিসা এর ৯৩ আয়াতে মহান অল্লাহ ঘোষনা করেছেন- “ কেহ ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তাহার শাস্থি জাহান্নাম।” অত এব দেশী -বিদেশী কোন অপশক্তির চক্রান্ত কিংবা চাপে মাথা নত করলে আল্লাহ ও আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের ভূলে কিংবা আমাদের হঠকারিতায় যদি এ আন্দোলন হারিয়ে যায় তবে তলিয়ে যাবে সমাজ সভ্যতা হারিয়ে যাবে বাংলাদেশ। ইরাক, আফগানিস্থান, বসনিয়া, হারজেগোভিনা, প্যালেষ্টাইন, সোমলীয়া ,ইথিওপীয়া, কিংবা পাকিস্তানে পরিনত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধা আর জাতীয় বীরেরা একটি সূখী, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, সুন্দর বাংলাদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। যে বাংলাদেশ পচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে আর খূজে পাওয়া যায় না। হারানো সে বাংলাদেশকে ফিরে পাওয়ার এখনই প্রকৃষ্ট সময়। শাহবাগ স্ড়্গয়ারের জাগ্রত বিবেকের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ফিরিয়ে দিতে পারে হারানো সে বাংলাদেশকে.
লেখক: আইনবিদ ও রাজনীতিবিদ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন