সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
সভ্য হবার মানসিকতা আমাদের তৈরী হবে কবে?
23 Feb, 2013
শিরোনাম দেখে ভুল বুঝবেন না দয়া করে। আমরা তো অবশ্যই সভ্য জাতি। এখানে উচু উচু দালান আছে, টয়োটার পাশাপাশি বিএমডাব্লিও-ভলভো গাড়ি আছে, দেশী-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বড় বড় মানুষ আছেন, পত্রিকা-টিভি-ইন্টারনেট-মোবাইল ফোন আছে, সভ্য হবার জন্য আর কি চাই?
তবুও কি যেন নেই!
ঢাকার রাস্তাগুলোর কথা স্মরন করুন। ম্যানহোল পরিস্কার করে ময়লা ঢিবি করে রাখা হয়েছে পুরো রাস্তা টুকু জুড়ে, রাস্তা গাড়ি-রিক্সা চলাচল বন্ধ। মানুষ কে হাটতে হয় ঝুকি নিয়ে। একবার পড়ে গেলে খবর আছে। এবং সেটা একদিনের জন্য নয়, যেটা একদিনের কাজ তা ঝুলে দুই মাস! এলাকার জন-প্রতিনিধি আছেন আর যে প্রতিসঠান এ কাজ করাচ্ছে(যেমন ওয়াসা) তাদের এসব জিনিস দেখভাল করার জন্য কর্মকর্তাও আছেন। জনগণের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করা ও প্রতিসঠানের দক্ষতার স্বার্থে কাজটি কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা করে সেভাবেই করা উচিত ছিল। এটি কি টাকার অভাব? মোটেও নয়, কারণ টাকা কিন্তু ঠিকই খরচ করি, অভাব মানসিকতার। সেই সভ্য মানসিকতাটি আমাদের কবে হবে?
বিভিন্ন কারনে রাস্তা খুড়তে হয়। কিন্তু একবার রাস্তা খুড়লে সে রাস্তা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। দেখা গেল রাস্তার একপাশ খুঁড়ে ড্রেনেজ পাইপ বসানো হয়েছে তারপর যে ভাবে ফিনিশিং দেয়া হয়েছে তাতে এটি এখন রাস্তার যোগ্যতা হারিয়েছে। অথচ ঠিকাদার কে কাজ দেবার সময় “রাস্তা আগের মত করে দিতে হবে” এরকম শর্ত দেয়া এবং তা নিশ্চিত করে বিল দিলেই এই সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু ঐ যে কারো কোন জবাবদিহিতাও নেই কিম্বা তথাকথিত আধুনিক -শিক্ষিত হয়েও সভ্য হবার মানসিকতা নেই!
হয়ত দেখা গেল রাস্তার বর্তমান অংশ আর ফুটপাথের মধ্যের অংশটুকুর বর্ধিত করার কাজ হচ্চে। ব্যাপারটা ভাল, রাস্তা বড় হবে। কিন্তু মাটিগুলো তুলে ফুটপাথ ভর্তি করা হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি, পাশের অংশে কাজ চলছে আর ফুটপাথ ভর্তি রাস্তা খোড়া মাটিতে। সাথে বৃষ্টি। পথচারী কোন দিক দিয়ে হাটবে সে কথা কেউ ভাবে? অথচ এই কাজের দ্বায়িত্বে নিশ্চয় কোন ইঞ্জিনিয়ার আছেন, ওই এলাকার জন-প্রতিনিধি আছেন যার সভ্য-শিক্ষিত-নীতিনির্ধারক শ্রেণিভূক্ত। কিন্ত হায় তাদেরো নাই সভ্য হবার মানসিকতা।
এরকম কত উদাহরন চান আপনি? উপরের উদাহরণ গুলি অনেকটা অদক্ষ-অপেশাদার প্রতিসঠানের ফল বলে মেনে নেয়া যায়। কিন্ত ব্যাক্তি পর্যায়ে কি আমরা সভ্য মানসিকতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারি?
ট্রাফিক সিগন্যালের গাড়ির চলার জন্য সবুজ বাতি জ্বলছে এবং গাড়ি চলছে। একটু পরে গাড়ির জন্য লাল বাতি জ্বললে নিরাপদে রাস্তা পার হওয়া যাবে। কিনতু সেই দুই-পাচ মিনিট দাড়ানোর ধৈর্য নেই অনেকের। চলন্ত গাড়ির মধ্যেই দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া। শুধু অসভ্যতাই নয়, দুই-পাচ মিনিটের জন্য জীবনের ঝুঁকি নেয়া!
সেদিন বাচ্চা কে স্কুলে নামতে গেলাম। গাড়ির মোটামোটি জ্যাম। এক ড্রাইভার অনবরত হর্ণ বাজাচ্ছেন কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনের গাড়ির যাওয়ার কোন জায়গা নেই। আশে-পাশে অনেক শিশু হেটে স্কুলে যাচ্ছে। এরকম জায়গায় যে ভদ্রবেশী চালক ক্রমাগত ভাবে অনেক জোরে ভেপু বাজাচ্ছেন তার সভ্যতার মানদন্ড কি?
কেএফসি তে যারা গাড়ি নিয়ে খেতে আসেন, তারা নিশ্চয় শিক্ষিত-বেশ টাকা পয়সার মালিক। আম-জনতার দৃষ্টিতে যারা সভ্যতার প্রতীক। রিক্সাওয়ালা কিম্বা নিম্ন পেশার মানুষ তাদের “স্যার” সম্মোধন ছাড়া কথা বলতে পারে না। রাস্তা উপর এক সারি (রাস্তার সমান্তরাল করে) গাড়ি রাখা না হয় মেনে নিলাম, পার্কিং-এর জায়গার অভাব। কিন্ত যিনি দ্বীতিয় সারিতে পার্কিং করে (যার ফলে রাস্তার দুটি লেন বন্ধ হয়ে গেল) খেতে ঢুকে, তার পোষাক-ভাষা যতই পরিশীলিত হোক, টাকার উচ্চতা যতটুকুই হোক না কেন, সমাজে তার যতই প্রভাব-দাম থাকুক না কেন, তাকে সভ্যতার স্কেলে আমি পাশ নম্বর দিতে রাজি নই।
কোন সভ্য মানুষের বাসায় ছোট বাচ্চাকে কাজের মেয়ে বা ছেলে নিয়োগ দেয়াটায় অসভ্যতার লক্ষন। তার পরো সমাজে প্রচলিত আছে বলে তারা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের বাসার কাজে লাগাচ্ছেন, অনেকে এটা বুঝেন না যে কত সামাজিক অনাচার তারা করছেন। দেখা যায় দুটি সমবয়সী শিশু স্কুল থেকে ফিরছে, ময়লা কাপড় পরা এক জীর্ণ শিশু (যে কিনা কাজের শিশু, শিশু-শ্রমিক) নাদুস-নুদুস ছেলেটির বই টানছে। সব না হয় মেনে নিলাম, এর পরও কথা থাকে। যে শিক্ষিত মহিলা/দম্পতি বাসায় কাজের জন্য রাখা ছোট বাচ্চাটিকে অত্যাচার করেন, খুন্তি গরম করে গায়ে ছ্যাকা দেয় তাকে সভ্য তো দূরে থাকুক, আমি মানুষ বলতেই রাজি নই।
আর কত বলব? নজরুলের ভাষায় বলতে হয়, “বন্ধু গো আর বলিতে পারিনা বড় বিষজ্বালা এই বুকে”।
তবু আমি আশবাদী মানুষ। আশ করি একদিন আমরা ঠিকই সভ্য হব। কিন্তু সেদিন কবে?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন