সাপ্তাহিকী
|
আব্দুল মান্নান
|
|
‘নতুন প্রজন্ম’ কি ভিন জগতের প্রাণী?
23 Feb, 2013
জন্ম গ্রহণ করার পর সাধারণভাবে শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনের অবসান ঘটে। যাঁরা বার্ধক্যে উপনীত হন তাঁরা জীবনের সকল পর্যায় মাড়িয়েই সেখানে গিয়ে পৌঁছেন। যৌবনের মত মহামূল্যবান সময়ও তাঁদের জীবনে এসেছিল। তাহলে বলতে দ্বিধা নেই যৌবনের আগের ও পরের সময়টুকুতে তখনকার জন্য তাঁরা ছিলেন নতুন প্রজন্ম। অর্থাৎ নতুন প্রজন্ম সব সময়ই ছিল। কিন্তু নতুন প্রজন্মকে নিয়ে এখন যে মাতামাতি চলছে, তাতে মনে হতে পারে, ভিন্ন গ্রহ থেকে ভিন্ন চিন্তা-চেতনা, মেধা ও মননে সমৃদ্ধ হয়ে আমাদের ধরিত্রীতে কোনো এক আজব প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেছে। শুধু তাই নয়, প্রচার করা হচ্ছে তারা তাদের অনুসৃত আদর্শের বাতাবরণে ধর্মীয় কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করে প্রগতির পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সারা দুনিয়াতে কিনা জানিনা, তবে আমাদের দেশে একেক সময় একেকটি বাক্যের বা শব্দের হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটে। আর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ার বদৌলতে অতি সহজেই তার ঝঙ্কার গোটা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বর্তমানে ‘নতুন প্রজন্ম’ শব্দটি ঝঙ্কৃত হচ্ছে বাংলার আকাশ থেকে পাতালে, স্বর্গ থেকে মর্তে, বন থেকে বনান্তরে এবং দিক থেকে দিগন্তে। আরো কিছু শব্দের সাথে, এ শব্দটিরও ব্যবহার বেশী করে শুরু হয়েছে ২০০৮ সালের আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মহাজোটের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকেই। তারা দাবি করে নতুন প্রজন্মের ভোটাররা নাকি তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা ছিল। কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা সেটা জানতে পেরেছিল তা তারাই ভালো জানে।
মানব শিশু জাত-পাত নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেনা। তাদের পিতা-মাতা এবং পরিবেশ তাদেরকে চলার পথ বাতলে দেয়। দেখানো পথ নির্দেশনার আলোকেই মানব সন্তানেরা বিভিন্ন চরিত্র ধারণ করে মহীরুহতে পরিনত হয়। আজকের এ নতুন প্রজন্মের তরুণরাও তা থেকে আলাদা কিছু নয়। নতুন প্রজন্মের, তাই সকল তরুণ একই আদর্শের অনুসারী হবে তাও না। আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে নানা বিভাজন সেটাই প্রমাণ করে।
আমাদের এলাকায় একটা কথা চালু আছে - ব্যাঙ কেন নাচে, তারও ওস্তাদ আছে। অর্থাৎ যে কোনো ঘটনা ঘটার পেছনে একটা শক্তি কাজ করে। কাজেই এ প্রজন্মের তরুণরা, যে আদর্শের ছায়া তলে নিজেদের বুদ্ধি বৃত্তিকে বিকশিত করছে, স্বাভাবিকভাবেই সেই আদর্শের গুরুদের নির্দেশ তাদের কাছে শিরোধার্য এবং তারা তাদের নির্দেশেই সব কিছু করছে। পৃথিবীতে যত বিপ্লব সাধিত হয়েছে তাতে তরুণদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে বয়োজ্যেষ্ঠদের ভূমিকা তার চেয়েও অনেক বেশী। কারণ তরুণদের উচ্ছ্বাস, আবেগ ও উচ্ছ্লতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে সৃষ্টির পরিবর্তে ধ্বংস অবধারিত।
জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে শনৈঃশনৈ উন্নতির পথে সারা বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। অধিকন্তু, বিজ্ঞানের জগতে জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমাদের তরুণ সমাজ অবাধে বিচরণ করছে তথ্যের সাগরে। আদর্শ বিবর্জিত শিক্ষার মাধ্যমে বেড়ে উঠা তরুণরা তথ্যের সাগর থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারছে কিনা সেটা নিয়েই যত দুঃশ্চিন্তা। দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি সহ নানা ধরণের সামাজিক অপরাধের সাথে তাদের বিরাট একটা অংশ যুক্ত। এ নিদর্শনগুলি কি জাতির জন্য সু-সংবাদ বয়ে আনে? হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে বিপথগামী কিছু তরুণের একটা দলকে উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হচ্ছে কেন? প্রশ্ন এই জন্যই উঠছে যে, অধিক সংখ্যক তরুণরা দুস্কৃতিকারীদের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেনা। কারণ তারাও নীতির দিক থেকে এক দুর্বল স্থানে অবস্থান করছে। নৈতিকতা বিহীন জনশক্তি সংখ্যায় যত বেশীই হোকনা কেন তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস রাখেনা। তাই অন্যভাবে বলা যায় নীতিহীন জনসমষ্টি অপরাধীদের সহায়ক শক্তিও বটে।
৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ মঙ্গলবার থেকে নতুন প্রজন্মের ব্যানারে শিশু, কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাদের জড়ো করে শাহ্বাগ চত্তরে এক নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে। প্রথম দিকে এটাকে নতুন প্রজন্মের তরুণদের নিরেট একটা দাবি মনে করা হলেও দিন গড়ানোর সাথে সাথে মঞ্চটি অন্য একটা রূপ পরিগ্রহ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে মহাজোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের এবং বাম ঘরানার রাজনীতিকদের আওড়ানো বুলিকে সংক্ষিপ্ত স্ক্রিপ্ট্ তৈরি করে তা মঞ্চস্থ করলে যা হতো, শাহ্বাগ চত্তরে সেটাই হচ্ছে।
শুরুতে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহ্বাগ উত্তাল হয়ে উঠলেও এখন দেখা যাচ্ছে তরুণদের কাঁধে বন্দুক রেখে রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের জিগীর তোলা হচ্ছে। ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী ব্যাংক, কিছু কিছু প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়া এবং আরো কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি মুহুর্মুহু উচ্চারিত হচ্ছে। সবগুলিই করা হচ্ছে ইসলামী শক্তিকে ধ্বংস করে নাস্তিক্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার কুট কৌশল হিসাবে। এই মহাসমাবেশ ইসলাম বিমুখ রাজনৈতিক ঐক্যের বহু পুরানো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মহড়া ছাড়া আর কিছুই না।
শাহ্বাগ চত্তরে জড়ো হওয়া নতুন প্রজন্মের তরুণদের কিছু কিছু স্লোগান সরাসরি গণতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা এবং ধর্মের বিরুদ্ধে গেলেও তাদের গুরুরা সুন্দর সুন্দর যুক্তির প্রলেপ দিয়ে সেগুলিকে জায়েজ করে দিচ্ছে। একটি দল বা গোষ্ঠীকে কাবু করতে গিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশে কৌশলে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলিকে কেন প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে তা আপামর জনসাধারণকে ভেবে দেখতে হবে।
ষোল কোটি মানুষের দেশে সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় কয়েক লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সমাগম থেকে উচ্চারিত ধ্বনির সবটুকুই যে, দেশের সকল মানুষের মনের কথা, তা ভাববার কোনোই কারণ থাকতে পারেনা। তবে এটা ঠিক, কৌশলে প্রধান যে ইস্যুটি সামনে আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধাচরণ একজন লোকও করবেনা। এমনকি অভিযুক্তরাও নয়। কিন্তু অনেকে যেটা বুঝতে পারছেনা তা হলো, ইস্যুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর কর্মসূচী বাস্তবায়নের গোপন ইচ্ছা। তা হচ্ছে ইসলামকে পঙ্গু করে দেয়া।
শাহ্বাগের তরুণদের কর্মসূচী বাংলাদেশের সকল তরুণের কর্মসূচী নয়, তার প্রমাণ দেখতে চাইলে সরকারকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শান্তিপুর্ণভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ইসলাম বিদ্বেষী এ সরকার ও তার সমর্থনকারীরা তখন সহজেই অবলোকন করবে, ইসলামের পক্ষে ডাকা সমাগমে তরুণের সংখ্যা শাহ্বাগের সমাগম থেকে অনেক গুণ বেশী হবে।
শাহ্বাগের তরুণদের আন্দোলনের ফল ঘরে তোলার লক্ষ্যে রাজনীতিকদের কথা-বার্তায় বিভাজনের সুর সুস্পষ্ট হওয়াতে দুই শকুনের খাবার নিয়ে টানাটানির কথাটি মনে পড়ে গেল। মহাজোট সরকারের বিগত চার বছরের পাহাড় পরিমান ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধী দলগুলিকে আন্দোলন করার সুযোগ না দেয়া এবং পাশা-পাশি জনগণের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখার মহা সুযোগ সৃষ্টি হওয়াতে সরকার আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করছে। অন্য দিকে জন বিচ্ছিন্ন বামরা বহুদিন ধরে তৃতীয় ধারার রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের স্বপ্ন দেখে আসছিল। তাই তারাও এই সুযোগ গ্রহণ করে তাদের কাজের বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য তৎপর বলেই মনে হচ্ছে। তবে পরিণতি কি হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত কোনো উপায় নেই।
নতুন প্রজন্মের তরুণরা বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর সম্পদ নয়। তাই আমাদের সবাইকে তাদের জন্য আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। আবহমান কাল থেকে চলে আসা সত্য ও মিথ্যার সংঘাতকে তাদের নিকট স্পষ্ট করতে হবে। ইসলাম বিদ্বেষীরা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের অপকর্মকে পুঁজি করে ইসলামকে কলুষিত করার কৌশলগুলি কিভাবে গ্রহণ করে তা তাদের সামনে পরিস্কারভবে তুলে ধরতে হবে। আমরা অভিভাবকরা যদি আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি তাহলে তরুণদের নিকট থেকে আগামীতে একটা সুন্দর পৃথিবী আশা করতেই পারি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন