শিক্ষা এবং প্রকাশনা শিল্প
শিক্ষা ও প্রকাশনা শিল্প পরস্পরের সহযোগী। শিক্ষা জাতিগত উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আবার প্রকাশনা সৃজনশীলতা ও মননশীলতা বিকাশে সহায়ক। আধুনিক বিশ্বে সুশিক্ষিত ও সৃজনশীল জাতিকে উন্নয়নের ধারক এবং বাহক বলা হয়। শিক্ষার মাধ্যমে মেধাবিকাশ এবং সৃজন ও মননশীলতা বিকাশে প্রকাশনার গুরুত্ব অপরিসীম। একারণে প্রকাশনাও একটি শিল্প। প্রকাশনা শিল্পের মধ্যে- পাঠপুস্তুক, সহপাঠ, সৃজন ও মননশীল বই, রেফারেন্স বই, অনুবাদ বই, শিশুতোষ বই উল্লেখযোগ্য। আর অবাধ তথ্য প্রবাহের জন্য অন্যতম মাধ্যম দৈনিক, মাসিক, সাপ্তাহিকসহ বিভিন্ন সাময়িকপত্র। বাংলাদেশে এই শিল্পটি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ শিল্পে পরিণত হচ্ছে। অথচ শিল্প হিসেবে প্রকাশনাকে বিকশিত হতে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা লক্ষ্য করা যায়না।
কমে যাচ্ছে মননশীলতার চর্চা
দিন দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে মানুষের সৌখিন ও মননশীলতার চর্চা কমছে। এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষের পঠন-পাঠনের অভ্যাস খুব কম। তার উপর কাগজের দাম বাড়লে সৃজনশীল বইয়ের দাম বাড়বে। অপরদিকে ডিজিটাল দুনিয়ার যুগে সহজে বিকল্প খুঁজে পেয়ে যাচ্ছে অনলাইন-ইন্টারনেট, ফেসবুক-টুইটার-ইউটিউব, মোবাইল ফোন এবং আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে। যদিও এসবের মাঝে বোধ তৈরির স্থায়িত্ব কম তারপরও সত্যি যে, বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার পিছনে এসবের প্রভাব আমলে নেয়ার মতো। বইমেলার জনপ্রিয়তা এবং সারা বছর যে বই প্রকাশিত হয় কাগজের মূল্য কম হলে এই হার আরো অনেক বেড়ে যাবে। বইয়ের দাম কম রেখে গুণগতমান ভালো করতে পারলে মানুষ বেশি বেশি বই পড়বে। বিশেষত তরুণ ও শিশু কিশোরেরা বই পড়ায় ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠবে।
জাতীয় সংস্কৃতির উৎসব
একুশে বইমেলা কালক্রমে রূপ নিয়েছে বাঙালির একটি সর্বজনীন সংস্কৃতির জাতীয় উৎসবে। মেলার বয়স এখন হিসেবে নেয়ার মতো। এই ঐতিহ্যবাহী জাতীয় উৎসবকে ঘিরে প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির হিসাব করার সময় এসেছে। বইমেলাকে আমরা বিশ্বদরবারে বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। প্রকাশক, লেখকদেরকে নিয়ে বাংলা একাডেমীর এই প্রচেষ্টা বইমেলাকে সৃষ্টি ও নান্দনিকতার সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত করার প্রত্যয়ে নিরলস কাজ করছে। ফলশ্রুতিতে দেখা গেছে, বইমেলা শুধুমাত্র ক্রেতা-পাঠকেরই সমাগমের বাণিজ্যিক মেলা নয়, বরং এই মেলা পরিণত হয় লেখক-পাঠক, প্রকাশক-ক্রেতা-দর্শক এবং মিডিয়ার সাহচর্যে সর্বোতভাবে একটি জাতীয় মিলনমেলায় পরিণত হয়। এখন লেখক-প্রকাশকের বাইরে পাঠক ও সাধারণ মানুষের প্রতীক্ষার বিষয় বইমেলা।
মেলাকেন্দ্রিকতা
দেশের অধিকাংশ প্রকাশক-লেখকরা সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকেন বাংলা একাডেমীর এই মেলাকে কেন্দ্র করে। প্রকাশকরা বিনিয়োগ করার জন্যও এই সময়টাকেই একমাত্র উপযোগি সময় হিসেবে কেন জানি বেছে নেন। ফলে দেখা যায় মেলার শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত নতুন বই আসতে থাকে। আর শেষ দিকে যেসব লেখকদের বই আসে তাদের মাঝে হতাশা মিশ্রিত ক্ষীণ উত্তেজনা কাজ করে। নতুন লেখকদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়। যেসব পাঠক একবারই মেলায় যান এবং যদি তা প্রথম দিকে হয়- তাহলে অনিবার্যভাবে তিনি হয়তো অনেক ভালো প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। ব্যস্ততার কারণে মানুষ এত সময় পায়না যে দু-চার দিন মেলায় গিয়ে বই কিনবেন। তাছাড়া বছরের অন্যান্য সময় নতুন বই প্রকাশের প্রচলন কম থাকার কারণে পাঠকেরাও মনস্তাত্বিকভাবে বইমেলাকেন্দ্রিক হতে বাধ্য হচ্ছেন। আমি মনে করি পাঠকের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে প্রকাশকদেরও ভূমিকা নেয়ার আছে। আরেকটি ভাবনীয় বিষয় হলো- প্রকাশনা সেক্টর যদি পুরোপুরি মেলা নির্ভর হয়ে পড়ে তাহলে কি শিল্প দাঁড়াতে পারবে? আমি বলব- প্রকাশনা শিল্পকে অবশ্যই মেলাকেন্দ্রিক নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একটি প্রকাশনী সংস্থা বছরে ৫০টি বই বের করলে ৩০টি হওয়া উচিত বছরের অন্যান্য সময়ে। ২০টি বই সম্পূর্ণ নতুনভাবে মেলার জন্য আসতে পারে। আবার বছরের অন্যান্য সময়ে বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি ঋতুভিত্তিক ক্ষুদ্রায়তনের মেলাকে উপজীব্য হিসেবে নির্বাচন করা যেতে পারে। যেমন- বর্ষার বইমেলা, শরতের বইমেলা, গ্রীষ্মের বইমেলা ইত্যাদি। বলা প্রয়োজন বিচ্ছিন্নভাবে এধরণের মেলার আয়োজন হয়েছে। এসবের জন্য প্রকাশক, বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী’র সমন্বয়ে কমিটি হতে পারে। মেলার জন্য স্থান, নামকরণ এবং উপযোগী সময় ঠিক করে প্রচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আবার বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভাগীয় এবং জেলাওয়ারী মেলার আয়োজনকে জনপ্রিয় করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মেলার আয়োজনে স্টল বরাদ্দের জন্য কোনো অর্থ নেয়া যাবেনা। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় পাঠক বাড়বে, পঠন অভ্যাস বাড়বে, সারা বছর প্রকাশনা অব্যাহত থাকবে, মেলার সময়ে বাড়তি চাপ কমে আসবে। প্রতিটি প্রকাশনার প্রতি প্রকাশকগণ মনোযোগী ও যত্নশীল হওয়ার সুযোগ পাবেন।
বইকেনা ও বই পড়া
একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, সময়ই প্রজন্মকে ব্যস্ত করে তুলেছে অন্য দিকে। একারণে তাদের আগ্রহ কমে গেছে পড়ার প্রতি। তরুণ প্রজন্মের এই পঠন বিমুখতার অভ্যাসকে বদলানোর দায়িত্ব এককভাবে কারো নয়। এখানে প্রকাশক চেষ্টা করবেন উপযোগি বই প্রকাশ কওে কম দামে বই কেনার সুযোগ সৃষ্টি করতে। লেখকরা প্রজন্মেও উপযোগি বিষয় বৈচিত্রে লেখনির সমাবেশ ঘটাবেন। পরিবার বই পাঠে সন্তানদেরও উৎসাহিত করবেন। শিক্ষাঙ্গনে পাঠ্য বইয়ের বাইওে সৃজনশীল ক্লাশ রীতি চালু করবেন। মিডিয়া এবং প্রকাশনা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রতিযোগিতা এবং পুরস্কারের আয়োজন করবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল সাংস্কৃতিক এবং প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের পুরস্কার হিসেবে একমাত্র হিসেবে বই পুরস্কৃত করবেন। এবাবে নতুন প্রজন্মকে বই পড়ার চর্চার মধ্য দিয়ে বড় করে তুলতে হবে। তাহলেই তৈরি হবে সৃষ্টিশীল নাগরিকের। মনে রাখা প্রয়োজন, শিশু-কিশোরের জীবনের ভিত তৈরির করার জন্য শৈশবে বই পাঠ করার গুরুত্ব অপরিসীম। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন তার পুত্রের শিক্ষকের কাছে এক চিঠিতে লিখেন- ‘বইয়ের মাঝে কি যে শক্তি লুকিয়ে আছে, আপনি তা আমার পুত্রকে শেখাবেন।’ সুতরাং জ্ঞানের আলো ছড়ানো এই বইয়ের যাদুকরি শক্তি সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট কওে তুলতে হবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ভ্রাম্যমান পাঠাগার আন্দোলন এ ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
প্রয়োজন মধ্যবিত্ত পাঠক সৃষ্টি
পৃথিবীর ইতিহাসে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও মূল্যবোধের শিরোমণি মধ্যবিত্ত সমাজ। দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করেন, লালন করেন এবং প্রজন্মান্তরে প্রবাহমান রাখেন এই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। আমাদের সমাজে একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে এই মধ্যবিত্ত সমাজ। সৃজনশীলতা, কৃষ্টি, সভ্যতা, পারিবারিক সম্প্রীতির ঐতিহ্যের বুনিয়াদি শিক্ষা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতেই। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পাঠক হতে পারে প্রকাশনা শিল্পের শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু হালের খাতায় এই মধ্যবিত্তরা এখন কোণঠাসা পর্যায়ে। জীবনমানই যেখানে চলে না, সেখানে বই পড়বে এমনটি প্রত্যাশা করাও যেন অন্যায়! মধ্যবিত্ত সমাজের পাঠকদেরকে বই এখনো টানে। তারা বই কেনেন। বই পড়েন তারাই বেশি। বই উপহারের সংস্কৃতিও তাদের একটি ধারাবাহিকতা। কিন্তু বইয়ের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্তের বই কেনা, পড়া বা উপহার দেয়া সবই যেন কমে এসেছে। সংসারে নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদার চাপে মধ্যবিত্তে সৃজনী তালিকা থেকে বই যেন দূওে সওে যাচ্ছে। এজন্য সরকারের দৃষ্টভঙ্গি পাল্টানো জরুরি। কাগজের আমদানি শুল্ক বাদ দেয়া বা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার। দেশীয়ভাবে মানসম্পন্ন প্রকাশনার উপযোগি কাগজ উৎপাদনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। রহস্য পত্রিকা বা প্রজাপতি প্রকাশনী বা সেবা প্রকাশনী কম দামে বই কেনার সুযোগ দিয়ে তরুণ সমাজে একটা বিরাট মার্কেট তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। যদিও তারা প্রচলিত ধারা পাশাপাশি নিউজ প্রিন্টে বই ছেপে আর্ট পেপারে কভার দিয়ে সহজে তা করতে পারছে। কিন্তু আমাদের মূলধারা প্রকাশনার ঐতিহ্য, আধুনিকতা, উন্নত ছাপা, উন্নত বাঁধাই এসব ঠিক রেখে কি উপায়ে বইয়ের দাম মধ্যবিত্তের নাগালে রাখা যায় খুঁজে দেখা যেতে পারে। আবার প্রকাশকের লাভ যেন ঠিক থাকে, লেখক যেন সঠিক সম্মানী পান, বিক্রয় এজেন্টদের কমিশন যেন মান সম্পন্ন হয় সব বিষয়েই ভাবতে হবে। তবে আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে যা বুঝি, প্রকাশনগণ যে কমিশন দিয়ে থাকেন এতে বিক্রেতা এজেন্টের যতটা লাভ হয় তার কিঞ্চিৎ উপকার ক্রেতা পাঠকের জন্য দেয়ার কি কোনোই সুযোগ নেই? সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ থাকলো- বইকেনার মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে সহযোগি ভুমিকা নিন। বইয়ের দাম অবশ্যই অবশ্যই মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে থাকা চাই।
প্রকাশনা শিল্পের বিকাশে আবশ্যিক মিডিয়ার ভুমিকা
ফেব্রুয়ারি মাসটি এলেই প্রাণের তাগিদে সবাই ছুটে আসে বাংলা একাডেমী আঙিনায়। বইপ্রেমীদের পদচারণায় জমে ওঠে মেলা। এই মেলার প্রতিদিনের খবর ছরিয়ে দিতে নিরলস কাজ করে যান বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে লেখক, পাঠক, বই, প্রকাশক, ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা আর লেখালেখি। বইমেলার জনপ্রিয়তা, পাঠক সমাগম, বই বাজার এবং লেখকদেরও ব্যাপক পরিচিতি প্লাটফর্ম তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের মিডিয়ার অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এর ধরাবাহিকতা রক্ষার দাবী জানাচ্ছি মিডিয়ার কাছে। বইমেলায় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের সংবাদ সংগ্রহ, সাক্ষাৎকার থেকে শুরু করে নানা মাত্রিক আয়োজনের ব্যস্ততা পাঠক, লেখক, প্রকাশক মহলে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। কিন্তু সারা বছর লেখক, প্রকাশক বা বই প্রকাশের গুরুত্ব মেলার আয়োজনের মতো সেভাবে ফোটে উঠেনা। মেলাকে কেন্ত্র করে, মেলা থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সারা বছরই লেখক ও প্রকাশকের কভারেজ দিতে পারে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। লেখালেখির ক্যানভাসে এই আয়োজন দেশের সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির বিকাশে ভূমিকা রাখছে এবং রাখবে। টিভি মিডিয়ায় সাপ্তাহিক হলেও একঘন্টার বই কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান আয়োজন সময়ের দাবী। আরেকটি কথা বলার তাগাদা অনুভব করছি সেটি হলো, আমাদেরও পত্রিকাগুলোর বিজ্ঞাপন রেটে বইয়ের বিজ্ঞাপনের খুব একটা সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। অবশ্য বইমেলাকে কেন্দ্র করে একমাসের জন্য শুধুমাত্র বইয়ের বিজ্ঞাপনে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। এই ছাড়ের ব্যবস্থাটিকে সারা বছরের জন্য স্থায়ী করলে কি মিডিয়ার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? পত্রিকার বিশেষ পাতাগুলোতে যেমন- সাহিত্য, তরুণদের পাতা, পাঠক ফোরাম, শিশুদের পাতা, স্বাস্থ্য পাতা, বিজ্ঞান পাতা, প্রযুক্তির পাতা, নারীদের পাতায় বিষয় সংশ্লিষ্ট বইয়ের বিশেষ ছাড়ে বিজ্ঞাপনের সুযোগ দিলে আমাদের প্রকাশনা শিল্প এগিয়ে যাবার সুযোগ অবারিত হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন