সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
নিজ অর্থে তিন বছরে পদ্মা সেতু ঃ বাস্তবতা নাকি রাজনৈতিক শ্লোগান?
09 Feb, 2013
আশাবাদী হওয়া ভাল, খুবই ভাল। আশাবাদী বা Positive attitude এর লোকজন সাধারনত উন্নতি করে থাকে। জাতি হিসাবে আমরাও আশাবাদী হবার সাহস দেখিয়েছি। বিশ্বব্যাংককে পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে আগামী তিন বছরে নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মান হবে।
আশাবাদী হবার জন্য একটা ন্যুনতম সামর্থ্য লাগে। সেটা আমাদের আছে কিনা এখন তা প্রমাণের সময়।
তার আগে একটা গল্প বলে নিই। আমি তখন ক্লাশ টেনের ছাত্র। অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখানো শুরু হয়েছে। তো আমাদের এক বন্ধু ইংলিশ প্রথম পত্রে পেয়েছে ০৬ (১০০ এর মধ্যে)। তারপরও দেখি তার মধ্যে তেমন বিকার নাই। কারন সে তখনও আশাবাদী ইংলিশ দ্বীতিয় পত্রে সে ন্যুনতম ৬০ তুলতে সমর্থ হবে এবং দুই পত্র মিলিয়ে পাশ করবে (২০০ এর মধ্যে ৬৬ পেলে পাশ)। অবশ্য বেচারার সে আশা পুরন হয়নি, কারন ইংলিশ দ্বীতিয় পত্রে সে পেয়েছিল দশ থেকে কুড়ি এর মাঝে (সঠিক নম্বরটা আজ আর মনে নাই)। যে ইংলিশ প্রথম পত্রে ০৬ পায় তার দ্বীতিয় পত্রে ৬০ পাওয়ার মত আশাবাদী হওয়াটা বোকার স্বর্গে বাস করা কিম্বা সমুদ্রের মাঝে ডুবন্ত ব্যাক্তির খড়-কুটা আকড়ে বাচবার চেষ্টা করবার সাথে তুলনা করা যায়, নিশ্চিতভাবেই তা বাস্তবসম্মত নয়।
বলছিলাম সামর্থের কথা। রাস্তার ওপর একটা ফুট-ওভার ব্রিজ বানাতে আমাদের লাগে এক থেকে দেড় বছর। চলতি অর্থ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের এডিপি বাস্তবায়নের হার ত্রিশ শতাংশ মাত্র। সামান্য ড্রেন পরিস্কার করে ময়লা রাস্তায় ফেলে রাখা হয় অন্তত সাত দিন। সেই দেশে তিন বছরের পদ্মা সেতুর মত বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কতটা বাস্তবসম্মত? যে সরকার চার বছরে সেতুর কাজ শুরুই করতে পারলনা (১০০ তে পেল শুন্য) তারা আগামী তিন বছরের সেতু সমাপ্ত করে ফেলবে (১০০ তে ১০০ পাবে) সেটা কেমন যেন রূপকথার মত শোনায়। বামন হয়ে আকাশের চাঁদ ধরা কিম্বা কুজোর চিত হয়ে শুতে চাওয়ার মত মনে হয়। এরকম চিন্তা-কাজ আমাদের দীর্ঘ-লালিত সংস্কৃতির অংশ বলেই মনে হয় এই সব প্রবাদ-প্রবচনের জন্ম হয়েছে। সময় অনেক হয়ত গেছে কিন্তু কয়লার গায়ের ময়লা তো যায়নি, আমরা সেই বাংগালীই রয়ে গেছি, মানুষ আর হয়ে উঠিনি।
দক্ষিনাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নয়নের জন্য পদ্মাসেতু দরকার, সন্দেহ নাই। জনগনের পদ্মা নদী পার হবার জন্য সেতুটির যতটুকু না দরকার তারচে সরকারের বেশী দরকার নির্বাচনী নদী পার হতে। ফারাক্কায় মেরে ফেলা বাস্তবের অর্ধ-মৃত পদ্মা ফেরী-স্পীডবোটে পার হয়ে কাজ চালিয়ে নেবার অভিজ্ঞতা জনগনের আছে। সেতু না হয় আমরা স্বপ্নেই পার হলাম আর কম্পিউটারে ৩-ডি এনিমেশন দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম কিন্তু নির্বাচনী নদী তো মরা পদ্মা নয়! জনগন ভোট না দিলে এই বিশাল নদী কিভাবে পাড়ি দিবে ক্ষমতাসীন দল? নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দেবার রসদ কোথায় পাবেন তারা? আবুল কে ঢাকবেন কি দিয়ে? কাজেই আর কিছু না হোক একটা ভিত্তিপ্রস্তর তো বাসানো দরকার যাতে প্রধানমন্ত্রীর নাম লিখা থাকবে। এই ভিত্তিপ্রস্তরের আড়ালে চাপা পড়ে যাবে আবুল-কাহিনী। জনগনের সামনে একটা মুলা অন্তত ঝুলানো থাকবে, না হলে আমরা গাধা-জনগন কি দেখে এই ব্যর্থ সরকারকে আবার ভোট দিতে অনুপ্রাণিত হব?
তারপরো আমরা আশাবাদী হতে চাই। বিশ্বব্যাংক কে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখানো উন্নয়নের পথে একটা আবশ্যাম্ভাবী মাইলফলক। আমরা অর্থনীতিতে ক্রমাগত উন্নতি করছি, সে হেসাবে কোন একসময় এটা করতেই হতো। হয়ত আমরা এই মুহুর্তে তার জন্য প্রস্তত ছিলাম না কিন্তু ঘটনা ঘটে গেছে। হয়ত কিছুটা অপ্রস্তত অবস্থায় এখানে চলে এসেছি, ক্লাস ওয়ান টপকে ক্লাশ টুতে পড়তে চলে এসেছি। একটু বেশি পরিশ্রম করলে হয়ত পাশ করে যেতেও পারি। তাহলে এটা শাপেবর হয়ে আমাদের অর্থনীতির আত্মবিশ্বাস আরো কয়েক ধাপ উপরে নিয়ে যেতেও পারে।
কিন্তু সেজন্য দরকার বাস্তবতা মেনে নেওয়া। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় ফিতে কাটবার জন্য প্রকল্প তৈরী নয় বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করা উচিত, তিনের জায়গায় পাচ বছর হলেও অসুবিধা নাই তবে ঠিকভাবে এগুতে হবে। ক্ষমতার অতিরিক্ত বোঝা তুলতে যেয়ে যেন মেরুদন্ড ভেংগে না যায় সে বিবেচনাও নিশ্চয় সরকার বিশষজ্ঞদের সাথে নিয়ে করবেন। ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ রক্ষা করতে যেয়ে আবার যেন বিশ্বব্যাংক অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি না হয় সেটাও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। দুর্ণীতিকে শক্ত হাতে দমন করা উচিত। দক্ষভাবে কাজের সমন্বয় করা উচিত। বিরোধী দলকে আস্থায় আনা উচিত যাতে ক্ষমতা বদল হলেও প্রকল্প চলতে পারে। অদক্ষতা কাটিয়ে দক্ষ হবার, পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে আত্মনির্ভরশীল হবার এক অনন্য সুযোগ আমাদের সামনে, আমরা এ ক্ষেত্রে সফল হতে চাই। প্রথম পর্বে ফেল তো হয়েই গেছে, দুই পর্ব মিলে পাশ হয় কিনা তাই এখন দেখবার বিষয়!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন