সাপ্তাহিকী
|
মোঃ মহিউদ্দিন মজুমদার মাসুম
|
|
শাহবাগ স্কয়ার বা প্রজন্ম স্কয়ারের গণজাগরণ মঞ্চ ও বাংলাদেশ
09 Feb, 2013
শাহবাগে ওরা কারা, কেন এ জমায়েত, এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দেশের সর্বত্র । প্রশ্নগুলো কেউ জেনে, আবার কেউ না জেনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন । আবার দেশের বিরাট অংশের মানুষ আশার আলো খুঁজছেন শাহবাগ স্কয়ারের তরুণদের জমায়েত থেকে । ইতিমধ্যে তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে এবং প্রতিবাদ ছড়িয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ।
প্রতি মুহূর্তের মুহর্মূহঃ প্রতিবাদী স্লোগানই ওদের পরিচয় করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট । ওরা এদেশেরই রক্তস্নাত লাল সবুজের পতাকার তরুণ উত্তরাধীকারী- তারুণ্যের প্রতীক, পরিবর্তনের প্রতীক, পাল্টিয়ে দেয়ার অঙ্গীকারের প্রতীক ।
ওরা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সন্তান । ওদের এ জমায়েত নেহায়েৎ বিবেকের তাড়নায় দায়মুক্তির স্বতোঃস্ফূর্ততা । ওদের এ জমায়েত রাষ্ট্র জন্মের সময়কার বিরুদ্ধাচারণকারী রাজাকার আল বদর আল শামসদের নৈতিকতা বিবর্জিত আস্ফালনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবস্থান । শাহবাগ স্কয়ারের সমাবেশ প্রচলিত গুণে ধরা, নীতি-আদর্শ বিবর্জিত রাজনীতির প্রতি আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ । এই তারুণ্যের সমাবেশ মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাঁথার গল্প উপন্যাস পড়ে হৃদয়ে ধারন করেছে পরম মমতায় শ্রদ্ধ্যাবনত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে । এই তারুন্যের সমাবেশ মুক্তিযুদ্ধের সুযোগ্য উত্তরসূরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ । এই তারুণ্যের সমাবেশ হতাশাগ্রস্ত জাতির আশার আলো । শাহবাগ স্কয়ারের তরুণদের অনেকেরই জন্ম ৭১ পরবর্তী সময়ে, কিন্তু হৃদয়ে ধারন করছে ৭১ এর অঙ্গীকারোজ্জল বাংলাদেশকে ।
৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল গুলি ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্থানীদের পক্ষালম্বন করে এবং স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয় । স্বাধীনতার শুধু বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ঘৃণ্য এ শক্তি পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগীতার জন্য রাজাকার আল বদর আল শামস বাহিনী গঠন করে নির্বিচারে হত্যা খুন রাহাজানি লুটপাট বাড়ি ঘরে আগুন ও মা-বোনের ইজ্জত সম্ভ্রম লুটে নেয় । অতঃপর ৯ মাসের সশস্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এবং লাল সবুজের পতাকা ।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণকারীদের রাজনীতি অর্থাৎ ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল এবং দালাল আইনে পাকহানাদর বাহিনীর এদেশীয় দোসড়দের বিচার চলছিল । কিন্তু ৭৫ পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকার সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনেন এবং দালাল আইন তুলে নিয়ে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে দেন । সে থেকে অদ্যবধি কখনও সামরিক সরকার কখনও আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সহযোগিতা সাহচর্য নিয়ে আইন তোয়াক্কা না করার এ পর্যায়ে অবস্থান করছে জামাত শিবির চক্র ।
যুদ্ধের সময় মানবতা বিরোধী অপরাধকে রাজনীতির সমীকরণে বিচারমুক্তি দিলেও সন্তানহারা স্বামীহারা ভাইহারা সম্ভ্রমহারা মা-বোনের আত্মীয়-স্বজনরা কখনও ক্ষমা করেননি, তারই দৃষ্টান্ত শাহবাগ স্কয়ারের গণজাগরণ মঞ্চ ।
দেশের আইন ও সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ভিনদেশী নাগরিক, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া গোলাম আযমকে জামাতী ইসলামী ১৯৯১ সালের ২৯ ডিঃ দলের আমীর ঘোষনা করেন । এ ঘোষনায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নাগরিকরা অপমানিত বোধ করেন এবং সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন । আর ক্ষোভ-বিক্ষোভের উত্তালতার এক পর্যায়ে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীকে আন্দোলনে পরিণত করেন শহীদ জননী জাহানরা ইমাম । সময়ের পরিক্রমায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে ।
সমগ্র জাতির সাথে তরুণরাও অধীর আগ্রহ ও ধৈর্য্য নিয়ে বিচার প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি বিষয় গুলোর প্রতি নজর রাখছিল । আর রাজাকার আল বদরের দল জামাত শিবির চক্র যুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে বিচারাধীন নেতাদের বিচার মুক্তির চ্যালেঞ্জ নিয়ে একের পর এক হরতাল, ভাংচুর, বাসে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষ পুঁড়িয়ে মারছিল । এতে তরুণরা যে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছিল, আমাদের মূল ধারার রাজনৈতিক দল গুলো বরাবরের মত বুঝতে সক্ষম হননি তাই একটি দল ট্রাইব্যুনালের মান, স্বচ্ছতা নিয়ে কথা বলছিলেন কিন্তু তরুণরা ক্ষুব্ধ হলেও চুড়ান্ত রায়ের অপেক্ষা করছিলেন এবং অন্য দলটি যারা সরকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচার চালাচ্ছিলেন, তাদের নেতা মন্ত্রীদের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য তরুণরা বিরক্ত হলেও চুড়ান্ত রায়ের প্রহর গুনছিলেন । কিন্তু কাদের মোল্লার রায়ের পূর্বদিন মতিঝিল শাপলা চত্বরে জামাত শিবিরের গৃহযুদ্ধের আস্ফালনে পুলিশী নিরবতা এবং কাদের মোল্লার গুরু পাপে লঘুদন্ডে সমগ্র জাতির সাথে তরুণরা হতবম্বঃ হন ।
কিন্তু এই অপেক্ষা, ধৈর্য্য, সহনশীলতারও তো সীমা পরিসীমা আছে । তরুণদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গার জন্য রাজাকারদের নিন্মোক্ত কর্মকান্ডগুলি যথেষ্ট নয় কি !
এক) রায়ের পর কাদের মোল্লার ভি চিহ্ন দেখানোটা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষের রক্ত ক্ষরণ ঘটায়নি ? দুই) রায়ের পর জামাত শিবিরের হরতাল দেয়াটা আগুনে ঘি ঢালার মত নয় কি ?
তাই আর নয়, নীরবে বাসায় বসে পত্রিকা ও টিভির মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের খবরা খবর নেয়া । আসুন, মুক্তিযোদ্ধারা যেমনি নয়টি মাস জীবনবাজি রেখে দেশমাতৃকার জন্য লড়েছেন, ঠিক তেমনি গন জাগরণ মঞ্চের শপথকে ধারন করে, এই প্রজন্মের তরুণ হিসেবে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের চুড়ান্ত শাস্তি নিশ্চিত করি এবং ঘৃণীত এই শক্তিকে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি স্তরে সর্বোতঃভাবে মোকাবেলা করি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ি ।
লেখকঃ প্রবাসী, জাপান ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন