সাপ্তাহিকী
|
আব্দুল মান্নান
|
|
মানবাধিকার প্রশ্নে মানব ভাবনা
02 Feb, 2013
বর্তমানে মানবাধিকারের চিন্তা মানব মনে এতটাই প্রগাঢ় যে, মানব সন্তানের সর্বোৎকৃষ্ট একটি শ্রেনী মানবাধিকারের ব্যাপারে অনবরত জ্ঞান দান করে যাচ্ছেন। অন্য দিকে তাঁদের মধ্য থেকে অনেকেই, জ্ঞানের মাথা খেয়ে, ক্ষমতাধর ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি এবং সরকারের আনুকূল্য পেয়ে ধন্য হচ্ছেন। যখন ক্ষমতাধররা ভিন্ন মত ও পথের মানুষদেরকে মানবাধিকার রক্ষার দোহাই দিয়ে শায়েস্তা করে তখন তাঁরাও তা সমর্থন করেন। আবার নিগৃহীতদেরও অনেকে ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে একইভাবে মানবাধিকারের কথা বলেই আন্দোলন-সংগ্রাম করে। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য যে, উভয় পক্ষই অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকারের নিয়ম ভঙ্গ করে এবং তাদের কু-কর্মের স্বপক্ষে মানবাধিকার রক্ষার সুন্দর সুন্দর যুক্তিও উপস্থাপন করে। উল্লেখ্য ক্ষমতাবানদের নিপীড়নের কারণে নিপীড়িতরা একই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
বিশ্বাস করা হয় জন্মের পর যে অধিকার সমূহ মানুষের স্বত্বাধীন হয় তাই মানবাধিকার। নাগরিকত্ব, সামাজিক পদমর্যাদা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য মানবাধিকারের আইন একই রকম। মানবাধিকার হচ্ছে আন্তর্জাতিক নিয়ম যা সর্বত্র সকল জনগণকে রাজনৈতিক, আইন সংক্রান্ত এবং সামাজিক অপব্যবহার থেকে রক্ষা করে। ধর্মীয় স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার, অত্যাচারিত না হওয়া, রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের স্বাধীনতা ইত্যাদি মানবাধিকারের উদাহরণ। মানবাধিকার সনদ (Universal Declaration of Human Rights (UDHR)) একটি ঘোষণাপত্র।১ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই ঘোষণা প্রদান করা হয়। প্রত্যেক মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই সনদ ঘোষিত হয়।
ভুল শুধরানো পর্যন্ত পরীক্ষা চালিয়ে যাবার পদ্ধতি (Trial and error) মানুষকে চিন্তা ও কর্মের জগতে আমুল পরিবর্তন এনে উন্নতি সাধনে বিশেষভাবে সাহায্য করছে। মানবাধিকারের সীমানা নির্ধারণ এবং সেগুলি সংরক্ষণের জন্য আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ পদ্ধতি একই ধারাতে প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলির ব্যবহার নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহই মূলতঃ বিতর্ক করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয় সে জন্য সলা-পরামর্শ এবং দেখভাল করার নিমিত্তে গড়ে উঠেছে নানা সংস্থা। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে সংস্থাগুলি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। অভিযোগ আছে অধিকাংশ সংস্থা নিরপেক্ষভাবে কাজ করে না। যাদের অর্থে পরিচালিত হয় তারা তাদেরই স্বার্থ রক্ষা করে।
বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রের সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য অন্যান্য দেশের সমর্থন চেয়েছিল। উদ্দেশ্য নিজেদের অপকর্মের বিরুদ্ধে অন্যদের মুখ বন্ধ রাখা। সুযোগ পেয়ে নিজ-নিজ স্বার্থ রক্ষা করার লক্ষ্যে দুনিয়ার অন্যান্য বেশীরভাগ দেশ সমর্থন দেয়াতে শক্তিধর সরকার সহজেই তাদেরকে হাতের মুঠোই পেয়ে গিয়েছিল। তারপর সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করা হলো। সন্ত্রাস দমনের নামে ভূলুণ্ঠিত হলো মানবাধিকার। আফগান ও ইরাকের লাখ-লাখ নারী-পুরুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা শুরু করেছিল এবং এখনও তার জের চালু আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলিতে এখনও একই বাহানাতে নানাভাবে মানবতা বিরোধী অপরাধ ঘটেই চলেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলি দায় সারা গোছের কিছু মন্তব্য করে বুঝানোর চেষ্টা করে মানবকে নয় সন্ত্রাসীদেরকে (মুসলিমদের) হত্যা অথবা নির্যাতন করছে।
শক্তিধর বা নিগৃহীত যেই হোকনা কেন, মানবাধিকারের সীমা লঙ্ঘন করার অধিকার কেউ রাখেনা। কিন্তু রাষ্ট্র যন্ত্রের মাধ্যমে সেটাই করা হচ্ছে বিভিন্ন সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলিতে। মানবাধিকার সনদের ধারা সমূহের ১৮ অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও মুসলমানদেরকে ধর্মীয় কোনো কোনো বিধান মানতে বাধা দেয়া হচ্ছে। এমনকি আইন করে সে স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে।
২০১৩ ইং সালের শুরুর দিকে দাঁড়িয়ে আমারা দেখছি বাংলাদেশের সেক্যুলার সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনে অনেক দেশের তুলনায় বেশ অগ্রগামী। খুন, গুম, অপহরণ, জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের আক্রমণ, অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন তৈরি করে ধর্মীয় বিধান মানার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি সহ নানাবিধ অপরাধ সরকারের মদদে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কিন্তু সরকারের কর্তা ব্যক্তিগণ নানা ধরণের কুযুক্তি দিয়ে তাদের অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ষঢ়যন্ত্রতত্ত্বের মাধ্যমে অসিলা খুঁজে বিরোধী দলের বিশেষ করে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি যে অত্যাচার করা হচ্ছে তা যে কোনো বিচারে মানবাধিকারের লঙ্ঘন। একটি ইসলামী দলের মহিলা কর্মীদের ঘরের মধ্যে মিটিং করাটাকে ষঢ়যন্ত্রের তকমা লাগিয়ে তাদের প্রতি কিভাবে অবিচার করা হয়েছিল গোটা দেশের মানুষ তা জানে। আর পুরুষ কর্মীদের ব্যাপারে কি করা হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রভুদের স্বার্থ রক্ষাকারী মানবাধিকার ও নারী-অধিকার সংস্থার মহিলা কর্মীরা পর্যন্ত, নিগৃহীতাদের পক্ষে কোনো ভূমিকা রাখেনি। কারণ নিগৃহীতারা ছিলেন কোনো একটি ইসলামী সংগঠনের জনশক্তি। অথচ তারা বিভিন্ন ফোরামে বড় বড় বুলি আওড়িয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে নারী মুক্তি ও অধিকার আদায়ের ঠিকাদারী তাদেরই হাতে।
গণতন্ত্র, শান্তি ও সচ্চরিত্রের প্রতীক হিসাবে দাবিদার বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দরাও সুযোগ পেয়ে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও টকশোগুলির মাধ্যমে ইসলামী দল ও কর্মীদের বিরুদ্ধে চুটিয়ে বক্তব্য দিয়েই চলেছে। তাদের বক্তব্য থেকে মনে হতে পারে শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র, জনগণের সম্পদ ও দেশের সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ সদস্যদের উপর খামাখা ইসলামী দলের কর্মীগণ আগ বাড়িয়ে আক্রমণ করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। তারা ইসলামী দলকে জঙ্গী সংগঠনের সাথে একীভূত করে প্রচারও করছে। বিষোদ্গার করা হচ্ছে ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করার ব্যাপারে।
বাম মোর্চার সমর্থনে ইতিমধ্যে কয়েকটি হরতাল ডাকা হয়েছে। সরকারের সক্রিয় সমর্থনে রাজপথে গান-বাজনা ও নৃত্যের তালে-তালে পালিত হরতাল সরকারের পক্ষ থেকে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়তোবা এটি একটি আদর্শ হরতাল হিসাবে লিখা থাকবে। কারণ বর্তমান সকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এমনটি মনে হয়েছে। অন্যান্য হরতালগুলিতে বামদের সমর্থন প্রাপ্ত কর্মীদের হাত-পা ভেঙ্গে এবং চোখে-মুখে মরিচের গুঁড়া ঢুকিয়ে হাসপাতালে পাঠানোকে তারা কিভাবে দেখছে বলতে পারবোনা। তবে পূর্বাপর বক্তব্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তাদেরকে বলা উচিত তাদের কর্মীরাই আগ বাড়িয়ে পুলিশের উপর আক্রমণ এবং জ্বালাও পোড়াও করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল। ফলে পুলিশ তাদের কর্মীদের উপর চড়াও হয়েছিল। তারা ভালোভাবেই জানে সরকার আজ্ঞাবহ পুলিশ বাহিনী এবং দলীয় ক্যাডারকে বিরোধীদের আন্দোলনকে যে কোনোভাবে হোক দমন করার জন্যে নির্দেশ দেয়া রেখেছে। সরকারের নিকট বাম-ডানের কোনো বাছবিচার নেই, বিরোধী হলেই হলো। অথচ বাম ঘরানার নেতা-কর্মীরা একবারও বলছেনা, জামায়াত-শিবিরের কর্মীদেরকে বিগত চার বছর নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাংগঠনিক কাজ করতে না দেয়াটা ছিল মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তাদের মতে বামদের জন্যে যা হয় নিপীড়ন, ইসলাম পন্থীদের জন্য তা হয় সন্ত্রাস দমন। কি চমৎকার যুক্তি।
বেশ কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশ সন্ত্রাসীদের অভয়ারন্যে পরিণত হয়েছে। সরকারি দলের ক্যাডারদেরকে সন্ত্রাসী বলতে নেই। আদর করে বলতে হয় সোনার ছেলে।
সোনার ছেলেরা নানা অপকীর্তির সেঞ্চুরীর উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে যতই অঘটন ঘটাকনা কেন তারপরও সোনাই থেকে যায়। মানবতা বিরোধী অপরাধ তাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনা। কাজেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নই আসেনা। মানবাধিকার বিরোধী সকল কাজ করে ঐ কেষ্টা বেটারা। তাই আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সোনার ছেলেদের আকাশচুম্বী অপরাধে মানবতা আর মানবাধিকারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে।
মানবাধিকার সনদের ধারা সমূহের ৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কাউকে খেয়াল-খুশিমত গ্রেফতার, আটক অথবা নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে না। অথচ বাংলাদেশের সরকার বর্তমানে সেটাই করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন করার কারণে এখন দেশে মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার চলছে। অন্য দিকে সরকার নিজেই মানবতা বিরোধী কাজের মাধ্যমে মানবাধিকারের বিপরীত কাজ করেই চলেছে। তাই মানবাধিকার প্রশ্নে সকলের জন্যে একই রকমের ভাবনা নিয়ে সামনে এগুতে হবে। নচেত পক্ষপাত মূলক ভাবনা ও কাজ কারোর জন্য মঙ্গল বয়ে আনবেনা। মানবাধিকারের অজুহাতে আজকে যারা নিপীড়কের ভূমিকায় রয়েছে, পালা বদলের পর তাদেরকেও নিপীড়নের মুখোমূখী হতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্রঃ
১. http://www.un.org/en/documents/udhr/index.shtml
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন