সাপ্তাহিকী
|
এস এম মুকুল
|
|
সম্ভাবনার বাংলাদেশ : আমরা কি ভাবছি
02 Feb, 2013
আসলেই কি আমাদের দেশ ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ’? আসুন একটি গল্প শুনি। কোনো বানোয়াট কাহিনী নয়। গাজীপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি ও জাপানের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এঞ্জেল এসোসিয়েশন আয়োজিত ২০০০ সালের ৩ মে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এসেছিলেন জাপানের -এর পরিচালক মি. আকিরা জুকো । জুকোর মুখেই শোনা যাক পজিটিভ বাংলাদেশের কথা।
সেমিনারে আকিরা জুকো বলছিলেন, ‘শুভ দিন। আমি তিন বছর পর বাংলাদেশে এসেছি। এবার ৪র্থ বার। শুধুমাত্র আমি নই। আমার স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব এমনকি জাপানের তরুণ-তরুণীরাও একসাথে এই দেশে এসেছেন। সেই সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। আমাদের বাংলাদেশ সম্বন্ধে দৃঢ় আগ্রহ রয়েছে।
পৃথিবীর দ্রুত শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত জাপান। জাপানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। কিন্তু অতীত ইতিহাসের দিকে পেছন ফিরে তাকালে গত পঞ্চাশ বছর আগে জাপানও অতি দরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিল। আমার শৈশবের কথা চিন্তা করলে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার সাথে বেশ সাদৃশ্য খুঁজে পাই। তখন আমার ছোট বেলার স্মৃতি ভেসে উঠে। ৫০ বছর আগে জাপানে রাস্তাঘাটে ভিখারী ছিল। গাছের নীচে বসে চুল, দাড়ি কাটতে দেখেছি। জাপানের সবাই ছিল ক্ষুধার্ত। রাস্তাঘাট ছিল জনসংখ্যার ভারে উপচিয়ে পড়া। এ্যাসফল্টের রাস্তা ছিলনা। রাস্তায় চলতো তোবড়ানো গাড়ি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপান দারিদ্র্যসীমার নিচে স্থান পায়। জাপানিদের যথেষ্ট খাবার ছিলনা। সকলের ছিল দারিদ্র্যময় জীবন। সেই দারিদ্র্য অবস্থা থেকে প্রত্যয়ী জাপানিরা উঠে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর অতি উন্নত অর্থনৈতিক সীমারেখায় এসে পৌঁছেছে তারা। জাপানিরা পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছ থেকে ‘অতি পরিশ্রমী’ হিসেবে বিদ্রুপ শুনেছে। কিন্তু দরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তোরনের জন্য নিজের সর্বশক্তি দিয়ে পরিশ্রম করে গিয়েছে। তাদের কোনো কুণ্ঠাবোধ ছিলোনা। কাজই তাদের ধর্ম-কর্ম। কাজের ক্ষেত্রে কোনো ছোট-বড় চিন্তা তাদের নেই।
আপনারা বাংলাদেশী। আপনাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান হয়তো বড়, মাঝারী, ছোট বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। ৫০ বছর পর আপনার প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর উঁচু সারির প্রতিষ্ঠান হতে পারে। আপনাদের মধ্য থেকে যদি পৃথিবীর উঁচু সারির শিল্পপতি ব্যবস্থাপক একজনের পর একজন দাঁড়াতে থাকেন তবে পৃথিবীতে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ উন্নত অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে স্থান লাভ করবে।
মি. আকিরা জুকো’র সম্ভাবনার ইঙ্গিত নিশ্চয়ই আমাদের আশান্বিত করবে। উদ্যোগী ও প্রত্যয়ী মানুষটি জোরালো কণ্ঠে বলেছেন, ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হবে’। তিনি শিল্প ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার গল্পও শুনিয়েছেন আমাদের। ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে জুকো বলেছেন সাফ কথা। জুকো’র ভাষায় ব্যবস্থাপনায় থাকা উচিত উঁচু কর্তব্য জ্ঞান। একজন সাধারণ শিল্পপতি ব্যবস্থাপককে প্রশ্ন করা হয় আপনি কেন এই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন?
তার উত্তর ‘নিজের আর্থিক উন্নতি চাই, সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে চাই’।
কিন্তু তিনি বলেন, কোম্পানি কারও নিজের জিনিস নয়। কোম্পানী দেশ ও সমাজের সম্পদ। দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই কোম্পানী পরিচালিত হবে। এই ছিল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অন্য একজন সাধারণ ব্যবস্থাপকের সাথে তাঁর পার্থক্য। বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে যেন দেশ এবং সমাজ ঐ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা দর্শনের উপর বিশ্বাস রাখে।
পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য দূর করার জন্য ভাল জিনিস সস্তায় উৎপাদন করে বিক্রয় করতে হবে। এটা তার পানি দর্শন হিসেবে খ্যাত। পানি দর্শন হলো ট্যাপের পানি আপনি যেখান থেকেই ইচ্ছা সহজেই পান করতে পারেন। তেমনি বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রও সস্তায় বেশী উৎপাদন করে সহজে ক্রেতার নাগালের মধ্যে রেখেছেন। মানুষ যেন তার জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারে অধিক সংখ্যায়।
সবশেষে আপনাদের সাফল্য কামনা করছি যা দেশের উন্নয়নে শরীক হবে। আমরা জাপানী। আপনাদের উন্নয়নে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ পেলে আনন্দিত হবো। সকলের উপস্থিতির জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
প্রিয় পাঠক, জাপানির জীবন ও উন্নয়ন দর্শনে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা জানা গেল। দূরদেশের এ গুণী মানুষটির সম্ভাবনার অনুসন্ধানী বয়ান যেকোনো দেশ ও জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। ১৬ কোটি জনসংখ্যাবহুল দেশ বাংলাদেশ। এই বিশাল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে সম্ভাবনার বাংলাদেশের ইঙ্গিত করে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বেকার সমস্যার ভারে ভারাক্রান্ত দেশটিতে কর্মসংস্থানের অব্যবস্থাপনা, অনিশ্চয়তা, সম্ভাবনাকে উতড়ে দিয়ে সমস্যাকে আমাদের মাঝে প্রকট করে তুলেছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে আমরা সবাই সমস্যাকে জটিল সমস্যা হিসেবেই দেখছি। বেকার সমস্যা জাতীয় সমস্যা একথা সত্যি। কিন্তু তার সমাধান অসম্ভব কিছু নয়।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার অধিক্য যেমন আছে, তেমনি আছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। দেশকে নিয়ে আমরা যতই হতাশা ব্যক্ত করি না কেন উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আমাদের জনসংখ্যা ও সম্পদ কাজে লাগিয়ে সম্ভাবনার বাংলাদেশেরই ইঙ্গিত করছে প্রতিনিয়ত। তাই তারা নানা কর্ম-পরিকল্পনায় বিনিয়োগেও অতি উৎসাহী। বাইরের মানুষ আমাদের মাঝে সম্ভাবনা দেখলেও আমাদের ভেতরের চোখ খোলে না। পারস্পারিক দন্দ্ব-সংঘাত আর সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে যেন স্তিমিত হয়ে পড়ছে ‘পজিটিভ বাংলাদেশ’।
পৃথিবীর কোনো উদ্যোগই একক প্রচেষ্টায় রাতারাতি সফলতা পায়নি। বাংলাদেশেও তা হবে না। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনও সহযোগিতায় তিলে তিলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই অগ্রসর হতে হবে আমাদের। অলৌকিকতার বলে পলকে যেমন সবকিছু গোছগাছ করে তোলা সম্ভব নয়, তেমনি সমস্যা নিয়ে সমাধানের পথে না এগুলে সম্ভাবনার শেষ প্রত্যাশার আলোও এক সময় নিভে যাবে। আসুন সকলে সচেতন হই। যে যার অবস্থান থেকে নাগরিক দায়িত্ব পালন করি। ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম পরিহার করি। অন্যায়ের বিপক্ষে এক হয়ে রুখে দাঁড়াই। অন্যায় অপরাধিদের সংখ্যা সৎ, সাধারণ মানুষের সংখ্যার তুলনায় অতি নগন্য। তাদের মাঝে একতা আছে। আমাদের মাঝে একতা নেই। আসুন সবাই দেশকে অšর দিয়ে কাজে কর্মে ভালেঅবাসি। আসুন মিলেমিশে দেশ গড়ি।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন