১৩ এপ্রিল ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক দৈনিক হাফিংটনপোস্ট একটি শিরোনাম করে, “পুঁজিবাদের সমাপ্তি: কী হবে পরবর্তী ব্যবস্থা(The End of Capitalism -- So What's Next?)। এমন ধরনের শিরোনাম শুরু হয় ২০০৮ সালে পশ্চিমাবিশ্বে আর্থিক খাতে ধস নামার পর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে পতনের শেষ প্রান্তে এ নিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মতামত প্রকাশ করেন। শুরু হয় বিশ্বব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা। দি এন্ড অব আমেরিকান সেনচুরি (The End of the American Century, 2008)) বইয়ের লেখক ও আমেরিকার বাটলার ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানের প্রফেসর ডেভিড এস ম্যাসন (David S Mason) বলেন,“গত ৫০ বছর ধরে আমেরিকা যে প্রভাব-প্রতিপত্তি বৈশ্বিক নেতৃত্বেও ক্ষেত্রে দেখিয়েছে সে সময় শেষের পথে। দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দৈঊলিয়া হয়ে গেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে আমরা আমাদের অবস্থান হারিয়ে ফেলেছি। বিশ্বেও অন্যান্য দেশের সাথে আমাদেরকে এখন আর ভালোর দিক থেকে তুলনা করা হয় না। এখন আর কেউ আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে না, যেমনটি আগে করা হতো। এখন আর আমাদেরকে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মডেল হিসেবে কেউ দেখে না, যেমনটি আগে দেখত। তাই এটা আমাদের ও গোটা বিশ্বের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।”১
পুঁজিবাদ রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থা পরিচালনার একটি ব্যবস্থা, যা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের ভিত্তিতে ইউরোপে বেড়ে উঠেছিল চার্চেও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অবসানের মধ্য দিয়ে। পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্র ও ইসলামের মতো একটি ব্যবস্থা। পুঁজিবাদের আদর্শ ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, মালিকানার স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিতের মাধ্যমে সমাজে বাস্তবায়িত হয়। পুঁজিবাদের মালিকানার স্বাধীনতার ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছে পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। গণতন্ত্র বা জনগণের স্বার্বভৌমত্ত এর রাজনৈতিক ব্যবস্থা। ‘স্বাধীনতা’ বা ব্যক্তি স্বাধীনতা হলো এর সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি। নিচের চিত্রটি দেখলে বোঝা যাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্বরূপ।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী জাতিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাজনৈতিক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মতো অতটা প্রসিদ্ধ নয়, যতটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তাত্ত্বিকভাবে গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের সমাজের আইন-কানুনু তৈরি দায়িত্ব থাকলেও, সমাজের মূল ক্ষমতা থেকে যায় পুঁজিপতি বা বিত্তশালীদের হাতে। সত্যিকার অর্থে পশ্চিমা বিশ্বে তথা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাজনৈতিক মঞ্চের আড়ালে পুঁজিপতিরা সরকারকে তাদের অধীন্যস্ত করে রাখে। অর্থনৈতিক ফ্যাক্টরগুলোই নীতি নিধারণ ও আইন প্রনয়ণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের দলীয় ও নির্বাচনের খরচ মার্কিন পুঁজিপতিরাই দিয়ে থাকে। ফলে পুঁজিপতিরাই সমাজ বা রাষ্ট্রের আসল শাসক বনে যান। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক চিন্তার প্রধান উপজীব্য বিষয় হলো ব্যক্তি বা সমাজের সুবিধা/ভোগ ও লাভ/স্বার্থ। আর এ চিন্তার প্রকাশ আদর্শিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে দেখা যায়। যেমন- অন্ধ জাতীয় স্বার্থ বিশিষ্ট বাস্তববাদী (Realist) পররাষ্ট্রনীতি। যেমন, ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাকে আক্রমন করবে কিনা তা তাদের পুঁজিপতিরাই নিধারণ করেছিল। ‘গণতন্ত্র’ শুধু পুঁজিবাদীদের ব্যবস্থা নয়, নাস্তিকতাবাদী বা বস্তুবাদী সমাজতন্ত্রীরাও জনগণের স্বার্বভৌমত্ত প্রতিষ্ঠার কথা বলে থাকে। নিজেদের গণতন্ত্রী বলে দাবী করে। দাবী করে জনগণের অধীনে থাকবে সরকার। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী চিন্তা থেকে গড়ে ওঠা পশ্চিমা এ ব্যবস্থা ‘পুঁজিবাদ’ বলেই পরিচিতি লাভ করেছে।
১৯৯১ সালে সিনিয়র বুশ স্টেট অব ইউনিয়নের ভাষণে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে আমেরিকা বিশ্বে একটি ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। একথা দিয়ে তিনি বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাস্তবায়নেরই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিশ্বায়নই যার আসল ঘোষণা ছিল। কারণ, সমাজতন্ত্রেও আদর্শিক ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতার ফলে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরাজয় ঘটে তখন। উসমানিয়া খিলাফতের পতনের পর মুসলিম ভূ-খ-গুলোতে যে অনগ্রসরতা দেখা দেয়, তার সমাধান হিসেবে মুসলিমদের শিক্ষা ব্যবস্থা, বই-পুস্তক ও স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামগুলোতে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র তাদের জন্য মুক্তি বয়ে আনবে। উদাহরণ দেরয়া হয়, খ্রিস্টান ধর্মেও গোড়ামীর হাত হতে পশ্চিমা বিশ্বকে মুক্তি দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী পুঁজিবাদ। পুঁিজবাদই ইউরোপে আলোকিত যুগ রেঁনোসা ও শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে সমৃদ্ধি এনেছিল। তাই মুসলিমরা যদি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে, তাদের সমাজেও সমৃদ্ধি আসবে। কিছু মুসলিম নেতা কখনো কখনো এ মতবাদী ভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে হেটেছেন। কেউ বা বনে গেছে কামাল আতাতুর্কের মতো পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের দালাল। কিন্তু, অচিরেই প্রকাশিত হয়েছে পুঁজিবাদের আসল রূপ কত ভয়ংকর। তাই, উপনিবেশিক যুগ থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুঁজিবাদের শোষণ ও জুলুমের শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এশিয়া, আফ্রিকার মানুষ থেকে শুরু করে আজও খোদ ইউরোপ-আমেরিকাতেও এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের মূল কারণ এ আদর্শেও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারাবাহিক ব্যর্থতা। আর ব্যর্থতার ভিত্তিতে আছে আদর্শেও দার্শনিক, ধারণা ও চিন্তাগত ভ্রান্তি। ফলে পুঁজিবাদ যে সকল রাষ্ট্রে বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত সে সকল স্থানের মানুষের মাঝে সুখ, মানসিক প্রশান্তি, সামাজিক বন্ধনের স্থায়ীত্ব ও প্রগতিশীল সামাজিক নিরাপত্তা দেখা যায় না। আর শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নই একটি সমাজের সাফল্যেও মাপকাঠি হতে পারে না।
পুঁজিবাদী আদর্শে প্রধান এক নির্মাতা ইংরেজ দার্শনিক হার্বাট স্পেনসার (Herbert Spencer) তার প্রিন্সিপাল অব বায়োলজি বইয়ের মধ্যে “সব চেয়ে যোগ্যতমের টিকে থাকা”র "survival of the fittest" ধারণাটির অবতারণা করেন”। স্পেনসার বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিকভাবে যে শক্তিশালী সে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলকে শেষ করে দেবে। অর্থাৎ দুর্বলতমের টিকে থাকার প্রয়োজন নেই। আর এটাই পুঁজিবাদের সাফল্য ও শক্তির আসল রহস্য। তিনি একটি আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলেন। দাবি ছিল অযোগ্যেও নতুন উৎপাদনে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন দুর্বল-সবল একে অপরকে ‘সহযোগিতা’ ছিল সমাজ গড়ার ও সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য। শুধু প্রতিযোগিতা নয়। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন, সকল সমাজ কল্যাণমূলক উদ্যোগ সাধারণভাবেই মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায় কারণ কল্যাণমূলক কার্যাবলী জনসংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। জনকল্যাণমূলক কার্যবলী গ্রহণ করলে ঐ মানুষগুলো হয়তো অনাহারে অর্ধাহারে মারা যেত। তিনি বিশ্বাস করতেন, “ব্যক্তির জন্য সমাজ, সমাজের জন্য ব্যক্তি নয়”। অর্থাৎ সমাজের অন্য সদস্যরা গোল্লায় গেলেও প্রতিটি ব্যক্তি শুধু নিজের স্বার্থেও কথাই ভাববে। এ সকল চিন্তা থেকে বোঝা যায় পুঁজিবাদ শোষণ, কঠিন প্রতিযোগিতা ও নিষ্ঠুর এক ব্যবস্থা। এমন চিন্তা এ আদর্শেও অন্যান্য দার্শনিকদের মধ্যে ও দেখা যায়। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি বিশ্বাস ও প্রচার করতেন,“জোর যার, মুল্লক তার” (Might is Right) । রাজনীতি সম্পর্কে তার আরো ভয়ংকর চিন্তা ছিল। তিনি বলতেন, “রাজনীতির সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই” ২ (Politics have no relation to morals) । তিনি আরো বলতেন, “শাসককে হতে হবে সিংহের মতো বলবান ও শিয়ালের মতো ধুর্ত”। তার প্রিন্স গ্রন্থে লেখেন, “শাসকের (প্রিন্সের ) ওয়াদা ভাঙ্গার জন্য কোনো বৈধ কারণ থাকার প্রয়োজন নেই”৩। উপরোক্ত কিছু উক্তি থেকে বোঝা যায় পুঁজিবাদী এ সকল দার্শনিক এক দিকে যেমন নেতিবাচক, অন্যদিকে হাতাশাবাদী। আর তাদের চিন্তা থেকে যে পুঁজিবাদী আদর্শ এসেছে তা সমাজে নিষ্টুরতা, টিকে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম, মিথ্যা ও যুদ্ধেও জন্ম দিয়েছে। যার প্রতিফলন বর্তমানেও পশ্চিমা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি পুঁজিবাদী রাজনীতিকদের মিথ্যাচার ও ভণ্ডামীর মধ্যে দেখা যায়। দেখা যায় তারা বড় বড় দুর্নীতি ও নারী কেলেঙ্কারির মতো বিষয়ে জড়িত। তাই পুঁজিবাদের ধারক নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস, দেশে দেশে উপনিবেশি শোষণ ও দখলের ইতিহাস। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সৃষ্টির ইতিহাস। আনবিক ও ক্লাস্টার বোমায় লক্ষ মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংসের ইতিহাস। যেন এক একটি দেশ “সন্ত্রাসবাদ”-এর পিতা। তাদের উপনিবেশ রাষ্ট্রগুলোকে পেশি শক্তি প্রয়োগে দাসত্বেও শৃঙ্খলে বাঁধার ইতিহাস বলে পুঁজিবাদ বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বেও উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। তাই বুঝি ৮০০ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দুনিয়াটা ঘিরে রেখেছে। আজ পুঁজিবাদ ও এর নেতৃত্বের দেশ ও জাতিগুলোর শব্দগুলো অনেক দেশের সংস্কৃতিতে আজও গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন- তুই একটি ‘বৃটিশ’ বা ‘পুঁজিবাদী’।
১. পুজিবাদী গণতন্ত্রের প্রবঞ্চনামূলক আদর্শ ও ব্যর্থতা:
পুঁজিবাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। আধুনিক পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের মূল বিশ্বাস ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ ও ‘ফ্রিডম’ (স্বাধীনতা)। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের দিকে তাকালে এ আদর্শেও ভ্রান্তিগুলো আমরা দেখতে পাব। পশ্চিমা জ্ঞানগুরু প্লেটো আজ থেকে হাজার বছর আগেই গণতন্ত্রেও ভবিষ্যত অনুধাবন করেই বলেছিলেন, “গণতন্ত্র হলো মুর্খের শাসন।” যদিও আধুনিক গণতন্ত্র হলো জনপ্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র কিন্তু সব গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি একই। পুঁজিবাদী আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির জনক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি বিশ্বাস ও প্রচার করতেন,“জোর যার, মুল্লক তার” (Might is Right)। রাজনীতি সম্পর্কে তার আরো ভয়ংকর চিন্তা হলো, “রাজনীতির সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই” (Politics have no relation to morals) । ফলে এ সকল বাস্তববাদী (Realist) আদর্শ চিন্তাকে মাথায় রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নীতি নিধারণ করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো। ম্যাকিয়াভেলি আরো বলতেন, “শাসককে হতে হবে সিংহের মতো বলবান ও শিয়ালের মতো ধুর্ত”। তার প্রিন্স গ্রন্থে লেখেন, “শাসকের (প্রিন্সের ) ওয়াদা ভাঙ্গার জন্য কোনো বৈধ কারণ থাকার প্রয়োজন নেই” (A prince never lacks legitimate reasons to break his promise.) ।
ম্যাকিয়াভেলি তার দ্যা প্রিন্স গ্রন্থে লিখেছেন, “ভালবাসা দিয়ে শাসন করার চেয়ে ভয় দিয়ে শাসন করা অধিক নিরাপদ”। উপরোক্ত কিছু উক্তি থেকে বোঝা যায় পুঁজিবাদী এ সকল দার্শনিক এক দিকে যেমন নেতিবাচক, অন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপর শক্তি প্রয়োগের মতো যুদ্ধবাদী রাজনীতি পুঁজিবাদদের রাজনীতিতে। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পুঁিজবাদের ইতিহাস হত্যা, দখল, যুদ্ধ ও অশান্তির ইতিহাস। আর তাদের জাতীয় স্বার্থেও নামে উপনিবেশবাদ, নয়াউপনিবেশবাদী (বিশ্বায়ন) ‘সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদী রাজনীতির সর্বশেষ পর্যায়”(লেলিন)। তাই আমরা দেখি হিটলার, মুসোলিনি ও বুশদের মতো মানবতার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী যুদ্ধবাজ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রনেতা পৃথিবীতে এসেছে।
যে ইউরোপের ভূমিতে হাজার বছর ধরে এ ফ্রিডমের চাষ-বাস করা হচ্ছে, সেখানে আজও সকল ধর্ম, বর্ণ ও সব শ্রেণীর মানুষের বিশ্বাস ও অংশ গ্রহণের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আজও ইউরোপে হিজাবকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। আসলে গণতন্ত্রে যে ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ বা জনগণের শাসনের কথা বলা হয় তা যে নিছক মিথ্যা তা আগে কিছুটা আলোচনা করেছি। আর সত্যি হলো পুঁজিবাদীদের চাপিয়ে দেরয়া আদর্শ অনুযায়ী, চললে, বললে, লিখলে আপনি স্বাধীন কিন্তু বিরুদ্ধে গেলে আপনি মৌলবাদী অথবা জঙ্গি। তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী ইসলামপন্থিদের ও সমাজতন্ত্রপন্থিদের এমনটিাই বলে থাকে। ‘জনগণের শাসন’ কথাটি পুঁজিবাদীদের সাধারণ মানুষের সাথে সবচেয়ে বড় মিথ্যা ও প্রবঞ্চনামূলক কথা। সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষ এমনকি তাদের এমপিরাও দেশ বা পৃথিবী শাসন করে না। একটি পুঁজিবাদ রাষ্ট্রে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে পুঁজিপতিদের অনুগত গুটিকয়েক রাজনীতিক। তারা প্রধানমন্ত্রি বা রাষ্ট্রপতি। আর দলগুলো পরিচালনা ও নির্বাচনী খরচ, মিডিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ সবই এই পুঁজিবাদগোষ্ঠিরাই করে থাকে। তাই দেশের আইন প্রণয়ন হয় বেশির ভাগই তাদের অনুকূলে ও তাদের ইশারায়। অর্থাৎ গণতন্ত্রেও নামে দেশের আসল শাসক থাকে প্রভাবশালী ও পুঁজিপতিগোষ্ঠি। আমেরিকান দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন এ্যাডামসের একটি মন্তব্য আমাদের কাছে গণতন্ত্রের প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরে। এ্যাডামস বলেছিলেন,“গণতন্ত্র কখনো টিকে ছিল না। গণতন্ত্র স্বল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় এবং অবশেষে নিজেকেই নিজের অকাল পরিনতি ডেকে আনে। গণতন্ত্র কোথাও বাস্তবে ছিল না এবং সে কখনো আত্ম হত্যাও করেনি।”। এডামস আরো বলেছিলেন,“যখন লোকজন লেখার, মতপ্রকাশের ও চিন্তার স্বাধীনতার কথা বলে তখন আমি না হেসে পারিনা। এসব বাস্তবে কখনো ছিল না, বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। আজ থেকে শত-হাজার বছর পরে এটি আসতে পারে যখন আমরা লেখা বা কথা বলা ছেড়ে দেব।” । তাই জাতীয় ও বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে আমেরিকা-বৃটেন ইরাককে মিথ্যা অজুহাতে যখন আক্রমন ও ধ্বংস করা হয়, অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। যারা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ফেরিওয়ালা তারাও বিশ্বাস করতেন, সাধারণ মানুষের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা- এগুলো গণতন্ত্রেও মার্কেটিং শ্লোগান। আমেরিকান গণতন্ত্রেরজনক আব্রাহাম লিংকন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ‘সিভিল ল বাতিল’ ঘোষণা করেছিলেন। ১৮৬২ সালে তিনি হিবিয়াস কর্পাস আইন বাতিল করেন এবং মিলিটারি আইনের আওতায় তিনি ১৩০০ কপারহেড ডেমোক্রেটদের আটক করে। এরই প্রেক্ষিতে আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি লিংকনের এহেন কার্যকালাপকে যখন ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেন তখন বর্তমান গণতন্ত্রীদের আদর্শ লিংকন ৮৪ বছরের ঐ বৃদ্ধেও বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে।
পুঁজিবাদের হীনমন্য ও সমাজবিরোধী পররষ্ট্রনীতি:
পুঁজিবাদী পররষ্ট্রনীতির পথিকৃত ম্যাকিয়াভেলি বলতেন, “সব কিছুর আগে যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে”৪ । অর্থাৎ পুঁজিবাদী বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি হলো নিজ দেশের স্বার্থ ও স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে হবে। এর বাস্তব উদাহরণ ইউরোপের ত্রিশ বছর যাবৎ যুদ্ধ, শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ, বিশ্ব যুদ্ধ, উপনিবেশিক কালের যুদ্ধ, ইরাক ও আফগানিস্তান আগ্রাসনের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি। ইরাক যুদ্ধের কালে এক পশ্চিমা ভাষ্যকর বলেছিলেন, “যুদ্ধ ব্যবসা আনে, আর ব্যবসা উত্তম” । বস্তুত: মানবাধিকার হলো আগ্রাসনের এক অস্ত্র যার অজুহাতে আমেরিকা-বৃটেন-ফ্রান্স সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো আক্রমন ও লুট করে।
মানবাধিকারের বোল দিতে দিতে যারা কণ্ঠনালী ছিড়ে ফেলার উপক্রম সারা পৃথিবীতে সেই গণতন্ত্রেও মোড়ল আমেরিকা-বৃটেন গুয়ান্তামো বে, বেলমার্স, আবু গারিব, বাগরাম ইত্যাদি বিভিন্ন অবৈধ গোপন ও প্রকাশ্য কারাগারে যেভাবে অমানবিক নির্যাতন, যৌন নিযার্তন, ধর্ষণ ও হত্যার মতো কার্যবলী পরিচালনা করে যাচ্ছে। এ সকল নীতি ও ঘটনা প্রমাণ করে তাদের গণতন্ত্রেও ধারণা ইউটোপিয়া বা অলীক ধারণা বৈ অন্য কিছু নয়। যার আড়ালে পুঁজিবাদদের এক নায়কত্বেও শাসন চলে বিশ্বব্যাপী।
দুর্নীতি উন্নয়ন সহায়ক!
পুঁজিবাদ আদর্শ যেহেতু বস্তুবাদী ভোগবাদে বিশ্বাস করে তাই অর্থই তাদের সমাজের উন্নতির মাপকাঠি। তাই ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদ সমাজের প্রতিটি মানুষ অর্থ উপার্জনই জীবনের লক্ষ হিসেবে দেখে। তাই, সাম্রাজ্যবাদী বড় রাষ্ট্রগুলো অনৈতিকভাবে অন্য দেশের সম্পদ লুট করে নিজদেশের ভোগ ও সমৃদ্ধি বজায় রাখে। কখনো নিজদেশের বড় বড় রাজনীতিকরাও অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে যায়, যেমন- ক্লিনটন নারী ঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িত হয়ে পড়ে। ভারতে পার্লামেন্টে প্রকাশ্যেই ঘুষের কারবার আমরা দেখতে পাই। তাই, গণতন্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে তারা দুর্নীকে কমিয়ে আনার কথা বলে। তাদের বিশেষজ্ঞরাও মেনে নেন, “দুর্নীতি গণতন্ত্রের ক্যান্সার (Corruption is the cancer of democracy) । এ আদর্শে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে, “দুর্নীতি উন্নয়নের সহায়ক”। অর্থাৎ পুঁজিবাদী আদর্শ এক নেতিবাচক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সমাজকে পরিচালিত করে।
সহিংসতা মার্কিন পুঁজিবাদ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফল:
যুক্তরাষ্ট্রে আবার ২১ ডিসেম্বও, ২০১২ বন্দুকধারীর গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন। পূর্বাঞ্চলীয় পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি প্রত্যন্ত এলাকায় এ গুলির ঘটনা ঘটেছে। কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যের নিউটাউন শহরে বন্দুকধারীর নির্বিচার গুলিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০ শিশু শিক্ষার্থীসহ ২৬ জন নিহত হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর গতকাল পেনসিলভানিয়ায় এ ঘটনা ঘটল (দৈনিক প্রথম আলো : ২২/১২/২০১২)।
গোটা বিশ্ব স্যান্ডিলুক হত্যাযজ্ঞে (২০১২) নিহতদের পরিবারগুলোর প্রতি সহমর্মিতা জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট রাজ্যের নিউ টাউনের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের কথা বলছি। এটা ভয়াবহ ট্র্যাজেডি : মারা গেছে ২৭ জন, যাদের ২০ জনই মাত্র ছয়-সাত বছর বয়সী শিশু। আমেরিকার ইতিহাসে কোনো স্কুলে এত নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আর ঘটেনি। মার্কিন সমাজে সহিংস ঘটনার সংখ্যা কেন এত বেশি, এর একটা বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক শক্তি অর্জন করেছে সহিংসতার প্রতিষ্ঠানগুলো ও উপায়-উপকরণের সাহায্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন দেশ যে, পৃথিবীতে বেশি ব্যয় করে সামরিক খাতে। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ৭১১ বিলিয়ন ডলার। গোটা দুনিয়ার সব দেশ মিলে প্রতিরক্ষার জন্য মোট যত ব্যয় করেছে, এ বছর এটা তার ৪০ শতাংশেরও বেশি। ৮০০ মার্কিন সামরিক ঘাঁটি দুনিয়াটা ঘিরে রেখেছে।৫ এই দেশটার কাছে বিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্রের যে ভাণ্ডার রয়েছে, মানবজাতির ইতিহাসে কোনো জাতি কিংবা কোনো সাম্রাজ্যের হাতে এত মারণাস্ত্র কখনো ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক, তাদের মোট সম্পদের ৩৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেখানকার মাত্র এক শতাংশ ধনী মানুষ। ইউরোপে-বৈষম্য এত প্রকট না হলেও তাদের মোট সম্পদের প্রায় ৩০ শতাংশের মালিক মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ।৯ উন্নত বিশ্বের পরিস্থিতি মোটামুটি এমনই। উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। মন্দার কারণে বিগত তিন বছরে এ বৈষম্য আরো বেড়েছে। সমস্যাসংকুল ইউরোপের ঋণ সমস্যা বিস্তৃত হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষণা করেছে বহু আগেই। এখন রাষ্ট্র দেউলিয়া হওয়ার পথে। এ দুরবস্থার প্রথম সারিতে আছে গ্রিস। পর্তুগাল, ইতালি, স্পেন, আয়ারল্যান্ড কারো অবস্থাই তেমন ভালো নয়। কয়েকদিন আগে ব্রিটেন ও পর্তুগালের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণমান হ্রাস পেয়েছে। কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পরিশোধে সফলতা দেখাতে পারেনি। সেখানেও বৈষম্য বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই এখন ভালো নেই এবং তাদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।
২০১০-এর জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৭০ শতাংশ আছে ৩০ শতাংশ মানুষের কাছে। এর পেছনে মূল অবদান সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাস্তবায়ন। সরকার গত অর্থবছরে এ খাতে ২০ হাজার ৯শ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। চলতি অর্থবছরে ব্যয় করছে ২২ হাজার ৬শ কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ২ দশমিক ৫১ শতাংশ। বিশ্বের সব দেশেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও হয়। বরং বলা চলে, সেখানে এসব কর্মসূচিতে ব্যয় অনেক বেশি। অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু এতে বৈষম্য ঘোচে না। কারণ, তাদের কর্মসূচিগুলো সামাজিক নিরাপত্তামূলক। সামাজিক ক্ষমতায়নের কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয় না।
২. পুঁজিবাদী সংস্কৃতি সামজিক শান্তি, বন্ধন ও সম্পর্কে বিপর্যয় ঘটায়:
ব্যক্তি স্বতন্ত্রবাদী পুঁজিবাদী আদর্শ ব্যক্তির ভোগ, মজা, আনন্দোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব গুরুত্ব দেয়। তাই ব্যক্তি যাতে ভ্রুন হত্যা (মাতৃগর্ভেও জীবন্ত শিশু হত্যা) কোনো অপরাধ নয়। বৃটেন-আমেরিকা-ভারতের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসে তাদের পর্নইন্ডাস্ট্রি হতে। বস্তুত: এ সকল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে নারীকে দেখা হয় পুরুষের যৌন চাহিদা পুরনের ভোগ্য পণ্য হিসেবে। নারীর শরীর, শারীরিক সৌন্দর্য ও ফ্যাশান ইন্ডাস্ট্রির অন্তর্গত পণ্য। নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নের আড়ালে নারীদের বেশ্যাবৃত্তিকে কাজ/ সেবার মর্যাদার মতো হঠকারী দাবি তোলা হয়। প্রকৃত পক্ষে পুঁজিবাদ সংস্কৃতি নারী সামাজিক নিরাপত্তাকে ধংস করে দিয়েছে।
পুঁজিবাদ এখনো নারী-পুরুষের সম্পর্ক কী বা কেমন হওয়া তা নির্ধারণ করতে পারেনি। পুরুষে-পুরুষে, নারীতে-নারীতে বিবাহ ও যৌন সম্পর্কেও মতো বিকৃত আচরণ গণতান্ত্রিক আমেরিকার পার্লামেন্টে আইন সিদ্ধ হয়েছে। অথচ ২০ শতকে সমকামিতা আমেরিকায় নিষিদ্ধ ছিল। আসলে বন্য জীব-জন্তুরাও স্বাভাবিক যৌন জীবন যাপন করে কিন্তু পুঁজিবাদ আদর্শ সৃষ্টির সেরা মানুষকে জন্তু-জানোয়ারের চেয়ে নির্কষ্ট অবস্থানে নিয়ে এসেছে। ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী সমাজে যৌন সঙ্গী/ স্ত্রী/স্বামী/বয় ফ্রেন্ড/গার্ল ফ্রেন্ড বদল করা হয় তুচ্ছ কারণে। তারা আমাদের সহিষ্ণুতার ছবক দিতে আসে অথচ আমেরিকান স্ত্রী/স্বামীর নাক ডাকা নিয়ে হাজার হাজার দম্পতির ডিভোর্স হয়ে যায়। নারী-পুরুষের প্রকৃতি ও স্বভাব বুঝে নারী-পুরুষের পারিবার ও সমাজে কী ভূমিকা থাকবে তা নির্ধারণ করতে পারেনি। যা ইসলাম করেছে ১৪০০ বছর আগে। তাই পুঁজিবাদ রাষ্ট্রগুলো ও সমাজে পারিবারিক সুখ, প্রশান্তি ও সুস্থ সামাজিক বন্ধন ধ্বংস হয়েছে। বিশ্বেও সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রি দেশ ভারতে প্রকাশ দিবালোকে গণধর্ষণে শিকার হয়ে মারা যায় তরুণীরা। শুধু নারী নয়, শিশুরাও মা-বাবার আদরে গড়া পরিবারের মাঝে পশ্চিমা পুঁজিবাদ বিশ্বে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। ক্রমাবর্ধমান বৃদ্ধাশ্রম সাক্ষী দেয় পারিবারিক জীবনের সকল বন্ধন পুঁজিবাদ রাষ্ট্রগুলোতে ভেঙ্গে পড়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তাদের সমাজে সীমাহীন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। শুধু বস্তুর মাঝে সুখ তথা ভোগের মাঝে মাঝে সুখ এই মিথ্যা ধারণা, হতাশা ও বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু দেয়নি। তাই আমরা যখন দেখি- য্ক্তুরাষ্ট্রের তরুণ রবার্ট হক্সিন্স বিখ্যাত হওয়ার আশায় ৮ জনকে গুলি করে আত্মহত্যা করে, তখন আমরা মোটেই অবাক হই না। যখন দেখি ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে তারা মুখে ফেনা তুলে ফেলে অথচ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সুতিকাগার রাষ্ট্রে ‘হিজাব’ নিষিদ্ধ করা হয় আইন করে তখনও আমরা মোটেও আশ্চার্যান্বিত হই না। যখন দেখি ইউরোপ আমেরিকার মানুষ নিজের বাচ্চা ও স্বামীর চেয়ে পোষা কুকুরের প্রতি বেশি যতœশীল তখন আমরা মোটেই হতবাক হই না। যখন দেখি- পৃথিবীর ৪% এরও কম মানুষ আমেরিকায় বাস করে কিন্তু তারা পৃথিবীর ৩৫% এরও বেশি সম্পদ ভোগ করে। এমনকি আমেরিকার মধ্যেও সেখানকার ১০% মানুষ সে দেশের ৯০% এরও বেশি সম্পদের মালিক। এবং সেখানের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষই দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। আমেরিকায় বেকারত্বের হার যখন ৯ শতাংশের বেশি, তখন ক্ষুব্ধ হওয়ার জন্য অন্য কারণের দরকার হয় না। কিন্তু বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সংকটই এর কারণ নয়; কারণ হলো, সমাজে ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা বৈষম্য। এত দিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন সবচেয়ে বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তখন সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অংশটির সম্পদ বাড়ছেই। সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ১৭ দশমিক ২ মিলিয়ন সংসার—প্রায় প্রতি সাতটি পরিবারের একটি পরিবারের কোনো খাদ্যনিরাপত্তা নেই। শিশুদের মধ্যে এই হার আরও বেশি। বিক্ষোভকারীদের যে ¯শ্লোগান ‘আমরাই ৯৯ শতাংশ’এর উৎস হচ্ছে, এই তথ্য যে ১ শতাংশ মার্কিন ধনী নিয়ন্ত্রণ করে ৩৮ শতাংশ সম্পদ। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকটের ফলে দেশের প্রায় সব পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশের ধনিক গোষ্ঠী আর করপোরেশনগুলোর মুনাফা বেড়েই চলেছে। বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিহীন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী পুঁজিবাদ চিন্তাই তাদের চিন্তা ও জীবন পরিচালনার ভিত্তি। এই ভুল মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা চিন্তা,ধারণা ও জীবন দর্শনই আজ তাদের পতনের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে।
আমেরিকা সুখী মানুষের দেশ নয়
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলোর শ্রমজীবী জনসাধারণের কাছে যুক্তরাষ্ট্র যেন এক অধরা স্বপ্ন। এসব মানুষের বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রোজগার করার সাধ আকাশের চাঁদের মতো অধরা থেকে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সম্পদ ও অসীম ক্ষমতার গল্প এসব দেশের মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু নতুন ধরনের পরিসংখ্যান বলছে, ‘স্বর্গে’ সুখী নয় খেটে খাওয়া মানুষরা। সেখানে ধনী-গরিবের আয়ের তফাত বাড়ছে টাইফুনের গতিতে। শিক্ষার সুযোগ ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। সমাজে-পরিবারে অশান্তিতে অতিষ্ঠ কিশোর বয়সীরা বন্দুক হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সহপাঠীর ওপর। হত্যা করছে স্কুলপড়ুয়া শিশুদের। সম্প্রতি দ্য ডন -এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষের বাস লাতিন আমেরিকায়। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ কাতার, সবচেয়ে বেশি আয়ুষ্কালের মানুষের দেশ জাপান বা সবচেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিতের দেশ কানাডার মানুষও দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের মতো সুখী নয়। জগতের সবকিছুর প্রতি সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখে, এমন মানুষের বাস পানামা ও প্যারাগুয়েতে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন-গোষ্ঠীর তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৩৩।১০ লাতিন আমেরিকার বৃহৎ অর্থনীতির দেশ মেক্সিকো ও ব্রাজিলের অবস্থান আরও পেছনে। এ জরিপ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, সমৃদ্ধিশালী দেশের মানুষও অসুখী হতে পারে।
৩. ভোগবাদী চিন্তার সমাজে নারীর নিরাপত্তাহীন জীবন:
আমেরিকায় যৌন নির্যাতন বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে:
মার্কিন কারাগারগুলোতে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আমেরিকার অ্যালাবামা অঙ্গরাজ্যের টুটউইলার মাহিলা কারাগার এরই মধ্যে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছে। ওই কারাগারে কয়েদি হয়ে আসার পর ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিনজন নারী গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন। এছাড়া এ ধরনের আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন মন্টগোমারিভিত্তিক এনজিও ইক্যুয়াল জাস্টিস ইনিশিয়েটিভের আইনজীবী চারলোট মরিসন। তিনি জানান, তারা টুটউইলার মহিলা কারাগারের ৫০ জনের বেশি নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং সাক্ষাৎকারে এসব নারীর সবাই বলেছেন তারা প্রত্যেকেই ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অথবা তারা অন্য নারীকে ধর্ষিতা হতে কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছেন।১১ মনিকা ওয়াশিংটন নামে এক নারী ওই কারাগারে আসার পর কারারক্ষীর ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েন (রেডিও তেহরান)।
পুঁজিবাদ ভারতে অপরাধের মধ্যে বেশি বেড়েছে ধর্ষণ:
নয়াদিল্লিতে চলন্ত বাসে মেডিকেলের এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় গতকালভারতের পার্লামেন্টে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সদস্যরা এ ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁরা গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন এবং দোষীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানান। ১৬ ডিসেম্বও, ২০১২ রাতে দক্ষিণ দিল্লিতে উত্তরাখন্ডের ২৩ বছর বয়সী ওই ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হন।১২ গণধর্ষণের পর ওই ছাত্রী ও তাঁর সঙ্গের ছেলেবন্ধুকে নৃশংসভাবে মারধর করে দুর্বৃত্তরা। রড দিয়ে বেধড়ক পেটায় ছেলেবন্ধুকে। এরপর চলন্ত বাস থেকে তাঁদের ফেলে দেরয়া হয়।
ভারতের নয়াদিল্লিতে ২০১২ সালে ৬৩৫টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। এতে মাত্র একজন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেরয়া পরিসংখ্যানে এই তথ্য জানা গেছে। তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৬৩৫টি ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৭৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের একজনকে দোষী সাব্যস্ত করেন আদালত। ৪০৩ জনের শুনানি চলছে, ৩৪৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং দুজনকে খালাস দেরয়া হয়েছে। ২০১১ সালে নয়াদিল্লিতে ধর্ষণের ঘটনায় সব মিলিয়ে ৫৭২টি মামলা হয়। ২০১০ সালে ধর্ষণের মামলা হয় ৫০৭টি এবং ২০০৯ সালে ৪৬৯টি ও ২০০৮ সালে মোট ৪৬৬টি। ২০১১ সালে ধর্ষণ মামলায় মোট ৭৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে ১৮ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা, খালাস দেরয়া হয় ৩৪ জনকে এবং ৫৯৭ জনের বিরুদ্ধে এখনো বিভিন্ন আদালতে শুনানি চলছে। ৮৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে (টাইমস অব ইন্ডিয়া)।
৪. পুঁজিবাদ অর্থনীতির সম্প্রতিক ব্যর্থতা ও ধ্বস:
আমেরিকায় বেকারত্বের হার যখন ৯ শতাংশের বেশি, তখন ক্ষুব্ধ হওয়ার জন্য অন্য কারণের দরকার হয় না। কিন্তু বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সংকটই এর কারণ নয়; কারণ হলো, সমাজে ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা বৈষম্য। এত দিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন সবচেয়ে বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তখন সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অংশটির সম্পদ বাড়ছেই। সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ১৭ দশমিক ২ মিলিয়ন সংসার—প্রায় প্রতি সাতটি পরিবারের একটি পরিবারের কোনো খাদ্যনিরাপত্তা নেই। শিশুদের মধ্যে এই হার আরও বেশি। বিক্ষোভকারীদের যে ¯শ্লোগান ‘আমরাই ৯৯ শতাংশ’এর উৎস হচ্ছে, এই তথ্য যে ১ শতাংশ মার্কিন ধনী নিয়ন্ত্রণ করে ৩৮ শতাংশ সম্পদ। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকটের ফলে দেশের প্রায় সব পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশের ধনিক গোষ্ঠী আর করপোরেশনগুলোর মুনাফা বেড়েই চলেছে। ৭
বৈষম্য ও দারিদ্র্য বৃদ্ধির সময়ে করপোরেশন আর করপোরেশনের পরিচালকেরা তাঁদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এতটাই বাড়িয়েছেন, যাকে ‘অশ্লীল’ বললে মোটেই অতিরঞ্জন হবে না। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের হতাশা—দেশের দুই দল রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্র্যাটদের একাংশ এদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বের সবটাই এই করপোরেশনগুলোর স্বার্থরক্ষার জন্য প্রাণপাত করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে এই করপোরেশন ও ধনীদের প্রভাব সীমাহীন। ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে যে ২০০৯ সাল থেকে এই ধনিক গোষ্ঠী ও করপোরেশনগুলো—যাদের সীমাহীন লালসা এবং যাদের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণহীনতা এই অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে, লাখ লাখ মানুষকে গৃহহীন করেছে, বেকারত্বের পথে ঠেলে দিয়েছে—তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে (আলী রীয়াজ, ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলনের বার্তা, দৈনিক প্রথম আলো : ১১/১০/২০১১)।
২০১১ সাল জুড়ে সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি:
বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোতে অর্থনৈতিক টানাপড়েন চলেছে ২০১১-এর প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে উন্নত ও উদীয়মান দেশগুলোর অর্থনীতিতে। বিশ্বজুড়ে শিল্প উত্পাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথ গতি দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণে বৃহত্ অর্থনীতির দেশগুলো এখনও ধুকছে। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে প্রায় সব অঞ্চলের অর্থনীতিতে। ব্যাংকিং খাতেও দুরবস্থা ছিল প্রায় বছরজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে শতাধিক ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। ইউরোপ ও এশিয়ায় বৃহত্ ব্যাংকগুলো কর্মী ছাঁটাই করেও নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিনিয়োগ ও মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। বছরজুড়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা কাটাতে নানা উদ্যোগ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন