প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক রাশিয়া সফর বাংলাদেশ-রাশিয়া ফেডারেশন, দুই দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্কের দিগন্ত উন্মোচন করেছে। দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। রাশিয়া বাংলাদেশের পাবনার রূপপুরে ২X১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে আর্থিক, কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে। অন্যদিকে রাশিয়া সরকারের দেয়া ১০০ কোটি মার্কিন ডলার (আট হাজার কোটি টাকা) ঋণে সে দেশের সমরাস্ত্র ক্রয় করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার চুক্তি দেশে বেশ আলোড়ন তুলেছে। প্রশ্ন উঠছে আমরা হঠাৎ এত টাকার অস্ত্র কিনছি কেন? আমাদের এই অস্ত্র কেনা অগ্রাধিকার ছিল কিনা? অস্ত্র কেনার চাইতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ প্রাধিকার ছিল কিনা? এতদিন চীন থেকে, আমেরিকা থেকে আমরা অস্ত্র কিনতাম, হঠাৎ প্রতিরক্ষা ক্রয়ে এই দিকবদল যৌক্তিক কিনা? এতে আমাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নতুন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে কিনা? কিংবা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তা সামলানোর উপায় আমাদের আছে কিনা? অন্যভাবে দেখলে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের এই নব উন্নয়ন কাক্সিক্ষত কিনা? বর্তমান বৈশ্বিক, ভৌগোলিক, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই রাশিয়া সফর ও চুক্তি স্বাক্ষর এক সাহসী, উচ্চাকাক্সক্ষী সিদ্ধান্ত কিনা?- এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন শুভ কিবরিয়া
বাংলাদেশ-রাশিয়া
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন রাশিয়া (USSR) যে ভূমিকা রেখেছিল তা স্মরণযোগ্য। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর মস্কো সফর ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তৎকালীন রাশিয়া জোটের অন্যতম মিত্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন মাত্রা স্বাধীন বাংলাদেশে অব্যাহত থাকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পাল্টে যায় এই সম্পর্ক। পাল্টে যেতে থাকে বৈশ্বিক রাজনীতি। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রাসনের তীব্র বিরোধিতা করে বাংলাদেশ। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি এই বরফ গলতে শুরু করে। বাংলাদেশের ঘোড়াশালে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা দেয় রাশিয়া। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ গ্রিডের প্রায় ৩০% রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র খোলা হয়। ১৯৮৬ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে পারস্পরিক সফর চালু হয়। ইতোমধ্যে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে। রাশিয়া নানা ভাগে টুকরো হয়ে যায়। তারপরও রাশিয়ান ফেডারেশন শক্ত ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। সাবেক কেজিবি স্পাই ভøাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী নয়া রাশিয়ার অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষমতা বিশ্বপরিমণ্ডলে বাড়তে থাকে। যে কোনো উপায়ে ব্যবসা হয়ে ওঠে নয়া রাশিয়ার মূলমন্ত্র। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধিতাকে শক্ত হাতে দমন করে নির্বাচিত স্বৈরশাসক পুতিন নানা মাত্রায় তুলনামূলক গরিব দেশগুলোতে সামরিক-বেসামরিক বহুমাত্রিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের চেষ্টা চালায়। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের সময়ে বাংলাদেশের জ্বালানি বাণিজ্যে প্রবেশ ঘটে রাশিয়ার। ২০১২ সালের এপ্রিলে পেট্রোবাংলার সঙ্গে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গ্যাজপ্রম (GAZPROM) দশটি গ্যাসকূপ খননের জন্য ১৯৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেনের চাপের মুখেও বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে সার্বিয়া থেকে স্বাধীন হওয়া কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি। রাশিয়া এটা চায় না বলে বাংলাদেশের শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার এক্ষেত্রে অব্যাহত পশ্চিমি চাপকে অগ্রাহ্য করে।
রাশিয়ার বাজার বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট সম্ভাবনাপূর্ণ। সে বিবেচনায় বিশেষত পোশাক শিল্পের জন্য সে বাজার যথেষ্ট সম্ভাবনাময় থাকা সত্ত্বেও সেখানে এখনও মর্যাদাপূর্ণ প্রবেশ ঘটেনি বাংলাদেশের। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বিকল্প বাজার হিসেবে বাণিজ্যিক বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য রাশিয়া একটি সম্ভাবনাপূর্ণ দেশ।
বাংলাদেশ-রাশিয়া চুক্তি
১৫ জানুয়ারি ২০১৩ বিশ্বের অন্যতম দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানির দেশ রাশিয়ার সঙ্গে ছয়টি সমঝোতা স্মারকসহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ৩টি চুক্তি সই করে বাংলাদেশ।
চুক্তি তিনটি-
* পরমাণু কেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়ার কাছে সহায়তা বাবদ ৫০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তি। এটি ৬০ বছর মেয়াদি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কত খরচ হবে তা নির্ধারণে কারিগরি গবেষণার জন্য ৫০ কোটি ডলার ব্যয় হবে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংবলিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুটি ইউনিটের প্রতিস্থাপনে ১৫০ থেকে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয় হতে পারে।
* রাশিয়া থেকে সমর সরঞ্জাম কিনতে ১০০ কোটি ডলার ঋণ।
* বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে পরমাণু শিল্প তথ্য কেন্দ্র স্থাপন, বাংলাদেশ-রাশিয়া পরমাণু সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় চুক্তি।
বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যৌথভাবে নির্মাণের জন্য চুক্তি ছাড়াও, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে দুই দেশের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ দমনে, বিচার, স্বাস্থ্য পরিচর্যাসহ শিক্ষা বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তার।
কি অস্ত্র, কোন অস্ত্র
আমাদের প্রতিরক্ষা নীতি নেই। এডহক ভাবনার ওপর আমাদের সরকারগুলো সামরিক বিষয়ে নজর দেন। সামরিক সরকার তো বটেই বেসামরিক সরকারগুলোর লক্ষ্য থাকে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন। তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর এটি একটি সাধারণ সহজ রাজনৈতিক সমীকরণ। শক্তিমান সশস্ত্রবাহিনীকে তুষ্ট রাখার রাজনৈতিক প্রবণতা। লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে, ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের নিরিখে, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় কাক্সিক্ষত সমরাস্ত্র সংগ্রহ একটা দেশের স্বাভাবিক রাষ্ট্রীয় নীতি হওয়া দরকার। শক্তিমান সংগঠন হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীকে সামর্থ্যবান করা একটি জরুরি রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এতদিন পশ্চিমা দেশ ও চীনের দিকে মুখ রেখেছিল। এখন চীনমুখী প্রতিরক্ষায় হঠাৎ করে রাশিয়ামুখী হচ্ছে।
অস্ত্র কেনার এই চুক্তি সংসদে আলোচিত হয়নি, মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হয়নি। সরকার এসব বিষয়ে মিডিয়াকেও বিস্তারিত কিছু জানায়নি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে, রাশিয়ান মিডিয়ার বরাতে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৩-১৫ জানুয়ারি ২০১৩ সালের রাশিয়া সফরের মাধ্যমে যে চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়, সেখানে উল্লেখযোগ্য যেসব সমরাস্ত্র কেনা হচ্ছে তার মধ্যে আছেÑ
ক. ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমরাস্ত্র ক্রয়। ২০১৭ সালের মধ্যে এই কেনাকাটা শেষ করতে হবে। ১০% অগ্রিম এবং ৪% সুদে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট ঋণে এই অস্ত্র কেনা হবে। কেনা হবে মিগ-২৯ এসএমটি যুদ্ধবিমান। যা আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেনা মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানের উন্নত সংস্করণ। এই নয়া চুক্তির আওতায় আগের কেনা ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানের আপগ্রেডেশনও করা হবে। যে মডেলের যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে, এই যুদ্ধবিমান ২০০২ সালে কিনেছে ইয়েমেন। সুদানও এই যুদ্ধবিমানের ক্রেতা। ইরান এ বিমান কিনতে আগ্রহী তবে এখনও চুক্তি হয়নি। মিগ-২৯ এসএমটি যুদ্ধবিমান কেনা দেশের তালিকায় রয়েছে পেরু, কিউবা, সুদান, বাংলাদেশ, বার্মা, সার্বিয়া, মালয়েশিয়া।
খ. কেনা হচ্ছে BTR-80 আর্মড ভেহিকেল। লাইবেরিয়াতে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী মিশনে এই সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হয়। ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশের সমরাস্ত্র সম্ভারে এটি যুক্ত হয়ে আসছে।
গ. কেনা হচ্ছে Mi-171sh কমব্যাট-ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার। এই সামরিক পরিবহন হেলিকপ্টার ২০০২ সালে বিশ্ব বাজারে আনা হয়েছে। রাশিয়ান সরকারি মালিকানাধীন অস্ত্র রপ্তানিকারক সংস্থা রসোবর্ন-এক্সপোর্ট (Rosoboron-Export) ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১২০টির মতো এই সামরিক হেলিকপ্টার সরবরাহ করেছে।
অস্ত্র কেনা কেন
বাংলাদেশ হঠাৎ এত সমরাস্ত্র কিনছে কেন? সমরাস্ত্র কেনার যুক্তিই বা কী? অস্ত্র কেনার নীতিই বা কী?
প্রথমত, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার জন্য বাংলাদেশের চোখ ছিল চীনের দিকে, আমেরিকার দিকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতকে লক্ষ্য করেই এতদিন অস্ত্র কেনা হয়েছে চীন থেকে। সাধারণত যে দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা থাকে তার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম যেখান থেকে কেনা হয়, তার চাইতে উন্নততর কিংবা বিপরীত অস্ত্র কেনাই স্বাভাবিক রীতি। ভারত যেহেতু রাশিয়া থেকেই মূলত সমরাস্ত্র সংগ্রহ করেছে, তাই বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল ভারতের কথিত শত্রু চীন থেকেই অস্ত্র সংগ্রহ করা। ভারত-রাশিয়ার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সামরিক-কৌশলগত মিত্রতার নীতির বিপরীতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কৌশল ছিল মার্কিন বলয়মুখী ও চীননির্ভর। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফরে ১০০ কোটি ডলারের সমরাস্ত্র ক্রয় সেই নীতির এক বড় ব্যত্যয় হিসেবে দেখছে বিশ্লেষকরা। এটা এক ধরনের সাহসী, সংশয়পূর্ণ, বড় ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মার্কিন-চীন বলয় থেকে বেরিয়ে রাশিয়ামুখী হবার এই চেষ্টা একটা বড় রাজনৈতিক কৌশল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এ ঘটনার বড় অংশজুড়ে আছে ‘নয়া রাজনীতি’।
দ্বিতীয়ত, যে কোনো দেশের সরকার যখন অস্ত্র ক্রয় করে তার মধ্যে স্বচ্ছতা না থাকলে, আলোচনা প্রকাশ্য না হলে, সন্দেহ হয় কমিশন বাণিজ্যের। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ রকম ঘটনা ঘটেছে। রাজীব গান্ধীর শাসনামলে ভারতের বোফর্স অস্ত্র কেলেঙ্কারি তার বড় উদাহরণ।
বাংলাদেশে টেন্ডারবিহীন এই অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি ছিল গোপনীয়। মন্ত্রিপরিষদে, সংসদে বা পার্টি ফোরামে আলোচনা হয়নি। ক্ষমতার শেষ বছরে এসে সরকার এই অস্ত্র কিনছে। স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক অর্থায়নের সম্ভাবনা থাকে এই কেনাকাটায়। অতীতে আওয়ামী লীগ সরকার রাশিয়া থেকে যখন মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান কিনেছিল, তা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং দুর্নীতির মামলাও চলে। ক্ষমতায় এসে সরকার সেসব মামলা নিঃশেষ করে। কাজেই, আগামী দিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দলীয় অর্থায়নের একটা সম্ভাবনা এখান থেকে আসলে, কিংবা এ নিয়ে কেউ অভিযোগ করলে, তাতে খুব অবাক হবার বিষয় থাকবে না।
তৃতীয়ত, রাশিয়ার নয়া অস্ত্রবাণিজ্য নীতি। রাশিয়ার সমরাস্ত্র বাজার ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব বাড়াতে, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের ফলে, আরব বসন্তে কথিত স্বৈরশাসকদের পতনে এই বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। ইরাক, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া থেকে অস্ত্র কেনার হাঁকডাক আর তেমন নেই। অন্যদিকে মার্কিন সমরাস্ত্র প্রযুক্তি অনেক এগিয়ে গেছে। কাজেই রাশিয়া তার সমরাস্ত্র প্রযুক্তির বাজার খোঁজার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। তুলনামূলক কম দামে, সহজ শর্তে অন্য জিনিসের বিনিময়ে কখনো কখনো ‘একটা কিনলে একটা ফ্রি’ নীতিতেও অস্ত্র বিক্রির জন্য মরিয়া প্রেসিডেন্ট পুতিনের রাশিয়ান ফেডারেশন। পুতিন শাসনামলে সমাজতন্ত্রের বদলে বাজার অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়া রাশিয়া তাই ব্যবসা করতে অন্য আর দশটি পুঁজিবাদী দেশের মতোই লবিস্ট, কমিশন এজেন্ট নিয়োগ করে এ কাজে যথেষ্ট তৎপর।
এই নীতির আওতায় বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বাণিজ্যিকভাবে অনুপ্রবেশ করার বিনিময়ে অস্ত্র বিক্রির ফর্দটি বাংলাদেশকে ধরিয়ে দিয়েছে রাশিয়া বলে অনেকের ধারণা। ফলে ৪% সুদে ১০% অগ্রিম দেয়ার শর্তে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের এই সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে তার সমরাস্ত্র বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করছে। এক ধরনের আগ্রাসী বাণিজ্যের নীতি মেনেই রাশিয়া এ কাজে সফল হয়েছে।
চতুর্থত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বড় সমর্থক ও মিত্র ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতার পর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি। শিক্ষা সহযোগিতার আওতায় বাংলাদেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী বৃত্তি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যায় উচ্চ শিক্ষা নেয়ার জন্য। এই শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ছিল বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য।
উচ্চ শিক্ষা শেষে তারা দেশে ফিরে আসে। তাদের একটা বড় অংশ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারণী কাজে যুক্ত। আওয়ামী লীগে কথিত বামপন্থিদের নয়া ক্ষমতায়নের আওতায় এই সোভিয়েত ইউনিয়ন পড়–য়ারা বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায়, প্রশাসনে, নীতিনির্ধারণে বড় জায়গা নিয়েছে। সমরাস্ত্র, জ্বালানিসহ অন্যান্য খাতে রাশিয়ার সহযোগিতার নয়ানীতি নিতে এই সোভিয়েত ইউনিয়ন পড়–য়ারা বড় ভূমিকা রেখেছে। উল্টোভাবে বলা যায়, সমাজতন্ত্র বিস্তারের রাজনৈতিক কারণে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের তরুণদের ওপর যে বিনিয়োগ করেছিল তার সুফল এখন ভোগ করছে পুঁজিবাদী রাশিয়া। বর্তমানের সমরাস্ত্র ও জ্বালানি বাণিজ্য ডিল তারই সুফল।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মস্কো সফর করলেন ১৩-১৫ জানুয়ারি ২০১৩। স্বাক্ষরিত হলো দুই দেশের মধ্যে সামরিক-বাণিজ্যিক নানা চুক্তি ও সমঝোতা। ঠিক এর সপ্তাহ তিনেক আগে ২৪ ডিসেম্বর ২০১২ ভারত সফর করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। স্বাক্ষরিত হয় ভারত-রাশিয়ার মধ্যে নানা সামরিক-বাণিজ্যিক চুক্তি ও সমঝোতা। সমরাস্ত্র ক্রয়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা তার মূল অংশ। সে হিসেবে বলা যায়, ভারত-রাশিয়া সহযোগিতার একটা ছোট্ট কিন্তু সম্প্রসারিত অংশ হচ্ছে এই বাংলাদেশ-রাশিয়া সহযোগিতা। সে হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতমুখীন প্রভাবের এটা একটা নয়ামাত্রা। ভারতের পরীক্ষিত মিত্রকে বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে পুনরাবিষ্কার করা। অনেকটা ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক আবহাওয়ার মতোই। তখনও ভারত-রাশিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে বড় বন্ধু ছিল। প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী ছিল চীন ও আমেরিকা। সেই পুরনো দিনেই যেন ফিরছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক
ভূ-কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ দেশ। চীন-ভারত-আমেরিকার এশিয়ান লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশের অবস্থান। মিয়ানমারে সম্প্রতি পশ্চিমা রাজনীতির খোলা হাওয়ার ডাক বাংলাদেশকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-রাশিয়ার সমরাস্ত্র ক্রয় ও জ্বালানি বাণিজ্যের নয়া সম্পর্ককে বুঝতে হলে ভারত-রাশিয়ার সাম্প্রতিক সম্পর্ক মান বোঝাটা জরুরি।
৬৫ বছরে পড়ল ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ২০০০ সালের অক্টোবরে ভারত সফরে এসে ঘোষণা করেছিলেন ‘Declaration on the India-Russia Strategic Partnership’- এর। আর ২০১২ সালে সেই পুতিন বহু ঘাটের জল খেয়ে আবার রাশিয়া ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারত সফরে এসে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও উন্নত করার কথা বললেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তাকে অভিহিত করলেন ‘Strategic and Privileged Strategic Partnership’ বলে। ভারত-রাশিয়ার এই সম্পর্ক কথার চেয়ে কাজে গড়িয়েছে বিস্তর। ভারতের সমরাস্ত্র সম্ভারে রাশিয়ার অবদান নিরঙ্কুশ। ভারত-রাশিয়া যৌথ যোগ এখন সমরাস্ত্র উৎপাদনের জায়গায় দাঁড়িয়েছে। 5th Generation Fighter air craft তৈরি করছে ভারত-রাশিয়া যৌথভাবেই। মিগ-২৯ বিমান ভারতের সমরাস্ত্রে যোগ হয়েছে অনেক আগ থেকেই।
ভারতের প্রবৃদ্ধির চাকা সচল রাখতে চাই জ্বালানির নিশ্চয়তা। সেখানে রাশিয়া বড় এক ভরসা। হাইড্রোকার্বন সমৃদ্ধ দেশ রাশিয়া ভারতে গ্যাসসহ জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। ক্রমশ বেড়ে চলা ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২০১৫ সালে দাঁড়াবে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ভারতের তামিলনাড়–র কুন্দামকুলাম এলাকায় ২ X ১০০০ মেগাওয়াটের দুই ইউনিট পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ চলছে রাশিয়ার সহযোগিতায়। ভবিষ্যতে প্রত্যেকটি একহাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও দুটি ইউনিট নির্মাণের কথা রয়েছে সেখানে। এনার্জি, বাণিজ্য, উচ্চপ্রযুক্তি, সামরিক-কারিগরি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বহুমুখী সহযোগিতার চুক্তি করেছে পুতিন-মনমোহন গত ২৪ ডিসেম্বর ২০১২ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। ভারত-রাশিয়া দুদেশই ক্ষমতাধর বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকস (BRICS-Brazil, Russia, India, China, South Africa) এর সদস্য। ভারত-রাশিয়ার সম্পর্কের ভিত হচ্ছে পরীক্ষিত আস্থা ও বিশ্বাসের দ্বারা উত্তীর্ণ। তাদের পারস্পরিক বিনিময়ের মূল জায়গা হচ্ছে সামরিক-কারিগরি ক্ষেত্র। ভারতের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে রাশিয়ার ভূমিকা অতীতের মতো এখনও সচল ও সক্রিয়। সন্ত্রাস দমন, আর্থিক বিনিয়োগ তাদের ভবিষ্যৎ যৌথ লক্ষ্য। গত বছর দুই দেশে পারস্পরিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সামনে তা বাড়ছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর অপসারণের পর সেখানকার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নে ভারত যে বিপুল বিনিয়োগে আগ্রহী রাশিয়া তার বড় রাজনৈতিক সমর্থক।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক রাশিয়া প্রীতিকে তাই বাংলাদেশে ভারত হাওয়ার নতুন তোড় বলছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই।
বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার নয়ানীতি
বাংলাদেশ সম্পর্কে কি ভাবছে আমেরিকা? এই অঞ্চলে আমেরিকার নয়ানীতি কি?
ভারত-বাংলাদেশ নয়া মিত্রতা এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নতুন রূপ পাবার পর আমেরিকা কি ভাবছে সেটা পরিষ্কার হলো ক’দিন আগে বাংলাদেশ সফররত মার্কিন নৌ কর্মকর্তার কথায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার অ্যাডমিরাল সিসিল ডি হেনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। মার্কিন এই ফ্লিট কমান্ডার বাংলাদেশ সফরকালে ১৫ জানুয়ারি ২০১৩ গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, ‘এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক শক্তি ও সামরিক কৌশলে নতুনভাবে ভারসাম্য বিধান করা হচ্ছে। এটা কেবল সামরিক উদ্দেশ্যেই নয়, বাণিজ্য ও অর্থনীতি, তথ্য বিনিময় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য করা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা জোরদার করা হচ্ছে। নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করা হবে।’
এডমিরাল হেনি আরও বলেন, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করার অংশ হিসেবে এ বছরই ১৬টি অত্যাধুনিক নৌযান দেয়া হবে। এছাড়া ‘কাটার জাহাজ’ নামে আরেকটি বৃহৎ জাহাজ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশের নৌ ও সমুদ্রসীমা এবং সমুদ্রের সম্পদরাজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এই সহযোগিতার উদ্দেশ্য। এডমিরাল হেনি সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিকী ও নৌবাহিনী প্রধান ভাইস এডমিরাল জেড ইউ আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
মার্কিন ফ্লিট কমান্ডার সাংবাদিকদের জানান, মালাক্কা থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত সমুদ্রপথে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য চলাচল করে। ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর দিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের এক দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য। তাই এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা জরুরি, মালামালের নিশ্চিত পরিবহনের জন্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার তাগিদে ১৯৫২ সাল থেকে এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আছে।
এ অনুষ্ঠানেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারী দেশ বাংলাদেশ রপ্তানির জন্য সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল। দেশটির দীর্ঘ সমুদ্রপথ রয়েছে, যা মানব পাচার, চোরাকারবার, মাদক পাচার, অস্ত্র পাচার, পাইরেসির হাত মুক্ত থাকা দরকার। সামনের দিনগুলোতে তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদেরও নিরাপত্তা দিতে হবে। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে সহযোগিতা সুদৃঢ় করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়ায় কোস্টগার্ড সমুদ্রপথে ডাকাতির ঘটনা ৭০ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছে।’
এতদিন যা গোপন কথা ছিল, এখন তা প্রকাশ্যে বলছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। এটা খুব পরিষ্কার, বাংলাদেশের তেল-গ্যাস খনিজসম্পদের মালিকানা সুরক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে আমেরিকান সমর নেতারা। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী যখন রাশিয়ায় সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় চুক্তি করছেন ঠিক একই সময় বাংলাদেশে বসে মার্কিন সামরিক কর্তাব্যক্তিরা বঙ্গোপসাগরে তাদের ভূমিকা কি হবে তা প্রকাশ্যে বলছেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য এই নির্দেশনা খুব তাৎপর্যময়।
আপত্তি কোথায়
বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনলে আপত্তি কোথায়? আপত্তির তিন জায়গা- ক. স্বচ্ছতার প্রশ্ন, খ. প্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন, গ. কৌশলগত প্রশ্ন।
এই অস্ত্র কেনায় স্বচ্ছতা কতটুকু, সেটা একটা গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য বড় প্রশ্ন। এখন রাশিয়া থেকে তাদের ঋণে এসব অস্ত্র কেনা কতটা জরুরি সেটা একটা জিজ্ঞাসা। অন্যদিকে, সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে সবচাইতে জরুরি প্রশ্নটি হচ্ছে কৌশলগত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ছিল রাশিয়ানির্ভর। সেভাবেই আমাদের নীতি, কৌশল, জনসম্পদ, রক্ষণাবেক্ষণ, স্পেয়ার পার্টস সংগ্রহ প্রকৃতি গড়ে উঠেছিল। ১৯৭৫ সালের পর থেকে সেই গতিমুখ পাল্টিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম চীন-মার্কিনমুখী হয়। আমাদের সামরিক জনসম্পদ, অর্ডিন্যান্স কারখানা, টেকনিক্যাল পার্সন, স্পেয়ার পার্টস ক্রয় নীতিমালা চীন-মার্কিন অস্ত্র সম্ভারের ওপরেই গড়ে ওঠে। বছরের পর বছর ট্রেনিং, প্র্যাকটিস দ্বারা এ যোগ্যতা গড়তে থাকে। হঠাৎ করে এই নীতির বদল হলে আবার সবকিছু নতুন করে গড়তে হবে। মাঝেমধ্যে প্রতিরক্ষার এই বাঁকবদল একটা দেশের সমর যোগ্যতার জন্য সুখকর বিষয় নয়। সমর বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, এই বাঁক বদলের আগে এর প্রভাব কি হবে, কতটুকু প্রস্তুতি লাগবে তার ব্যাপক গ্রাউন্ড ওয়ার্ক দরকার। এসব না করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠলে তা আমাদের যোগ্যতাকেই খর্ব করতে পারে। এটি আপত্তির একটি বড় দিক। অন্যদিকে, পরিবর্তনশীল বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেখানে চীন-ভারত-আমেরিকার ত্রিমুখী অবস্থান সংহত হচ্ছে। আমেরিকার পরিবর্তিত নয়া এশিয়ান পররাষ্ট্রনীতি ও সমর দৃষ্টিভঙ্গিও বিবেচনার দাবিদার। আমেরিকা একক বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তার বলয় ভেঙে নতুন বলয় তৈরি করতে চাইলে যে প্রস্তুতির দরকার ছিল, তা আমরা নিতে পেরেছি কিনা? রাশিয়ার সঙ্গে সমরাস্ত্র ক্রয় চুক্তি চীন, আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর নতুন কোনো চাপ তৈরি করবে কিনা? এসবের ফলে অর্থনীতি-রাজনীতিতে কোনো নতুন উত্তাপ সৃষ্টি হলে তার চাপ আমরা সইতে পারব কিনা? রাশিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে কিভাবে বিবেচিত হবে? এসব কারণেই নানান কথা উঠছে, আপত্তির ভাবনাগুলো বাতাসে ডালপালা মেলছে।
শেখ হাসিনার ‘নয়া রাজনীতি’
বাংলাদেশের সমরাস্ত্র বাজারে একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল চীনের। কৌশলগত অংশীদার চীন নগদ অর্থে অস্ত্র কিনত। বাংলাদেশের বাজারে বিশেষত অবকাঠামো, জ্বালানি খাতে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাও রয়েছে। অথচ এসব বিষয়কে পাশে ঠেলে প্রথমবারের মতো রাশিয়া থেকে ঋণে সমরাস্ত্র কিনছেন প্রধানমন্ত্রী। এটি একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। যখন দেশের অনেক মৌলিক চাহিদা টাকার অভাবে পূরণ করা যাচ্ছে না, তখন লোন নিয়ে অস্ত্র কেনার যুক্তি কি? এ প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশের প্রধান সড়কে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এমপিওভুক্তির দাবিতে পুলিশের নির্মম নির্যাতন সহ্য করছে, শুধু টাকার অভাবে তাদের দাবি মানা যাচ্ছে না, তখন লোন করে যুদ্ধবিমান কেনার যুক্তিও প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে প্রধানমন্ত্রী এই উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কেন? অনুমান করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা মহলকে একটা বড় শিক্ষা দিতে চান!
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরানোর ফলে, গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাসহ তাজরীন গার্মেন্টসের আগুনে শতাধিক শ্রমিক নিহত হবার বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব শেখ হাসিনার সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছে, তার বিপরীতে বাংলাদেশের জ্বালানি ও সমরাস্ত্র বাজারে রাশিয়াকে ওয়েলকাম জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি পাল্টা কৌশল নিলেন। জনসমর্থিত প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমা বিশ্বকে বোঝাতে চান, কারও চাপের কাছে মাথা নোয়াবার মানুষ তিনি নন। অন্যদিকে প্রয়োজনে পশ্চিমা বিশ্বকে ছাড়াও শক্তিমান বন্ধুদেশ খুঁজে নেবার সামর্থ্য যে বাংলাদেশের আছে, তার প্রমাণও তিনি রাখলেন। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী, বলিষ্ঠ এবং উচ্চাভিলাষী ‘নয়া রাজনীতি’র অংশ
যাচ্ছি কোথায়...
প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ। ১৯৬২ সাল থেকে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কথা, ২০১৩ সালে এসে শেখ হাসিনা তা বাস্তবায়নের পথে দৃঢ় পদক্ষেপ নিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তার এটি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু বিবেচনার জায়গা অন্যত্র। দেশে রাজনৈতিক ডামাডোল সুখকর নয়। বিরোধী দল সরকার সম্পর্ক সুখকর পর্যায়ে নেই। ক্ষমতার শেষ বছরে এসে দমন চালিয়ে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার দৃষ্টিভঙ্গি পৃথিবীতে সম্প্রতি কোথাও সফল হয়নি। বাংলাদেশে সে উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে অস্থিরতা বাড়বে। রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর ভারত-রাশিয়া কার্ড কতটা নতুন ফল দেবে সেটা বিবেচ্য। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী ছিল আমেরিকার খাদ্য বাণিজ্য। বঙ্গবন্ধু আমেরিকার সহায়তা না পেয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ব্লকের দিকে ঝুঁকেছিলেন। দেশের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর সেই রাজনীতির বাঁকবদল, বাকশাল গঠনে প্রেরণা জোগায়। বাংলাদেশ কি সেই ইতিহাসের পুরনো পথেই হাঁটবে, নাকি সমঝোতা আর বিজ্ঞ রাজনীতি দিয়ে শেখ হাসিনা নতুন উন্নয়ন রাজনীতির আগুয়ান নেতা হবেন দেখার বিষয় এখন সেটাই।
(সাপ্তাহিক ২৪ জানুযারী ২০১৩ সৌজন্যে)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন