এক.
একুশ হল আমাদের জাতীয় জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশের এক তরঙ্গ। উত্তাপমুখর সেই সময়ে আমাদের পূর্ব পুরুষরা জানিয়ে দিয়েছিলেন আমরা ভাষার জন্য বাঁচি এবং ভাষার জন্যই আত্মত্যাগ করি।
দুই.
বাংলা সাহিত্যের ভ্রুনাঙ্কুরও বলা চলে উত্তাপ মিশ্রিত সেই গৌরবমাখা দিনগুলোর একুশের প্রবন্ধ, গল্প, গান, নঁকশা ও ইতিহাসকে। সেই একুশ আজ আবেগ মিশ্রিত বাঙালির মনের মননশীল উচ্চারণে পরিণত হয়েছে।
তিন.
আপন প্রাণের সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য আর কৃষ্টির সৃজনশীল এক প্রয়াস আমাদের অমর একুশে বইমেলা। বাঙালি’র প্রাণের মাঝে খেলা করা এই ‘বইমেলা’র মাধ্যমে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জাগরণ অভিব্যক্ত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে।
চার.
বইমেলা শুধু বইয়ের প্রচার কিংবা বিক্রি নয়, এটি আজ পরিণত হয়েছে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মেধাবী মুখদের মহোৎসবে। বাঙালি’র প্রাণের, গানের রাগ-অনুরাগের ফাগুনের প্রেমে ভাললাগার অশেষ যেন অমর একুশে বইমেলা।
পাঁচ.
বাংলা ভাষার উন্নয়ন, সাহিত্যের সমৃদ্ধি সাধন এবং পরবর্তীতে নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমী এদেশের ভাষার গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভাষার পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ, সাহিত্য- সর্বোপরি মননের মূল মাধ্যম হল বই। সেই বই নিয়ে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে বাংলা একাডেমীর বটতলায় চট বিছিয়ে বিক্রি করার মধ্য দিয়ে এ মেলার সূচনা হয়েছিল। বই বিক্রির সে আয়োজন করেছিলেন প্রকাশনা জগতের কিংবদন্তী পুরুষ মুক্তধারা’র স্বত্ত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এদেশের প্রথম বইমেলা।
ছয়.
মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় অবস্থান নেয়া এদেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকদের লেখা মুক্তিযুদ্ধ নির্ভর ৩২টি বইয়ের আয়োজন নিয়ে ছিল এ মেলা। প্রচারণা ছাড়াই এ মেলার লোক সমাগম হয়েছিল অনেক।
একই বছর বাংলা একাডেমী বিশেষ মূল্য ছাড়ে নিজেদের বই বিক্রি করা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ইউনিসেফের সহায়তায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রও বইমেলার আয়োজন করে। মুক্তধারা’র মুক্ত প্রাণের এই উদ্যোগের সাথে ১৯৭৬’এ ‘আহমদ পাবলিশিং হাউজ’, ৭৭’এ ‘নওরোজ কিতাবিস্তান, ‘চলন্তিকা’ যোগ দেয়। ৭৮’এ জাতীয় গ্রন্থ উন্নয়ন সংস্থা’র আয়োজনে বাংলা একাডেমী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বইমেলা’র আয়োজন করে। আর পরের বছরই মেলার সাথে যুক্ত হয় পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। অবশেষে ৮৪’তে বাংলা একাডেমী বইমেলা নাম বদলে নামকরণ করা হয় অমর একুশে বইমেলা।
সাত.
এবারও একুশে বইমেলার আয়োজন চলছে পুরোদমে। মেলার স্টল বরাদ্দ, স্টল তৈরি এবং মেলা চলাকালীন সেমিনার অনুষ্ঠানের স্থান তৈরিতে ব্যস্ত বাংলা একাডেমী। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, সেবামূলক আর গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিবারের মতো এবারও স্টল বরাদ্দ করা হবে। এবার মোট ২৩৪টি স্টল বরাদ্দ করা হবে।
আট.
প্রতি বছরই বইমেলার দর্শক, পাঠক, লেখকের সংখ্যা বাড়ছে আনুপাতিক হারে। কিন্তু সেই তুলনায় বাড়েনি জায়গা। স্থানাভাবে গাদাগাদি করে স্টল নির্মাণ এবং বই রাখতে হয় প্রকাশকদের। ফলে ক্রেতারা অল্প সময়ের মধ্যে বই কিনে অন্যকে জায়গা করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। মেলায় প্রকাশিত হবার অপেক্ষায় নতুন বইয়ের ছাপা, বাঁধাই এবং কাটিংয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। প্রকাশক, লেখক এবং সংশ্লিষ্টরা সবাই ব্যস্ত বইয়ের কাজে।
নয়.
২০১৩ সালের একুশে বইমেলায় বর্তমান বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদের লেখা ছায়ার সঙ্গে মায়ার লড়াই, আমি ধরণীর মেয়ে, উপন্যাস পোড়া মাটির জোড়া হাঁস বের হচ্ছে। কবি মহাদেব সাহার আত্মস্মৃতি-১৯৭৫: সেই অন্ধকার, সেই বিভীষিকা বের হবে। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস আগষ্টের এক রাত বের হবে। ইমদাদুল হক মিলনের সোনার মানুষ, মইনুল আহসান সাবের এর পাঁচ খন্ডে গল্প সমগ্র, নাসরীন জাহানের উপন্যাস সিসেম দুয়ার খোলো বের হবে।
দশ.
বাংলা বই এখন বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলা ভাষা তথা বাংলা প্রকাশনার প্রসারে বিশ্বে বেশ কিছু কাজ চলছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা ও ব্রিটেনে বাংলা স্কুল চালু হয়েছে। যুক্তরাজ্যের নিউ সাউথ ওয়েলস্-এ সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় ৭ম-১০ম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা অনুমোদিত। লন্ডনে ডিসি এসই-তে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল বাংলা ভাষা নিতে পারে । বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, জাপান বাংলা রেডিও এনইচকে, রেডিও তেহরান, চায়না বাংলা রেডিও, রেডিও পিকিংসহ অনেক বিদেশী বার্তা সংস্থা প্রতিনিয়ত বাংলায় সংবাদ প্রচার করে। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্ট্যাডিস এ বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে। আমেরিকায় বাংলা চর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া ভাষা ও সভ্যতা বিভাগ। এছাড়া ক্যালিফোর্নিয়া, কানাডা, রাশিয়া, জাপান, জার্মানির হাইডেলবার্গ, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ রয়েছে।
কানাডার টারন্টোর ডানফোর্থ রোড থেকেই কয়েকটি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশিত হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মরক্কোর রাজধানী রাবাতে বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে আরবি ভাষায় নজরুল রচনাবলি অনূদিত হচ্ছে। ইতোপূর্বে চাইনিজ ও জাপানি ভাষায় নজরুল রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে।
এগার.
গুগল কোম্পানি ২০১০ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভার্চুয়াল লাইব্রেরি গড়ে তুলতে এক কোটি বই স্ক্যান করেছে। অর্থের বিনিময়ে গুগলের অনলাইন পাঠাগারে প্রবেশ করা যাবে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় এন-লিস্ট (ন্যাশনাল লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর স্কলারলি কনটেন্ট) প্রকল্পের অধীন ২ হাজার ১০০’র বেশি সাময়িকী ও ৫১ হাজার বইয়ের গ্রাহক চাঁদা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ফলে বিশ্বের প্রায় সব ই-জার্নাল ও ই-বুক বিনা পয়সায় পড়তে পারবে ভারতের কলেজ শিক্ষার্থীরা। আশা করি বাংলাদেশও এ সুযোগ হাতছাড়া করবেনা।
বার.
বাংলাদেশের বইয়ের বিশ্বায়নে আমাদের জন্য যে বড় সম্ভাবনা রয়েছে তা হচ্ছে :
বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরামসহ এশিয়া মাইনর পর্যন্ত বাংলাভাষী প্রায় ১৫ কোটি মানুষ রয়েছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক বাংলাভাষী মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সব মিলিয়ে বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা ইতোমধ্যে বেশকিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। অনেক বাংলাদেশী ঝুঁকি জেনেও বহির্বিশ্বে বিশেষত লন্ডন, ক্যালির্ফোনিয়া, টরেন্টো শহরে বাংলা বইয়ের দোকান খুলেছে।
তের.
বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় মেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে ঠিকই কিন্তু মানসম্মত বই তেমন প্রকাশ হচ্ছে না। যেনতেনভাবে নতুন বই মেলায় আনার প্রবণতার ফলে মানহীন বই, তথ্য ও মুদ্রণত্রুটিযুক্ত বইয়ে বাজার ভরে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে তা প্রকাশনা শিল্প, ক্রেতা-পাঠক সবার জন্যই ক্ষতির কারণ হচ্ছে। বইয়ের মান সংরক্ষণে প্রকাশক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। একটি বিষয় আমলে নেয়া খুবই প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে প্রকাশনা শিল্পকে মেলাকেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বছর জুড়ে নতুন বই প্রকাশনা অব্যাহত রাখলে মেলার সময়ের বাড়তি চাপ থেকে লেখক-প্রকাশক সবাই মুক্ত থাকতে পারবেন এবং প্রকাশনার প্রতি যথাযথ মনোযোগী ও যত্নশীল হওয়ারও সুযোগ থাকে। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে যেসব আলোচনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয় তাকে রুটিন কাজ হিসেবে না রেখে আরো জনসম্পৃক্ত ও অংশগ্রহণমূলক করার ব্যাপারেও ভাবতে হবে কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া একুশের চেতনা সমৃদ্ধ এ মেলাকে কীভাবে জেলা-উপজেলাতেও সম্প্রসারণ করা যায় তা নিয়েও ভাবতে হবে। সময়ের অভিঘাতে সবকিছুই পাল্টাচ্ছে, বইমেলার চেতনা, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। তবে মেলা যেন কোনোভাবেই তার মূল আবেগ ও চেতনাবিচ্যুত না হয় সে দিকটা ঠিক রাখতে হবে যে কোনো মূল্যে।
সাইফ বরকতুল্লাহ : সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন