সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
কোচিং-নোট বইয়ের খপ্পর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার মুক্তি মিলবে কি?
19 Jan, 2013
গতকাল বাসায় ফিরতেই মেয়ে আমার একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। কোন বিষয়ের জন্য কোন প্রকাশনার নোট বই দরকার। সে এই মুল্যবান তালিকা সংগ্রহ করেছে তার এক ক্লাশ উপরে পড়া খালাত বোনের কাছ থেকে। সে আবার জেলা শহরের নামকরা বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাসে প্রথম হওয়া ছাত্রী। আমার মেয়ের কাছের বান্ধবী এবং মেয়ের মায়ের কাছে পড়ালেখার জন্য অনুকরণীয় রোল মডেল। আমি নীতিগতভাবে নোট বই না পড়বার পক্ষে হলেও সময়ের স্রোতে আমাকেও ভাসতে হবে, সংসারের শান্তি রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে আমাকেও সপ্তাহান্তে ছুটতে হবে নীলক্ষেতে।
স্কুল জীবনের খুব কাছের বন্ধুদের একটা কোচিং সেন্টার আছে জেলা শহরে। ব্যবসা বেশ রমরমা। এক বিল্ডিং-এ আর জায়গা হয় না, দ্বীতিয় ভবন নেবার দরকার হয়েছে। তারা মনে করে কোচিং করবার কারনে তারা ভাল রেজাল্ট করে। স্কুলের ভূমিকা এখানে গৌণ। কারন স্কুলে তো পড়াশুনা হয় না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, স্কুলে যে মানের পড়াশুনা হয় তাতে এত ভাল রেজাল্ট করা সম্ভব নয়, সব অভিভাবকগণ নিজেরা বাচ্চাদের পড়ানোর মত শিক্ষিত নয়। তাহলে পথ কি? আর তা ছাড়া নিজেরা চাকরি করবার পর অবসর সময়ে কোচিং চালায়। তাতে নিজেরও যেমন উপকার হয় (আর্থিক উন্নতি), ছেলে-মেয়েরা ভালো রেজাল্ট করবার মত গাইড পায়। তাদের মতে এটা হচ্ছে সবাই জয়ী হচ্ছে এ রকম অবস্থা (win-win situation)। সরকার শিক্ষকদের কোচিং বন্ধ করানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে এরা স্বভাবতই বিরক্ত!
এ রকম কোচিং শহরে একটা নয়। শহরে ঘুরলে ডজনের বেশিই কোচিং এর সাইন বোর্ড দেখা যাবে। তবে ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু একটা কোচিং সেন্টারে যাওয়াই যথেষ্ট নয়। স্কুলের শিক্ষকদের মন রাখতে তাদের কাছেও বিষয় ভিত্তিক প্রাইভেট পড়া জরুরী।
কিছুদিন আগে এক আত্মীয়র মেয়ের সাথে কথা হচ্ছিল যে ঢাকার একটি নামকরা স্কুলে পড়ে। যে স্কুলে পড়ানোর জন্য বাবা-মা রা নির্দিধায় দুই-তিন বছর পর্যন্ত লস করিয়ে বাচ্চা ভর্তি করতে রাজী আছে। সে তখন ইংলিশ ভার্সনে ক্লাস ফাইভে পড়ত। তার কাছ জানলাম তাদের ক্লাসে নব্বই জন ছাত্রী এক সেকশনে পড়ে। সে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্কুলের ক্লাশ করে। তারপর স্কুলের শিক্ষকদের কাছেই তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কোচিং-এ ক্লাশ করে। সকাল ছয়টায় বাসা থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যা ছয়-সাতটায় বাসায় ফিরে। কোচিং এর ক্লাশেও ত্রিশ জনের অধিক ছাত্রী একসাথে ক্লাশ করে।
পরিমল জয়ধরের কথা না বললে বিষয়টা অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। ভিক্টিম মেয়েটি কিন্তু বাংলা বিষয়ে প্রাইভেট পড়তেই তার বাসায় যেত। যদি তার পড়াটা স্কুলেই সম্পুর্ণ করতে পারত তাহলে তো প্রাইভেট পড়তেই যেতে হতো না। পরের ঘটনাটিও ঘটনার ক্ষেত্র তৈরী হত না।
আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেনীর এক ছাত্রীর হাত ভেংগে দিয়ে এক স্যার খবরের শিরোনাম হয়েছিল ২০১১ সালে। সে ছাত্রীর বর্ণনায় ঃ
“স্যার দুটি স্কেল এক করে পিটাতে থাকে। এক সময় বেঞ্চ থেকে নীচে পড়ে যাই তখনো তিনি মারতে থাকেন। যারা স্যারের কাছে পড়ে না, তাদের উপর স্যার খুব ক্ষ্যাপা থাকেন। স্যার বলেন, আমার কাছে পড়বি , তাহলে বেশী নাম্বার পাবি। যারা স্যারের কাছে পড়ে না তাদের সামান্য ভুল ভ্রান্তিতে স্যার বকা ঝকা করেন, পরীক্ষায় কম নম্বর দেন”।
মোট কথা কোচিং-প্রাইভেট এর ফাদে আটকে গেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। সরকার আইন করে নোট বই নিষিদ্ধ করেছে কিন্তু এমন ছাত্র-ছাত্রী কি একজন ও পাওয়া যাবে যে নোট বা গাইড বই পড়ে না? শতকরা কতজন ছাত্র-ছাত্রীকে কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে যেতে হয়?
আইন করে নোট বই বা কোচিং সেন্টার বন্ধ করা যাবে না যদি স্কুলে ভালো পড়া নিশ্চিত করা না যায়। আর স্কুলে ভালো পড়া নিশ্চিত করলে ছাত্র-ছাত্রীরা কেন কোচিং-এ যাবে? এ জন্য পর্যাপ্ত স্কুল ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরন দিতে হবে, শিক্ষকদের যথাযথ মানের বেতন স্কেল ও সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে। শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষন, উচ্চতর ডিগ্রী নেবার ব্যবস্থা থাকা, ভালো কাজের পুরষ্কার ও পড়ানোর ফাকি দিলে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ জন্য শিখা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
মানসম্মত শিক্ষা টেকসই উন্নতির একমাত্র বাহন। অর্থনীতির ভাষায় শিক্ষা খাতের পজিটিভ এক্সটারনালিটিজ (Positive externalities) খুব বেশী। তার মানে এটা এমন একটা খাত যেখানে ভর্তুকি দেয়া যুক্তিসংগত। সুতরাং জাতীয় আয়ের যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা ক্রমাগত ভাবে বাড়িয়ে শিক্ষার গুনগত মান বাড়াতে হবে। উচু মানের শিক্ষা নিয়ে আমাদের সন্তানেরা বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাড়াবে। আমরা করব জয়, নিশ্চয়...একদিন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন