সাপ্তাহিকী
|
আব্দুল মান্নান
|
|
‘ধর্ম যার যার’ তত্ত্বের অন্তরালে
12 Jan, 2013
ধর্ম যার যার এটি একটি চিরন্তন সত্য কথা। ধর্মের সাথে বিশ্বাসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী যার যে ধর্ম সে তা পালন করবে এটাইতো স্বাভাবিক। জোর করে কাউকে কোনো ব্যাপারে বিশ্বাসী বানানো যায়না। ধর্মের ব্যাপারেও একই কথা সত্য। বিশ্বাস পোষণ করে কোনো ধর্ম গ্রহণ করাটা সম্পুর্ণভাবে একজন ব্যক্তির মনের উপর নির্ভরশীল। কাজেই জোর করে কারো উপর কোনো ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপার নয়।
ধর্ম বিমুখ লোকেরা জনসাধারণকে সরাসরি ধর্ম বর্জন করতে বলার সৎ সাহস রাখেনা। তাই বিশ্বাসের আধার ধর্মকে পাশ কাটিয়ে যাবতীয় কাজকে সার্বজনীনতা দেয়ার লক্ষ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলে। সাধারণ লোকদেরকে বুঝানো হচ্ছে ধর্ম যারযার রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যারযার উৎসব সবার ইত্যাদি। এই তত্ত্বের পক্ষে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, টিভি টকশো এবং খবরের কাগজগুলির মাধ্যমে তথাকথিত প্রগতিশীলদের সফল প্রচারণা চোখে পড়ার মতো।
যারা বিভিন্ন ধর্মের কিছু অংশ যেগুলি তাদের স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক নয় সেগুলি এবং নিজেদের ধর্ম বিবর্জিত চিন্তার সংমিশ্রণে জগাখিছুড়ি মার্কা কিছু একটা দেখতে চায় তারাই এই স্লোগানটিকে বুলন্দ করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে এটাকে একটি রাজনৈতিক স্লোগান হিসাবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ চিন্তার লোকেরা, হয় ধর্ম মানেনা, নয়তোবা ধর্মীয় অনুশাসন আংশিক মান্য করে অথবা তা মানতে আগ্রহী নয়। উল্লেখ্য ধর্ম যারযার, এটির ব্যাপারে সকল ধর্মের নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম।
বিশ্বাসের মূল মন্ত্র কারো অন্তরে গ্রথিত বা প্রোথিত হলেই তার মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি হয়। আর এ মন্ত্র লাভ করা যায় ঐশীগ্রন্থ থেকে। কুরআন ঐশীগ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম ও শেষ গ্রন্থ। পবিত্র কুরআনের আলোকে আদর্শিকভাবে মানব-জাতিকে আমরা প্রধাণতঃ দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী। ঐশীবাণী অনুযায়ী বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয়েরই নির্দিষ্ট সংজ্ঞাও রয়েছে। অবিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেনা বিষয়টি তেমন না। তারাও এক ধরণের বিশ্বাস মনে পোষণ করে। তবে তাদের বিশ্বাস আল্লাহ্ সুবহানু তায়ালার প্রেরিত কিতাবে উপস্থাপিত বিশ্বাসের বিপরীত। অবিশ্বাসীদের কুট-কৌশল হলো ধর্মীয় বিষয়গুলির ব্যাপারে তালগোল পাকিয়ে বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা। ‘ধর্ম যারযার’ স্লোগানটি সেই কুট-কৌশলেরই একটা চাল মাত্র। স্লোগানটির পক্ষ গ্রহণকারী সবাই অবিশ্বাসী তা না। তথাকথিত বিশ্বাসীদের সিংহ ভাগও এদের সাথে রয়েছে।
প্রতিটি ধর্ম নির্দিষ্ট কতগুলো বিশ্বাসের ছকে বাঁধা। যারযার বিশ্বাসের ভিত্তিতে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে। ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার আলোকে সৃষ্ট মূল্যবোধের সাথে বিভিন্ন ধর্মের অনেকটা মিল দেখা গেলেও ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসন মানার ব্যাপারে প্রতিটি ধর্মের রয়েছে স্বতন্ত্র ব্যাবস্থা। কাজেই প্রতিটি সমাজে বা রাষ্ট্রে ধর্মাবলম্বীগণ যেন স্ব-স্ব ধর্ম পালন করতে পারে সে অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। তবে ধর্মের নামে কেউ অধর্ম করলে তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও সমাজ বা রাষ্ট্রের থাকবে।
ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়াও মানুষ অন্যান্য কাজগুলি কোনো না কোনো বিশ্বাস ও নীতিবোধ থেকেই করে থাকে। সুতরাং মনে করার কোনো কারণ নেই যে অন্যান্য বিশ্বাস ও নীতিবোধের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের সংঘর্ষ হবেনা। জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনের বহু কাজের সাথে আমাদেরকে জড়াতে হয়। সে কাজগুলিও ধর্মীয় বিশ্বাস ও নীতির আলোকে না করলে ধার্মিক থাকা যায়না তা আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা।
আমাদের সমাজের লোকদের প্রচলিত ধারণা হলো মহান প্রভুর নৈকট্য লাভের আশায় মসজিদ, মন্দির, গির্জা, বৌদ্ধবিহার ইত্যাদিতে কিছু আনুষ্ঠানিক কাজই হচ্ছে ধর্মীয় কাজ। আরো মনে করে উপাসোনালয়ের বাইরের অর্থাৎ পার্থিব কাজগুলির সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকতে পারেনা এবং থাকা উচিতও না। সে হিসাবে সাধারণতঃ উপাসনালয়ে আনুষ্ঠানিক কাজের ভিত্তিতে কে ধার্মিক তাও বিবেচিত হয়ে থাকে। অন্যান্য ধর্মের জন্য এই মত গ্রহণযোগ্য হলেও হতে পারে। তবে এব্যাপারে ইসলামের স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হওয়াতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র এর বিধানের আওতায় চলে আসে।
‘ধর্ম যারযার’ স্লোগানটির অনুসারীগণ বিভিন্ন ধর্মের লোকদেরকে একাকার করে সমানভাবে দেখতে চায়। আপাতদৃষ্টিতে আবেদনটিকে বেশ উদার বলেই মনে হয়। তাদের কথা শুনে মনে হতে পারে তারা কখনই ধর্মের বিপক্ষে কোনো অবস্থান নেয়না। কিন্তু পার্থিব ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় বিধানের মুণ্ডুপাত করতেও তারা পিছ-পা হয়না। অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য সকল কল-কাঠি তারাই নেড়ে থাকে। আর তথাকথিত একদল নির্বোধ ধার্মিক ঐ হাওয়ায় পাল তুলে ধর্মের নামে অনাচার করে ধর্মকে কলুষিত করে।
‘ধর্ম যারযার’ তত্ত্বের প্রবক্তাগণ কিভাবে সুকৌশলে নিজেদের অপরিচ্ছন্ন কাজগুলিকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে সে ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করতে চাই। তারা প্রথমেই ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে ফেলে। ধর্মের গণ্ডির মধ্য থেকে অপরাজনীতি করার সুযোগ না থাকার কারণে তারা প্রচার করে ধর্মের ন্যায় পবিত্র জিনিসকে রাজনীতিতে নিয়ে এসে ধর্মকে কলুষিত করা মহা অন্যায়। তারা আরো প্রচার করে ধার্মিক লোকদের নিজেদের সততা রক্ষা করার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে রাজনীতির আশেপাশে না গিয়ে উপাসনালয়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় কাজে আত্ম নিয়োগ করা। তাদের কথা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেদেরকে খাঁটি ধার্মিক হিসাবে দাবিদার বিরাট একটা অংশ একই সুরে কথা বলে। নিজেরা রাজনীতি করেনা তা জোর গলায় প্রচার করে। কিন্তু বাস্তবে তারা ঐ মতাদর্শের প্রতি মৌন সমর্থন দেয় এবং সহযোগিতাও করে। প্রকারন্তরে তাদের ঐ কৌশলটিও একটা রাজনীতি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ‘ধর্ম যারযার’ স্লোগানটির অনুসারীগণ নানাবিধ কৌশলের মাধ্যমে তথাকথিত গণতন্ত্রের আবরণ দিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিজেদের অনুকূলে আইন প্রণয়ন করে যা কিনা তাদের সকল কাজকে সুরক্ষা দেয়। এমনকি ধর্মীয় দৃষ্টিতে অনৈতিক কাজগুলিকেও। উদাহরণ স্বরূপ ২০১১ সালে গৃহিত নারী উন্নয়ন নীতিমালার কোনো কোনো অংশ, ইসলামের পর্দার বিধানের বিপরীতে অবস্থান সহ আরো অনেক কিছু সামনে আনা যেতে পারে।
উল্লিখিত তত্ত্বের মাধ্যমে উৎসাহিত করা হয় অন্যদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উৎসবে যোগ দেয়ার জন্যে। যেমন- ঈদ, পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি পালনকালে যে উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাতে সকল ধর্মের লোকেরা একে অপরের আনন্দে অংশিদার হবে। এই তত্ত্বে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের মুসলিমদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলে থাকেন এবার দেবী এসেছেন গজে চড়ে। তাইতো ফসল ভালো হয়েছে। এখানেও উদার নীতির বহিপ্রকাশ ঘটতে দেখলেও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কতবড় অপরাধ তা তারা ভেবে দেখেনা। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি স্ব-স্ব বিশ্বাসবোধ থেকেই পালিত হয়। আর উৎসবগুলির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার অর্থই হলো ঐ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি স্বীকৃতি দেয়া। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি মহা অন্যায় যা তাওবা ছাড়া মাফ হবার নয়। ইসলাম অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনের বিপক্ষে নয়। তবে একজন মুসলমান অমুসলিমদের ধর্মানুষ্ঠানে বা উৎসবে অংশ গ্রহণ করতে পারবেনা।
‘ধর্ম যারযার’ তত্ত্বের মাধ্যমে অধার্মিক বানানোর যে চক্রান্ত লুকিয়ে আছে তা ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে উপলব্ধি করেত হবে। এ চক্রান্ত বিষবৃক্ষে পরিণত হয়ে ধর্মের মূলোৎপাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামের বিধি-বিধানের বিরুদ্ধে ঐ চক্রটি বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এ চক্রান্ত থেকে রক্ষা পেতে হলে সাধারণভাবে সকল ধর্মের অনুসারীগণ চক্রটির কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন এবং মুসলিমগণ কুরআন-সুন্নাহ্র আলোকে জ্ঞান অর্জন করে উম্মাহ্কে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। লোহা ও গোলাবারুদ দিয়ে তৈরি মারোনাস্ত্র নয়, ধর্মীয় তথা ইসলেমের জ্ঞানই হতে পারে অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার শক্তিশালী হাতিয়ার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন