সাপ্তাহিকী
|
এস এম মুকুল
|
|
একটি উন্নয়ন রেনেসাঁর প্রতীক্ষা
12 Jan, 2013
গভীর সঙ্কটের আবর্তে দেশ। ষোল কোটি জনগণের ভূত-ভবিষ্যতকে কেন্দ্র চলছে রাজনীতির হুলি খেলা। ব্যক্তি স্বার্থে, ক্ষমতার মোহে জনগণকে জিম্মি করে একে অপরকে প্রতিহত করতে জ্বালাও-পোড়াও আর ভাংচুরের মাধ্যমে উগ্রপন্থী রাজনীতির উš§াদনা শুরু হয়েছে। বিরোধী দল ক্ষমতার যাওয়ার জন্য বাঙালির বোধ ও চেতনাকে ধুলিস্যাৎ করার বিধ্বংসী খেলায় মেতেছে। সরকার নানান ক্ষেত্রে ক্রমাগত ব্যর্থতার দায়ে জনবিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। ভ্রুক্ষেপহীনভাবে দায়িত্বশীল পদে থেকে মন্ত্রীরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার জন্য উগ্র আক্রমনকে উস্কানি দিচ্ছে। যার ফলে অনিশ্চিত পথে চলছে দেশের অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যত। তাহলে কি দেশ পিছিয়ে যাবে? এর সহজ উত্তর- না।
বাংলাদেশ নামের এই দেশটির জন্ম এবং এগিয়ে চলা শুরু হয়েছিলো হাজারো প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েই।
আজকের বাংলাদেশ অনেক বেশি শক্তিশালী। মুক্তিযোদ্ধাদের পর তরুণরা দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত হচ্ছে। বাংলার তরুণ সমাজ এখন সদা জাগ্রত। তারা সাহসী, মেধাবী, মুক্তচিন্তার অধিকারী এবং কর্মঠ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। তার আহ্বানে সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। যেখানে কৃষক, শ্রমিকই ছিলো বেশি। আজকের বাংলাদেশ অনেক মেধা, বুদ্ধি, প্রযুক্তি শক্তি এবং তারুন্যের উন্মাদনায় অনেক সমৃদ্ধশালী। তাই পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের থামাতে পারবেনা। প্রয়োজন শুধু যোগ্য ও ভিশনারি নের্তৃত্বের। পুরো জাতি একটি উন্নয়ন রেনেসাঁর প্রতীক্ষায়। হাজারো অনিয়ম-দুর্নীতি মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া বাংলাদেশের মানুষ ক্রমশ সোচ্চার ও সচেতন হয়ে উঠছে। অদূরদর্শী নেতৃত্ব আমাদের কাংখিত লক্ষ্য অর্জনের পথকে বাধাগ্রস্থ করছে বারবার। তবু থেমে নেই বাংলাদেশের মানুষ। নিজেরা নিজেদের মতো করে ভবিষ্যত বিণির্মানে নিয়োজিত রয়েছে। নিজস্ব গতিতেই দেশের উন্নয়ন প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। শুধু নেতৃত্বের কারণে এর গতি সঞ্চার হচ্ছেনা। বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার কোন ভিশন বা পরিকল্পনা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আছে বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক আদর্শের জায়গায় ঐক্যমত্য হতে পারছেনা রাজনীতিবিদরা। তবে রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবেÑ পরিবর্তন আসবেই। জনগণকে অন্ধকারে রেখে, বোকা বানিয়ে রাজনীতির দিন শেষ হবে অচিরেই।
জাতি যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে কলঙ্কমুক্ত হতে চায়। তরুণরা এ বিষয়ে সোচ্চার, সচেতন। আমাদের তরুণ সমাজ রাজনৈতিক হানাহানি, লাশের রাজনীতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, লুন্ঠন, বাচালতা, মিথ্যাচার, হরতালের বিরোধী অবস্থানে।
দেশের মানুষের চোখে-মুখে এখন দিনবদলের স্বপ্ন। বাংলাদেশে বইছে পরিবর্তনের স্রোতধারা। এদেশের মানুষের পরিবর্তনে বিশ্বাসী। তাই যখনি নেতৃত্বের সঙ্কট দেখা দিয়েছে তখনি এদেশের মানুষ ভোটের জোয়ারে পরিবর্তন এনেছে। তবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান সময়ে মানুষ এবং এই প্রজš§ যথেষ্ট সচেতন। হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাশকতা ও সহিংস ঘটনার মাধ্যমে দেশকে অস্থীতিশীল করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করাকে জনগণ সমর্থন করবেনা। সরকারের দমন-পীড়ন নীতিকেউ জনগণ প্রশ্রয় দেবেনা। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন ভোটের রাজনীতি করে, তেমনি জনগণও বুঝে শুনেই ভোট প্রদানের পরিকল্পনা করতে শুরু করছে। এই বিচারিক ফলাফল প্রধান দুই দলের জন্যই হয়তোবা ভালো নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা কিংবা দেশের চেহারা পাল্টে দেয়ার প্রতিশ্রুতি অন্তত তরুণরা বিশ্বাস করেনা। তরুণ সমাজ চায় রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দ এবং দলগুলো আগে নিজেদেরকে ডিজিটালাইজ করে নিজেদের ভাবমূর্তি পাল্টে দিক।
আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে ৬৫ পার্সেন্ট ভোট তরুণদের। অতএব তরুণরাই ঠিক করবে দেশ চালাবে কারা। আর রাজনৈতিক দলগুলোকে সে বিচার করেই তৈরি করতে হবে নির্বাচনী ইশতেহার। তরুণরা নেতৃত্বের পরিবর্তন চায়, বাস্তবমুখী প্রতিশ্রুতি চায়। যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাদের প্রতিশ্রুতি হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঠিক তারা যা বাস্তবায়ন করতে পারবে সেটুকুই। জনপ্রত্যাশা সৃষ্টির বাহুল্যতা আর স্বপ্ন-ধোয়াশার প্রতিশ্রুতির প্রতারণা আর নয়। ব্যাপক ভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশীয় বিনিয়োগের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি, বিদেশী বিনিয়োগ, প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি বিনির্মাণ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, জনশক্তি রপ্তানি, জননিরাপত্তা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সর্বোপরি রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অঙ্গীকার ছাড়া কোনো দল বা জোটের ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই।
নেতৃবৃন্দের সজাগ থাকতে হবে, কারণ বিশ্ব ক্ষমতাসীন দেশগুলোর নজর এখন বাংলাদেশের দিকে। তারা আমাদের মাঝে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে একটি কৌশলের ফাঁদ পেতে আছে। যেকোনো মূল্যে জাতীয় ও সমৃদ্ধির বিষয়ে কোনো উস্কানিকে প্রশ্রয় বা অপচিন্তার সাথে আপোস করাকে দেশের জনগণ এবং তরুণ সমাজ ক্ষমা করবেনা। বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের রফতানি আয় আমাদের। বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তো আছেই। এসবকে রাজনৈতিক ভিশনের মাধ্যমে কৌশলে পাশকাটিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে একটি পদ্মা সেতুর জন্য ধরণা দিতে হবেনা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সমঝোতা, জাতীয় ঐক্যমত্য সম্ভব হলে দেশের জনগণ, দেশের ব্যবসায়ীরা, প্রবাসী বাংলাদেশিরাই সেতু গড়ে তোলতে সক্ষম হবেন। এমনকি বিদেশীরা বিনিয়োগের জন্য এসে ধরণা দিবে।
এসব কিছুকে অসম্ভব মনে হচ্ছে কারণÑ দেশকে নিয়ে রাজনীতিবিদদের সুনির্দিষ্ট কোন ভিশনারি পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু রাজনৈক উগ্রপন্থা আর প্রতিহতের মনোভাব এই স্বপ্নের পথে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য চরম মন্দায়। দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। জনগণের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নেই। সেকারণে শিল্প-উদ্যোগ স্থিমিত হয়ে পড়েছে। কর্মসংস্থানের পথগুলো ক্রমাগতভাবে সংকুচিত হচ্ছে। এসবের পরিবর্তনে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। রাজনীতিবিদদেরকে সংঘাত-সংঘর্ষের মনোভাব ত্যাগ করে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং নূন্যতম আস্থার জায়গায় আসতে হবে। একটি জাতীয় চেতনাধর্মী, জনকল্যানমুখি ও আদর্শিক অবস্থান তৈরি না করলে তারা ক্রমশ সিটকে পড়বেন।
দেশের রাজনীতিতে চরম অস্থিরতা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা জনমনে। জনমনে প্রশ্ন কী হচ্ছে দেশে! কোন পথে এগুচ্ছে দেশ। রাজনীতির পরিণিতি কি সংঘাত নাকি সংলাপের সমঝোতা। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে মহাজোট। প্রত্যাশার কতটুকু পূরণ হয়েছে জনগণ সে বিচার করতে শুরু করেছে। বিরোধী দলের দায়িত্ব এবং ভুমিকা নিয়েও হিসাব নিকাশ করছে জনগণ। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমও নিবিড় পর্যবেক্ষনে রয়েছে দেশ জনতার। জামায়াতের অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির কার্যক্রম নিন্দিত হচ্ছে, ঘৃণার বিষবাষ্পে পরিণত হচ্ছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। কেননা, দেশের ভোটারদের সিংহ ভাগই তরুণ ভোটার। তারা তাদের মতো করে হিসাব নিকাশ করবে। তাই ক্ষমতার পটপরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক।
বতর্মান প্রধানমন্ত্রীর দিনবদলের ডাক দিয়ে আপনি মানুষের মাঝে যে আশার আগুন জ্বালিয়েছেন তার বাস্তব প্রতিফলন করতে ব্যর্থ হলে জনগণ আগামী নির্বাচনে সে জবাব দেবে। ২০১৪ সাল নাগাদ প্রতিটি পরিবারে একজন সদস্যের কর্মসংস্থান ব্যবস্থা নেয়া, সমবায় রূপকল্প আর একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সুফল, ন্যাশনাল সার্ভিস কতটা ন্যাশনাল, অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কতটুকু হয়েছে, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্প, নতুন নতুন শিল্প স্থাপন করে কর্মসংস্থান উদ্যোগ, চার নেতার বিচার প্রক্রিয়া এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকর করতে সরকারের অঙ্গীকারের বিষয় মূল্যায়িত হবে আসছে ভোটে।
পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দলের কর্মসূচি কতটা জনগণের পক্ষে, অস্থিরতা সৃষ্টিতে বিরোধী দলের সম্পৃক্ততা, সংসদে তাদের ভুমিকা, জাতীয় স্বার্থের ইস্যুতে তাদের ভুমিকা, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে তাদের ষ্পষ্ট অবস্থান প্রভৃতি বিষয়ে জনগণ মূল্যায়ন করতে শুরু করেছে। বিরোধী দলের কার্যক্রমের উপর জনগণের কতটুকু আস্থা অর্জিত হয়েছে সে বিচারের রায়ও জনগণ দিবে আগামী ভোটে। তরুণ সমাজ সহ দেশবাসী অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
এখন প্রয়োজন ভিশনারি নেতৃত্বের। মালয়েশিয়াকে ড. মাহাতির মোহাম্মদ গড়ে তুলেছেন ভিশনারি নেতৃত্বের গুণে। তিনি দেশের সম্পদ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছেন। দেশের মানুষ ও তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়েছেন। দুর্নীতি অনিয়ম মালয়েশিয়াতেও আছে, তাই বলে সে দেশের উন্নয়ন থেমে থাকেনি। আমাদের দূরদর্শিতার অভাবে আমরা দেশের মানুষের মেধাকে কাজে লাগাতে পারছিনা। দেশের সম্পদ-সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছিনা। জাগিয়ে তুলতে পারছিনা শিল্প সম্ভাবনাকে। দেশের উদ্যোক্তাদের অধিক সুবিধা আর কাজের অনূকুল সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছিনা। আমাদের তরুণ সমাজ মেধার লড়াইয়ে বিশ্বের কাছে মাথা তুলে দাঁড়াতে এবং জয় ছিনিয়ে আনতে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। শুধু শক্তি নয় বুদ্ধির লড়াইয়ে লড়তে চায় তরুণরা। গড়তে চায় সমৃদ্ধ স্বপ্নের বাংলাদেশ। পুরো জাতি এখন সে প্রতীক্ষায়। তরুণরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান আসছে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার কতটা আধুনিক, প্রযুক্তিভিত্তিক, কতটা কর্মসংস্থানবান্ধব, কতটা তারুণ্যের নেতৃত্ব বান্ধব সেসব দেখেই ভোট হবে। মার্কা দেখে আর নয়, ব্যক্তি ইমেজ হোক আগামী বাংলাদেশের নেতৃত্বে নব সূচনা।
এস এম মুকুল, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন